আল্লাহ মহান, যাহা বলিব সত্য বলিব। বিশ্বজুড়ে প্রভাবশালী ও ব্যাপক প্রচারিত গণমাধ্যমে বাংলাদেশ এখন একটি আলোচিত নাম। কয়েক বছর আগেও এসব মিডিয়ায় বাংলাদেশ নিয়ে শুধু নেতিবাচক প্রতিবেদন থাকতো। স্থান পেতো দুর্নীতি আর একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের খবর। সাম্প্রতিক বছরে সেই অবস্থা থেকে বাংলাদেশ শুধু বের হয়েই আসেনি, উচ্চারিত হচ্ছে একটি উদীয়মান শক্তিশালী দেশ হিসেবে।
ওই মিডিয়াগুলোর মতে, অব্যাহত নানা সংকট-প্রতিবন্ধকতা, বিরোধী দলগুলোর অসহযোগিতা সত্ত্বেও বাংলাদেশে উন্নয়ন-অগ্রগতির এক নীরব বিপ্লব ঘটছে। সরকার যদি বিরোধী মতের রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন ও সহযোগিতা পেতো, তাহলে এ উন্নয়ন আরও গতিশীল হতো। যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত দৈনিক পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান, সাময়িকী ইকোনোমিস্ট, বিবিসি, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমস, সাময়িকী টাইম, মধ্যপ্রাচ্যের আল-জাজিরাসহ আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশের উন্নয়নের চিত্র ফলাও করে প্রকাশ করা হচ্ছে। তবে কিছু নেতিবাচক প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে। মিডিয়া ছাড়াও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমনÑ বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে উচ্চ-আশাবাদ ব্যক্ত করেছে।
চলমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে তারা দেশের জন্য অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর বলে মনে করেন। আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদরাও বলেছেন, খুব দ্রুত বাংলাদেশের উন্নতি হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলো বলছে, রাজনৈতিক টানাপোড়েন, বারবার অগণতান্ত্রিক শক্তির হানা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামাল দিয়ে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব উন্নয়ন করে চলেছে। কয়েক বছরে উন্নয়নের নতুন এক ধারায় প্রবেশ করেছে ছোট এ দেশটি। এশিয়ার দুই বৃহৎ দেশ ও উদীয়মান পরাশক্তি বলে বিবেচিত চীন ও ভারতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
দারিদ্র্যতা হ্রাস, নারীর ক্ষমতায়ন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, ক্রীড়া ক্ষেত্রে সাফল্য ছাড়াও বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। দেশের অর্থনীতি বেশ জোড়ালো ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েছে, যে কারণে বিশ্বমন্দায়ও ক্ষতির মুখে পড়তে হয়নি। যদিও ইউরোপসহ পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ ও এশিয়ার কয়েকটি উন্নত দেশও এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিশ্বমিডিয়ায় বাংলাদেশ
দ্য গার্ডিয়ানের সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনে বাংলাদেশ নিয়ে বিশ্বনেতাদের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে। পত্রিকাটি বলেছে, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে পশ্চিমা ধনী দেশগুলোকেও ছাড়িয়ে যাবে।
এক্ষেত্রে আরও কয়েকটি দেশের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলো হলো মিসর, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, দক্ষিণ কোরিয়া, মেক্সিকো, নাইজেরিয়া ও ভিয়েতনাম। তবে তালিকার প্রথমেই রয়েছে বাংলাদেশ। গার্ডিয়ান নানা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বলেছে, দেশগুলো জনসংখ্যায় বড় বড়, আর বিপুল এই জনসংখ্যার অধিকাংশই তরুণ ও যুবক। দেশগুলো বিনিয়োগ করছে শিক্ষা ও অবকাঠামো খাতে।
