১
ধর্মগড়ের প্রকৃতিতে তখনও ভোরের রেশ কাটে নি। কুয়াশার লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা শীতের মলিন দিনটিকে সদ্যজাত ভোর ভেবে পাখিরা তখনো কাকলিমুখর। মাঝে মাঝে ঘুঘুর প্রলম্বিত উদাসী ঢাক। সকালেই ঘুম ভেঙে গিয়েছিল তবু চোখে লেগে ছিল আবেশী আলস্য। গতরাতে পড়ে শেষ করা ‘উয়ারী-বটেশ্বর শেকড়ের সন্ধানে’ সিথানের পাশে পড়ে আছে।
এক বিলুপ্ত নগরী আবিষ্কার ও উৎখননের রোমহর্ষ আমাকে অধিকার করে রেখেছিল গতরাতে।
চুপি চুপি ঘড়ির কাঁটা কখন যে অনেকদূর পথ পরিভ্রমণ করেছে বুঝতে পারিনি। তখন সকাল নয়টা বেজে ছয় মিনিট। ফোনটা তখনি এলো। জানালা দিয়ে ভেসে আসা ঘুঘুর স্বর ছাপিয়ে সেলফোনের ভেতর থেকে ভেসে আসা কোকিলের মতো স্বর আমাকে সচকিত করে তোলে।
“আমি ডঃ শাহনাজ বলছি, ডিসি সাহেব আপনার ফোন নম্বর দিয়েছিলেন...”
রাত্রি জাগার ক্লান্তি কখন যে চোখ থেকে বিদায় নিয়েছে, টের পাই নি। “ডঃ শাহনাজ আপনি কোথায়...” আমি ব্যস্তসমস্ত প্রশ্ন করি। “সাইটে, এস্ক্যাভেশন চলছে...”। “এক্ষুনি রওয়ানা দিচ্ছি আমি, দেড় ঘন্টায় আপনাকে ধরতে পারবো আশাকরি...”।
মনে হয় কোন বিলুপ্ত নগরীর কথা
সেই নগরীর এক ধূসর প্রাসাদের রূপ জাগে হৃদয়ে
ভারতসমুদ্রের তীরে
কিংবা ভূমধ্যসাগরের কিনারে
অথবা টায়ার সিন্ধুর পারে
আজ নেই, কোনো এক নগরী ছিল একদিন
কোনো এক প্রাসাদ ছিল
মূল্যবান আসবাবে ভরা এক প্রাসাদ :
পারস্য গালিচা, কাশ্মীরী শাল, বেনিন তরঙ্গের নিটোল মুক্তা প্রবাল,
আমার বিলুপ্ত হৃদয়, আমার মৃত চোখ, আমার বিলীন স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষা,
... ... ...
ফাল্গুনের অন্ধকার নিয়ে আসে সেই সমুদ্রপারের কাহিনী
অপরূপ খিলান ও গম্বুজের বেদনাময় রেখা,
লুপ্ত নাশপাতির গন্ধ,
অজস্ব হরিণ ও সিংহের ছালের ধুসর পাণ্ডুলিপি,
রামধনু রঙের কাচের জানালা,
ময়ূরের পেখমের মত রঙিন পর্দায় পর্দায়
কক্ষ ও কক্ষান্তর থেকে আরো দূর কক্ষ ও কক্ষান্তরের
ক্ষণিক আভাস
আয়ুহীন স্তব্ধতা ও বিশ্বাস
(‘নগ্ন নির্জন হাত’, জীবনানন্দ দাশ)
ব্যাগপ্যাক গুছিয়ে নেই সাত তাড়াতাড়ি।
বালিয়াডাঙ্গী হয়ে ঠাকুরগাঁও চৌরাস্তা, সেখান থেকে পঞ্চগড়ের পথ ধরতে হবে। আমার গন্তব্য ভিতরগড়।
২
