প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়েই এগোতে হবে
ফ কি র ই লি য়া স
======================================
অনেক ঘটনা-দুর্ঘটনার সাক্ষী হয়ে বিদায় নিল ২০১২। আমেরিকায় স্যান্ডির করাল থাবা আর বাংলাদেশে নিশ্চিন্তপুর ট্রাজেডির কথা মানুষ মনে রাখবে বহুদিন।
আমরা জানি মানুষ শান্তি চায়। স্বস্তি চায়। তা কতটুকু পেয়েছে? ২০১২ সালের না পাওয়াকে খুঁটি করে মানুষ কি দাঁড়াতে পারবে- পাওয়ার সাম্রাজ্যে? এমন অনেক প্রশ্ন আমাদের সামনে।
কেমন হবে আমাদের জন্য নতুন বছর? কেমন হবে আমাদের প্রাযুক্তিক জীবন? আমাদের প্রজন্ম কতটা প্রস্তুত নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায়?
আমরা যদি ভাবি লোডশেডিংমুক্ত বাংলাদেশ! বিষয়টি ভাবতেই চমকে উঠবেন অনেকে। সে এক অন্য রকম অনুভূতি। সম্প্রতি সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলেছে, তারা ২০১৪ সালের মধ্যে লোডশেডিংমুক্ত বাংলাদেশ উপহার দিতে পারবে! যদি তাই হয়, তবে তা হবে বাঙালি জাতির জন্য একটি বড় প্রাপ্তি। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, ৪০ বছরে বাংলাদেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। সে তুলনায় মাটি বাড়েনি।
এ অবস্থায় ২০২০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা কত হবে? সে প্রশ্নটি সঙ্গত কারণে আসতেই পারে।
বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে। এ অগ্রযাত্রাকে থামানো যাবে না। যেমনটি যায়নি বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের ব্যবহার। আমি আমার বিভিন্ন লেখায় বলি, বাংলাদেশ মোবাইল ফোন বাণিজ্যে যতটা এগিয়েছে, অন্য খাতে ততটা এগোতে পারছে না কেন? এর প্রধান অন্তরায় কী?
আমার জানা মতে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠিত ফোন কোম্পানি এটিএন্ডটি ১৯৯৮ সালেই বাংলাদেশে তাদের ব্যবসার প্রসার ঘটাতে চেয়েছিল।
আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তা হয়নি। সে সুযোগ দেয়া হয়নি। কোন বিদেশী সংস্থা বাংলাদেশে ব্যবসা করতে গেলেই একটা সুর ওঠে- ‘এই বুঝি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এলো!’
ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পায়। বাঙালির সে অবস্থাই হয়েছে। যারা বারবার শোষিত হয় তারা তো ভয় পাবেই।
তেমন অবস্থা বদলেছে গেল বারো বছরে। আমরা এখন বিভিন্ন বিদেশী বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশে ব্যবসা করতে দেখছি। পুরো সমাজকেই কিনে নিতে চাইছে কর্পোরেট বাণিজ্য সংস্থাগুলো। এসব প্রতিষ্ঠানের হাত এখন প্রসারিত মিডিয়া হাউসের দিকেও। খাতায় সব ধরনের বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের মালিকানা তালিকা থাকবে, আর একটা মিডিয়া থাকবে না, তা কি হয়? তাই মিডিয়া নিয়ন্ত্রণেও এখন কালো হাতের ছড়াছড়ি।
দৈনিক, পাক্ষিক না হয় মাসিক। টিভি স্টেশন স্থাপন করতে না পারলে নিদেনপক্ষে একটা রেডিও। রয়েছে অনলাইন নিউজ সংস্থার প্রতিযোগিতা। যারা ঘটনার কয়েক মিনিটের মধ্যেই সংবাদ ছড়িয়ে দিতে পারছে বিশ্বব্যাপী। এই যে অর্জন, তা সাধিত হয়েছে প্রযুক্তির কল্যাণে।
কিন্তু এই প্রবাহ কি সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত? না, প্রভাবমুক্ত নয়। এটা অনেকেই জানেন।
পাশ্চাত্যের মিডিয়া যে সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত, সেটা আমি বলছি না। দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের মনমতো না হলে তারাও আপনার ‘চিঠিপত্র’ ছাপবে না। যদিও তাদের কর্পোরেট স্লোগান- ‘সব সংবাদই ছাপার দাবি রাখে’।
এমনটি ভাবার সুযোগ নেই যে, নিউইয়র্ক টাইমসে ইহুদি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কোন বিজ্ঞাপন দিতে চাইলে তারা তা ছাপবে। না, ছাপবে না, যত টাকাই দেয়ার কথা বলা হোক না কেন! তাহলে মিডিয়াকে গণমানুষের বন্ধু বলা যাবে কিভাবে? কিভাবে নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে মিডিয়া? এ পথটি সহজ করার জন্যই নিরন্তর সংগ্রাম করতে হচ্ছে বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষকে। তারা পিষ্ট হচ্ছেন এক হাত থেকে অন্য হাতে।
আমরা খুব ভালো করেই জানি, বর্তমান সময়ে একটি-দুটি মিডিয়ার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করার সুযোগ নেই। কয়েকটি মিডিয়া মিলিয়ে দেখে তবেই সত্যের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা উচিত।