তাদের প্রবৃদ্ধি যে হারে বাড়ছে, তা ঈর্ষান্বিত করে তুলেছে মন্দা ও খুঁড়িয়ে চলা অর্থনীতির পশ্চিমা দেশগুলোকে। ওই বড় বড় দেশের প্রথমটি ছোট ভূখ-ের বাংলাদেশ। অর্থনীতিবিদদের পূর্বাভাসের ভিত্তিতে গার্ডিয়ান লিখেছে, এ দেশগুলোর অর্থনীতি অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বাড়ছে এবং ২০৫০ সাল নাগাদ তাদের প্রবৃদ্ধি পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। প্রতিবেদনে বলা হয়, একসময় যে দেশগুলো তলাবিহীন ঝুড়ি বলে অভিহিত হতো, তারাই উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। ২০১৩ সালে প্রবৃদ্ধির হিসাবে এ দেশগুলোই শীর্ষ ২০টির মধ্যে থাকবে।
বাংলাদেশ সম্পর্কে গার্ডিয়ান বলেছে, দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার টেকসই ও শক্তিশালী করতে সহায়তা করছে অভিবাসীদের পাঠানো অর্থ। এক দশকের বেশি সময় আগে উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর ছোট একটি তালিকা করেন গোল্ডম্যান স্যসের জিম ও’নেইল। এতে ছিল ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীনের নাম। ইংরেজিতে নামের আদ্যাক্ষর দিয়ে তিনি দেশগুলোকে অভিহিত করেন ‘ব্রিক’ হিসেবে। পরবর্তীতে এতে যোগ হয় দক্ষিণ আফ্রিকার নাম।
তখন সংক্ষিপ্ত রূপটি দাঁড়ায় ‘ব্রিকস’। ব্রিকসের উত্তরসূরি হিসেবে ১১টি দেশের নতুন তালিকা তৈরি করেছেন ও’নেইল। প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর প্রবৃদ্ধির হার শ্লথ হয়ে আসছে। তাদের ধাওয়া করে ছুটছে এশিয়া, লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার এক সময়ের তলাবিহীন ওই ১১টি দেশ, যার তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশও। প্রাইস ওয়াটারহাউস কুপারসের (পিডব্লিউসি) প্রধান অর্থনীতিবিদ জন হকসওয়ার্থসহ অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, বাংলাদেশের উন্নতির মূলে রয়েছে সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি, মুদ্রাস্ফীতি ও বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণ, মানব মূলধন ও শিক্ষার মান উন্নয়নে বিনিয়োগ, পশ্চিমা প্রযুক্তি আমদানি ও উন্নয়নে এর সফল ব্যবহার এবং তরুণ ও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা।
যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সাময়িকী ইকোনমিস্ট লিখেছে, উন্নয়নের ক্ষেত্রে চীনের মতোই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে ইকোমিস্ট সম্প্রতি দুটি বড় প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের নানা সূচকের তথ্য তুলে ধরে সেখানে বাংলাদেশের অগ্রগতিকে বলা হয়েছেÑ বিস্ময়কর। প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়, সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলেছিলেন। যে দেশগুলো সব সময় বিদেশী সাহায্যের ওপর নির্ভর করত, সেই দেশগুলোকে কিসিঞ্জার তলাবিহীন ঝুড়ির তালিকায় ফেলেছিলেন।
বাংলাদেশও সেই তালিকায় ছিল। ব্যাপক উন্নয়ন করে ওই তালিকা থেকে বের হয়ে এসেছে দেশটি। ইকোনোমিস্ট লিখেছে, বন্যা-ঘূর্ণিঝড়ের এই দেশে তেমন খনিজ সম্পদ নেই। ১৯৪৩ ও ১৯৭৪ সালে মুখোমুখি হতে হয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন করলেও ১৯৭৫, ১৯৮২ ও ২০০৭ সালে তিন তিনবার সামরিক অভ্যুত্থান বা অরাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসে।