স্বভাবগত কারণে নাকি বিলাসবশে, জানিনা, বুদ্ধদেব গুহের ‘মাধুকরী’ উপন্যাসের ‘পৃথু’ চরিত্রটির প্রতি আমি তরুণ বয়সে এক ধরণের বিষণ্ণ-উদাস টান অনুভব করেছি। জীবনকে গুছিয়ে নিতে না পারার মাঝে জীবনের প্রতি বোধকরি একধরণের তাচ্ছিল্য নিক্ষেপের সুখ লুকিয়ে আছে, নিঃস্পৃহ প্রগলভতায় তা প্রকটিত হয়। ভিতরগড়ের লুপ্ত প্রাসাদের মাঝে আমরাও এমনই এক ইতিহাস অসমর্থিত পৃথু চরিত্রকে খুঁজে পাবো।
কিঞ্চিৎ সুযোগ পাবো তাঁর বিলীন স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষার সাথে পরিচিত হবার। তাঁর আত্মহননের দীর্ঘশ্বাস হয়তোবা আমাদের অবচেতনের খাঁজে খাঁজে বিচিত্র অনুভূতির হিল্লোল তুলে শ্রবণের আড়ালে স্তব্ধতায় স্থাণু হবে। স্থানীয় জনশ্রুতি মতে, ‘ভিতরগড়’ রাজা পৃথুর বিলুপ্ত দূর্গ-নগরী। সাধারণ্যে তাঁর পরিচিতি ছিল মহারাজা নামেই। লোকে বলে, পৃথু নাকি খুব পবিত্র নৃপতি ছিলেন।
পবিত্রতার শুভ্রবসনে ম্লেচ্ছজনের একফোঁটা কালিমা লেগে যাবার ভয়ে ছিলেন সদা তটস্থ।
আমি ততক্ষণে এসে পড়েছি পঞ্চগড় শহর পেরিয়ে আরো ষোল কিলোমিটার মতন উত্তর-পূর্বে। এখানে হাইওয়ে থেকে একটা পিচঢালা পথ পুবের দিকে বেঁকে গেছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের অমরখানা ইউনিয়ন। আরো উত্তরে ভারতের জলপাইগুড়ি জেলা।
কোন কোন নৃতাত্ত্বিক গবেষকের মতে ‘গড়’ শব্দটির ব্যবহার ‘দূর্গ’ অর্থে। সেই সূত্রে অনুমান করি ‘পঞ্চগড়’ হলো পাঁচ দূর্গের সমাহারে গড়ে ওঠা নগরী, ‘ভিতরগড়’ অভ্যন্তরীণ দুর্গ আর ‘ধর্মগড়’ নির্বিঘ্নে ধর্মচর্চা করবার জন্য গড়ে তোলা দূর্গ।
আরো কিছু পরে সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া আমাদের নজরে পড়বে। এপার বাংলা ওপার বাংলা। মানুষের অবারিত পৃথিবীকে, দিগন্ত বিস্তৃত মানবিক প্রান্তরকে টুকরো টুকরো করে কিছু মানুষ সীমান্তে প্রহরা বসিয়েছে।
গোষ্ঠির সংহতি রক্ষার কূপমণ্ডূক অন্ধ আবেগ বৈশ্বিক বন্ধনহীনতাকে বেঁধেছে নিয়মের শাসনে।
খননের শব্দ শুনি। কবর খোড়ার মত গভীর করে নয়, কবর খোড়ার মত মসৃণ করে। জনা সাতেক শ্রমিক দেখতে পাই, নিবিষ্ট মনে খুঁড়ে তুলছে অতীতের খণ্ড খণ্ড শব। কোথায় ডঃ শাহনাজ ? খুঁজে পাই না তাঁকে।
প্রযুক্তির বিকাশ মানুষকে অলসতর করে তুলে। কত কাছাকাছি এসে গেছি, তবু আমি সেল ফোনে রিং দিই। মজুরদের জটলা থেকে কোট-জিন্স-হ্যাট পড়া এক ভদ্রলোক পকেটে হাত দিয়ে বাজতে থাকা যন্ত্রটিকে বের করে এনে সাড়া দেয়। আমরা দুজনে দুজনের উপস্থিতি টের পেয়ে সৌজন্যের হাসি বিনিময় করি...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।