এর যৌক্তিকতা দিনে দিনে বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রেও গসিপ ম্যাগাজিনগুলোর পাঠক বেশি। তারা এসব সংবাদকে এক ধরনের প্রমোদ বলেই বিবেচনা করে। ‘ইউএস টুডে’ কিংবা ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ ভাবনার খোরাক দেয়। সত্য-মিথ্যার হিসাব মেলানোর সুযোগ দেয়।
গসিপ ম্যাগাজিনগুলো তো তাও দেয় না। প্রজš§কে এই সত্য অনুধাবনের কাছাকাছি যেতে হবে।
খুবই আশার কথা যে, এখন বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে তিন-চার হাজার টাকা দামের মোবাইল ফোন দিয়েও ওয়েব ব্রাউজ করা যায়। জরুরি সংবাদটি এসএমএস করে পাঠানো যায়। আরেকটু দামি ফোন দিয়ে ছবি তুলেও পাঠানো যায় দেশে-বিদেশে।
তাহলে সত্যটি দাঁড়াচ্ছে এই, একটি ফোন একজন মানুষকে ‘অন দ্য স্পট’ থেকে রিপোর্টার করে তুলতে পারছে বেশ সহজেই। যে হিসেবে একজন সচেতন মানুষই হতে পারছেন এক একজন মিডিয়া প্রডিউসার, ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও। এই যে প্রাপ্তি, তার চেতনাকে ধরে রেখেই এগিয়ে যেতে পারে একটি জাতি। বলার অপেক্ষা রাখে না, তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ বলে দাবিদার বাংলাদেশের সরকার পক্ষ থেকে শক্তিশালী সমর্থন জনগণ পাবে, এটা ভাবতেও কষ্ট হয়। কারণ সরকার ক্ষমতায় যাওয়ার পরপরই তার ঘনিষ্ঠ দলবাজরা স্বার্থ উদ্ধারের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।
হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বীমা, মিডিয়া, খেলাধুলা, সড়ক-জনপথ, ব্যবসা-বাণিজ্য, কূটনীতির সেক্টরÑ সবখানেই দলবাজরা প্রাধান্য পায়।
সরকারে থাকা শীর্ষ ব্যক্তিরা এটাকে একটা উপহার প্রদান বলে যেমন গণ্য করেন, তেমনি তারা নিরাপত্তা বোধ করেন অনুগতদের কাছ থেকে। আর এভাবেই রাষ্ট্রের মেধাবীরা বাদ পড়ে যায়। সুযোগ পেয়ে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরা লাইম লাইটে চলে আসে। এমনকি নিজ দলের মেধাবীরাও হেরে যায় তদবিরবাজদের কাছে।
বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলই এ প্রতিযোগিতা দীর্ঘদিন থেকে করে আসছে। এ মানসিকতার কোন উন্নয়ন ঘটেনি কিংবা ঘটছে না। ওয়ান-ইলেভেনের পর বাংলাদেশে এ সত্যটি আরও সুদৃঢ় হয়েছে, উদার হতে হবে রাজনীতিকদেরই। কারণ একটি দল রাষ্ট্রশাসন করে পাঁচ বছর মেয়াদে। আর জনগণ ভোট দেয়ার সুযোগ পায় পাঁচ বছর পর একবার।
এই পাঁচ বছরে বিভিন্ন আনুষঙ্গিক কারণে ভোটারের মত পরিবর্তনের সুযোগও পায়। ভোট কিনেও নেয়া যায়। আবার স্থানীয়, আঞ্চলিক, ব্যক্তিগত ইমেজ প্রভৃতি বিষয় ফ্যাক্টর হয় জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে। এর প্রমাণ আমরা প্রতিবছরই পাচ্ছি।
যোগ্য জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে মিডিয়ারও একটা ভূমিকা থাকে।
কারণ মিডিয়া জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারে ওই প্রার্থীর একটি সুস্পষ্ট চিত্র। ঠিক একইভাবে আজ দারিদ্র্য বিমোচন, ক্ষুধা নিরসন কিংবা সমাজ নির্মাণে যে প্রত্যয় ব্যক্ত করা হচ্ছে, এর জন্যও দরকার মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করা। এমনকি আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির উন্নয়নেও দরকার সরকার ও এলাকাবাসীর ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা। একটা কথা স্পষ্ট করে বলি, কোন এলাকায় কে সংগ্রামী, কে অপরাধকর্মের সঙ্গে জড়িত, তা ওই এলাকাবাসীর অজানা থাকার কথা নয়। তারা যদি সম্মিলিতভাবে এসব অপশক্তি রোধে তৎপর হন এবং সরকারের সাহায্য চান, তবেই একটি যৌথ প্রয়াস গড়ে তোলা সম্ভব বলে মনে করি।
এ ক্ষেত্রে সরকারের পোষ্য ভাড়াটে বাহিনীর বিরুদ্ধেও গণমোর্চা গড়ে তুলে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে মানুষকেই।
মানুষ আলো চায়। এর জন্য পথ করে দিতে হবে। এই আলো সমাজ-মানবতা-জাতি বাঁচানোর আলো। একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাস্তবতার অনুকূলে কাজই তা ত্বরান্বিত করতে পারে।
২০১৩ সালটি বাংলাদেশের জন্য হবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বছর। রাজনীতি-অর্থনীতি সব ক্ষেত্রেই। তাই প্রযুক্তি ও মেধাকে কাজে লাগিয়ে সমাজ নির্মাণে প্রত্যয়ী হতে হবে নিজ নিজ ক্ষেত্র থেকে। আর এজন্য দেশপ্রেমের কোন বিকল্প নেই।
------------------------------------------------------------
দৈনিক যুগান্তর / ঢাকা / ১ জানুয়ারি ২০১৩ মঙ্গলবার প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।