সঙ্গে ধারাবাহিক রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আছেই। তারপরও বিগত কয়েক বছরের চিত্র বিশ্লেষণ করলে অন্য কিছু চোখে পড়বে। ১৯৯০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ১০ বছর বেড়ে ৫৯ বছর থেকে ৬৯ হয়েছে, যা ভারতীয়দের চেয়ে চার বছর বেশি। যদিও ভারতীয়দের গড় সম্পত্তির পরিমাণ বাংলাদেশীদের চেয়ে বেশি। আশ্চর্যের বিষয়, শুধু ধনীদের নয়, গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে দরিদ্র ও হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীরও।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের দিকে তাকালেও চমকপ্রদ অর্জন চোখে পড়বে। ২০০৫ সালে ৯০ শতাংশের বেশি মেয়ে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ভর্তি হয়, যা ছেলেদের চেয়ে বেশি। ২০০০ সালে এ সংখ্যা অর্ধেক ছিল। ১৯৯০ সালে শিশুমৃত্যুর হার ছিল প্রতি হাজারে ৯৭ জন, আর ২০১০ সালে এ সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ৩৭ জনে। একই সময়ে মাতৃত্বকালীন উচ্চ মৃত্যুহার নেমে এসে প্রতি লাখে মাত্র ১৯৪ জনে দাঁড়ায়।
নারীদের গড় আয়ু পুরুষদের চেয়ে এক বছর কম ছিল। তাদের বর্তমান গড় আয়ু পুরুষদের চেয়ে দুই বছর বেশি। নব্বই শতকের শেষদিকে জাপানের মেইজি বিপ্লবের সঙ্গেই স্বাস্থ্যখাতের এমন বিস্ময়কর উন্নতির তুলনা করা যায়। উন্নতি কিন্তু শুধু মানুষের আয় বাড়ার জন্য নয়। মাথাপিছু ১৯০০ ডলার আয়ের বাংলাদেশে নব্বই দশকের পর থেকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার স্থায়ীভাবে পাঁচ শতাংশের ওপর রয়েছে।
ফলে যেখানে ২০০০ সালে দরিদ্র্যের হার ছিল ৪৯ শতাংশ, সেখানে ২০১০ সালে তা মাত্র ৩২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অভাবনীয় এই উন্নতির জন্য কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করা যায়। একটি হলো পরিবার পরিকল্পনা ও নারীর ক্ষমতায়ন। ১৯৭৫ সালে নারীর গড় সন্তান ধারণের হার ছিল ৬ দশমিক ৩ জন। ১৯৯৩ সালে এসে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৪ জনে।
বর্তমানে সন্তান ধারণের হার মাত্র ২ দশমিক ৩ জন। এই চিত্র জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য আদর্শ হারের একেবারে কাছাকাছি। ১৯৭১ সালে সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে পাকিস্তানের কাছ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের সময় দেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটির মতো; তখন পাকিস্তানের জনসংখ্যাও ছিল কাছাকাছি। বর্তমানে পাকিস্তানের জনসংখ্যা এখন ১৮ কোটি। কিন্তু বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৫ কোটি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নারীর ক্ষমতায়ন দারিদ্র্য দূর করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সরকারের চেষ্টায় নারীশিক্ষার হার বেড়েছে। একই সঙ্গে গত ২০ বছরে গার্মেন্ট শিল্পের ব্যাপক উন্নতি এবং ক্ষুদ্রঋণের কল্যাণে উপার্জনক্ষম হয়েছেন নারীরা। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর মতো কৃষি শিল্পের ধস নামেনি বাংলাদেশে, যা দেশটিকে চূড়ান্ত দারিদ্র্যের হাত থেকে রক্ষা করেছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের মেয়াদে চলতি বছর খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
২০ বছর আগেও এ দেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতো। ২০০৭ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে দেশটির উপর দিয়ে দু’বার ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে। তিন দফায় খাদ্যের দাম বেড়েছে বিশ্বব্যাপী। হয়ে গেছে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা। অনেকেই ভেবেছিলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ধস নামবে।
তেমন কিছুই হয়নি। বিস্ময়ের ব্যাপার, অর্থনৈতিক মন্দায় বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ কাবু হলেও তার কোনো ছোঁয়াই লাগেনি বাংলাদেশে। বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম মূল চালিকাশক্তি সারা বিশ্বে কর্মরত ৬০ লাখ প্রবাসী। ২০১২ সালের জুন মাসে শেষ হওয়া অর্থবছরে তারা প্রায় ১৩০০ কোটি টাকা রেমিট্যান্স পাঠান। এই অর্থ দেশের মোট আয়ের ১৪ শতাংশ।
প্রবাসীদের একটি বড় অংশের বাস বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে। তারা নিজেদের পাশাপাশি নিজেদের পরিবারকেও স্বাবলম্বী করছেন। ফলে বিদেশ থেকে আসা টাকা জমিয়ে দেশেও কৃষি কিংবা কুটির শিল্প গড়ে তুলছেন অনেকে। সারা বিশ্বে গ্রামাঞ্চলের জীবনযাত্রার মান নিম্নমুখী হয়েছে। বাংলাদেশে গ্রামীণ জীবনযাত্রার মান সবসময়ই বৃদ্ধির দিকে।
সরকারের কড়া নিয়ন্ত্রণ ও তদারকিতে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) ও ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান বরাবরই বাংলাদেশের অর্থনীতি সচল রাখতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশ থেকেই শুরু হয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম এনজিও ব্র্যাক। দেশের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ কোনো না কোনোভাবে ব্র্যাকের মাধ্যমে উপকৃত হয়েছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনীতি থেকে শুরু করে প্রতিটি খাতে অবদান রেখে ব্র্যাক বাংলাদেশের জন্য অনেকটা স্যামসাং গ্রুপের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতিতে স্যামসাংয়ের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।
এছাড়া ছোট-বড় কয়েক হাজার এনজিও অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান যোগানোর পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্ত হাতে ধরে রেখেছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিকে অত্যন্ত ইতিবাচক হিসেবে আখ্যায়িত করেছে জার্মানিভিত্তিক ডয়েচে ব্যাংকও। প্রতিষ্ঠানটি একটি গবেষণা প্রতিবেদনে জানায়, পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ৬ শতাংশ, যা মোটামুটি স্থিতিশীল। দ্বিতীয়বারের মতো মন্দায় পড়া ইউরোপসহ বড় অর্থনীতির দেশ চীন ও ভারতের অর্থনীতি নিম্নমুখী। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতি ইতিবাচক ধারায় রয়েছে।
ডয়েচে ব্যাংক মনে করে, বাংলাদেশ এশিয়ার সবচেয়ে উদীয়মান বাজার। এর প্রধান শিল্প পোশাক খাত। বাংলাদেশের রফতানি পণ্যেরÑ বিশেষ করে পোশাক শিল্পের প্রধান বাজার হলো যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপের বাজারেও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশের রফতানিযোগ্য পণ্যে পোশাকখাতের অবদান ৬৭ শতাংশ।
ব্যাংকটি বলছে, ১৫ কোটি মানুষের গণতান্ত্রিক দেশ বাংলাদেশ। বিপুল জনসংখ্যা শুধু শ্রমবাজারের জন্যই নয় বরং তা স্থানীয় ভোক্তা বাজার তৈরিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা এখন মোটামুটি স্থিতিশীল বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। তবে মূল্যস্ফীতি মাঝে মাঝে সামাজিক অস্থিরতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, রেমিট্যান্সের মধ্য দিয়ে জনসংখ্যাবহুল দেশটির প্রবৃদ্ধি জোরালো হচ্ছে।
১৯৯১ সাল থেকে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র অনুসরণ করছে বাংলাদেশ। এর নমিনাল জিডিপি ১১৪ বিলিয়ন ডলার, যা আলোচনায় আসা চারটি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। তবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের দুটি ঝুঁকি রয়েছে। তাহলো জ্বালানি সরবরাহে সীমাবদ্ধতা এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতি। সরবরাহের চেয়ে জ্বালানির চাহিদা অনেক বেশি থাকায় তা সঠিকভাবে বণ্টন করা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশে সামষ্টিক অর্থনীতি তুলনামূলক স্থিতিশীল। বিশেষ করে বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স আসায় বৈদেশিক বাণিজ্যের রিজার্ভ রয়েছে যথেষ্ট পরিমাণে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি ইতিবাচক গতিতে এগোচ্ছে। প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি আশা করা হচ্ছে প্রায় ৬ শতাংশ থাকবে। অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি বিনিয়োগ আরো বাড়লে, প্রবৃদ্ধিও বাড়বে বলে আশা করা যায়।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বা কোনো সংস্থা প্রকাশ করেনি বলে আরও একটি উল্লেখযোগ্য খবর বাংলাদেশে তেমন আলোচিত হয়নি। সেটি হলো তৈরি পোশাক রফতানি শিল্পে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে এগিয়ে গেছে। রফতানি উন্নয়ন বুুরোর (ইপিবি) এক প্রতিবেদনে এ কথা জানানো হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের রফতানি আয় গত নভেম্বর মাস পর্যন্ত এক বছরে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ (প্রায় ১৩৬ কোটি মার্কিন ডলার) বেড়েছে, যার মধ্যে ওভেন গার্মেন্টসের অংশ প্রায় ৭২ কোটি ডলার এবং নিটওয়্যার প্রায় ৬৪ কোটি ডলার। এছাড়া চলতি ২০১২-১৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে গার্মেন্টস রফতানি বেড়েছে প্রায় ১৬ শতাংশ (৬৬০ কোটি ডালার)।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, তৈরি পোশাকের অন্যতম বড় বাজার ইউরোপে অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও এ খাতে রফতানিতে বরাবরই শক্তিশালী অবস্থান বাংলাদেশের। অন্যদিকে, ভারতের অ্যাপারেল এক্সপোর্ট প্রোমোশন কাউন্সিলের (এইপিসি) তথ্যমতে, ২০১২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ভারতের পোশাক রফতানি খাতে আয় এক বছরে শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ কমেছে (প্রায় ৯১ কোটি ডলার)। এছাড়া ২০১২-১৩ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ভারতের পোশাক রফতানি আয় ৯ দশমিক ১ শতাংশ কমেছে (প্রায় ৭২০ কোটি ডলার)। এইপিসি জানিয়েছে, ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় অর্থনৈতিক মন্দা এবং বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বাজার ও গুণগত মানের কারণেই তারা পিছিয়ে পড়েছে। আরো আশার কথা হলো, চীনের ব্যবসায়ীরা তাদের গার্মেন্টস সেক্টর বাংলাদেশে স্থানান্তর করার পথে এগুচ্ছে ধীর ধীরে।
একটি উদাহরণ
মানব উন্নয়নের সামগ্রিক সূচকে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অনেক দেশের জন্যই উদাহরণ। সেই সঙ্গে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে অর্থনীতি, বাড়ছে প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, কমছে দারিদ্র্যতা। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ক্রমশ জোড়ালো হচ্ছে। অনুন্নত বা গরীব দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। স্বাধীনতার ৪১ বছরের মাথায় দারিদ্র্যের হার ৩১ দশমিক ৫০ শতাংশে নেমে এসেছে।
পাঁচ বছর আগেও এ হার ছিল ৪০ শতাংশের মতো। দারিদ্র্যতা কমার এই হার বজায় থাকলে বাংলাদেশকে পুরোপুরি দারিদ্র্যমুক্ত করতে আর মাত্র ২০-২৫ বছর লাগবে বলে মনে করেন দেশের ও বিদেশী অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশের মানুষ এখন গড়ে আগের চেয়ে বেশি দিন বাঁচছেন। মাতৃমৃত্যু হার কমেছে, ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়ার হার বেড়েছে। মেয়েরাও বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে।
ভারতের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন কিছুদিন আগে এক নিবন্ধে বলেছেন, সব সামাজিক মাপকাঠিতেই বাংলাদেশের পেছনে ভারত। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের কাজে মেয়েরা যেভাবে কাজ করছে, ভারত তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেনি।
নীরব বিপ্লব
স্বাধীনতার পর থেকে দীর্ঘ ২৫ বছর পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে চার শতাংশের বেশি বাড়েনি। এর মধ্যে ১৯৭৯-৮০ সময় পর্যন্ত গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র গড়ে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। এখন প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭ শতাংশের মতো।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ছিল চার হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার অর্থনীতি। এখন বাংলাদেশের অর্থনীতি সাত লাখ ৮৭ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকার। পাঁচ বছর আগেও মাথাপিছু জাতীয় আয় ছিল ৪৭৬ ডলার, এখন ৮৫০ ডলার। ক্রয়ক্ষমতার সমতার ভিত্তিতে (পিপিপি) বাংলাদেশ এখন ২৮৩ বিলিয়ন ডলারের বাজার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তালিকায় পিপিপির ভিত্তিতে জিডিপির হিসাবে বিশ্বের ১৮৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ৪২তম।
সত্তরের দশকে বাংলাদেশ ছিল পুরোপুরি সাহায্যনির্ভর একটি দেশ। আশির দশকের পুরোটা সময়ে তা অত্যন্ত প্রকট আকার ধারণ করে। সামরিক শাসন বাংলাদেশকে পরনির্ভর করতে ভূমিকা রেখেছে। ১৯৮১-৮২ অর্থবছরে বাংলাদেশের নেওয়া মোট বৈদেশিক ঋণ ছিল জিডিপি প্রায় ৬ শতাংশ। বিপরীতে সে সময় রপ্তানি আয় ছিল জিডিপির সাড়ে তিন শতাংশের সামান্য বেশি।
রেমিট্যান্স ছিল আরও কম, ২ শতাংশের মতো। এখন সরকারের রাজস্ব আয় ও ব্যয় লক্ষাধিক কোটি টাকা। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিস্থিতি ধীরে ধীরে পাল্টে যেতে শুরু করে। বাড়তে থাকে বাণিজ্যনির্ভতা। আওয়ামী লীগের আগের মেয়াদে বাংলাদেশ বাণিজ্যনির্ভরতার দিকে যাত্রা শুরু করে।
নানা চরাই-উৎরাই থাকলেও পরে তা আরও সুসংহত হয়। এখন বাংলাদেশের বৈদেশিক সাহায্য জিডিপির মাত্র ২ শতাংশ। অন্যদিকে রপ্তানি আয় অনেক বেড়ে হয়েছে ১৮ ও রেমিট্যান্স প্রায় ৯ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদদের মতে, অর্থনীতির চেয়েও বাংলাদেশ বেশি এগিয়েছে মানব উন্নয়নে। ইউএনডিপি ১৯৯০ সাল থেকে মানব উন্নয়ন সূচক তৈরি করছে।
তখন বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ুষ্কাল ছিল ৫৫ বছর দুই মাস। এখন গড় আয়ু ৬৮ বছর ৯ মাস। ১৯৯১ সালে কম ওজন নিয়ে জন্ম নিত ৬৬ শতাংশ শিশু। সেই হার ৪৫ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। ’৯১ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হার ছিল হাজারে ১৪৬ জন, এখন তা কমে হয়েছে ৫০ জন।
’৯১ সালে প্রতি হাজারে ৯২ জন নবজাতক মারা যেত, এখন মারা যায় ৩৯ জন। আর ’৯০-এ প্রসূতি মৃত্যুর হার ছিল প্রতি লাখে ৫৭৪ জন, এখন তা কমে হয়েছে ১৯৪ জন। শিক্ষায়ও এগিয়েছে বাংলাদেশ। সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। ২০১৫ না হলেও ২০১৭ সালে সবক’টি লক্ষ্য পূরণ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
একই সঙ্গে এই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকলে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে ২০২১ সাল পর্যন্ত লাগবে না। আর প্রবৃদ্ধিতে পশ্চিমা দেশগুলোকে ছাড়িয়ে যাওয়া যাবে ২০৩০ সালের মধ্যেই। তবে সেক্ষেত্রে হরতাল-অবরোধের মতো সহিংস কর্মসূচি পরিহার করতে হবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার পাশাপাশি সরকারের জন্য বিরোধী দলগুলোর সহযোগিতারও প্রয়োজন হবে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।