চট্টগ্রাম কারাগারের নির্জন কামরায় একাকী বসে লিখছি। আজ ২৮ নভেম্বর-২০১৩, বৃহস্পতিবার। আর মাত্র কয়েকটা দিন পর ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ইতোমধ্যে ১৫৩ জন সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন, আর বাকি ১৪৭ আসনে নির্বাচনের নামে প্রহসনের নাটক মঞ্চস্থ করার সব প্রক্রিয়া প্রায় সম্পন্ন। দেশের জনগণের আস্থা হারিয়ে সরকার একতরফাভাবে সংবিধান সংশোধন করে নিজেরা ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন দিয়ে সেই নির্বাচনে জয়লাভের উদ্দেশ্যেই এই জঘন্য অসাংবিধানিক কাজটি করতে যাচ্ছে।
ক্ষমতা কুক্ষিগত করার উদ্দেশে তারা জনমতকে পদদলিত করছে। আর সরকারের সেই নীলনকশার নির্বাচন প্রতিহত করার গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকার কারণে একই দিনে একই সময়ে একই স্থানে সংঘটিত একটি ঘটনায় আমাকে একাধিক মামলার আসামি করা হয়েছে। অভিযোগগুলো শুধু অভিনবও নয়, বরঞ্চ কাল্পনিক ও বাস্তবতাবিবর্জিত। যা হোক ইতোমধ্যে আমার চট্টেশ্বরী রোডের আবাসস্থল 'ডালিয়া কুঞ্জ' তল্লাশি শুরু হয়ে গেছে, তাই ঢাকায় যাচ্ছিলাম হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন নেওয়ার জন্য। আমার একমাত্র ছেলে ব্যারিস্টার মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দীন ফোনে ঢাকা থেকে বললেন যেহেতু 'ডালিয়া কুঞ্জ' বারবার ডিবি ও র্যাব দ্বারা তল্লাশি ও ঘেরাও করা হচ্ছে সেহেতু সরকার নিশ্চয় কোনো মামলা করেছে অথবা গ্রেফতার করে মামলায় জড়িয়ে দেবে।
রাত ৮টায় আমার এক সুহৃদ ও দলের সিনিয়র নেতা আমাকে মামলায় জড়িত করার ব্যাপারটি নিশ্চিত করে বললেন, সড়কপথে ঢাকা যাওয়া যাবে না। অতএব বিমানের শেষ ফ্লাইটে ঢাকায় যাওয়াটা নিরাপদ। একটা মাইক্রোবাসে করে চট্টগ্রাম হজরত শাহ আমানত বিমানবন্দর অভিমুখে যাত্রা শুরু করলাম। ভাবছিলাম ১৯৯৬-২০০১ সালে আওয়ামী সরকার আমার বিরুদ্ধে ৫৭টি গাড়ি ভাঙচুর, বোমা ফাটানো ও অগি্নসংযোগ করার হাস্যকর মামলা চাপিয়ে দিয়েছিল। এমন কি আমার রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি আমার প্রিয়তমা সহধর্মিণী মরহুমা ডালিয়া নাজনীনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিল।
শুধু তাই নয়, চট্টগ্রামের তৎকালীন মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী আমার বাসভবনের ফটকে কয়েক ট্রাক ময়লা-আবর্জনা ফেলে আমাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে একটি ন্যক্কারজনক ঘটনা হিসেবে প্রচার মাধ্যমগুলোতে উপস্থাপিত হয়েছিল। সে সময় এতগুলো মামলা হলেও পুলিশ বা ডিবি এভাবে উগ্র হয়ে খুঁজে বেড়ায়নি বা তল্লাশির নামে হয়রানি করেনি। নিজের মতো করে জেলা জজ আদালত এবং হাইকোর্টে গিয়ে স্বেচ্ছায় আত্দসমর্পণ করে জামিন নিয়েছি। ওই সময় মহামান্য আদালতে আত্দসমর্পণ করে জামিনের জন্য প্রার্থনা করলে আদালত সরকার পক্ষের আইনজীবীকে উদ্দেশ করে বলেন, 'এটা কি বিশ্বাসযোগ্য যে, মীর নাছির সাহেব গাড়িতে অগি্নসংযোগ ও বোমা মারবেন, আপনাদের মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী তো তার বাসার ফটকে কয়েক ট্রাক দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা ফেলে তাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। এ কোন ধরনের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা বাড়ির বাইরে যেতে পারছেন না', ময়লা দ্বারা অবরুদ্ধ এ কোন রাজনীতি? আর হাইকোর্টে একটি মামলায় ব্যারিস্টার মওদুদ সাহেব যখন আমার এবং আমার প্রিয়তমা সহধর্মিণী ডালিয়া নাজনীনকে আত্দসমর্পণ করে জামিনের জন্য আবেদন করেছেন, তখন মহামান্য বিচারপতিরা ওপেন কোর্টে রাষ্ট্রপক্ষকে এই বলে ধিক্কার দিয়েছিলেন যে, 'মীর নাছিরকে আপনারা রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করার জন্য মামলার আসামি করেছেন বুঝলাম কিন্তু বেগম মীর নাছির কী অপরাধ করেন, লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যাওয়া উচিত সরকার পক্ষের।
যাক সেই দিনগুলোর স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে পেঁৗছলাম, বিমানে উঠব ঢাকায় যাওয়ার জন্য। সে সময় এক অভিনব কায়দায় আমাকে গ্রেফতার করা হলো। চোখের পলকে দেখলাম গ্রেফতারের জন্য বিশাল পুলিশ বাহিনী, ডিবি, র্যাব আমাকে ওদের গাড়িতে নিয়ে শহর অভিমুখে রওনা দিল। গন্তব্যস্থল বুঝতে পারলাম কোতোয়ালি থানা হাজতে। আমি তাদের গাড়িতে বসে বসে ভাবছিলাম ওয়ান-ইলেভেনের সময় গ্রেফতারের দুঃস্বপ্নগুলো।
গাড়িতে পুলিশের ওয়াকিটকিতে শুনতে পাচ্ছিলাম আমার গ্রেফতারের খবর শুনে রাস্তায় রাস্তায় সাধারণ মানুষের মিছিল শুরু হয়ে গেছে। আমাকে নিয়ে নিরাপদে কোন রুটে কোতোয়ালি থানায় যাওয়া যায় তার নির্দেশনা চাওয়া হচ্ছে।
গাড়ি শহর অভিমুখে দ্রুতগতিতে চলছে। আর মোড়ে মোড়ে সর্বস্তরের মানুষ ও দলীয় নেতা-কর্মী গগণবিদারী প্রতিবাদ স্লোগানে মুখরিত। ওয়াকিটকির মাধ্যমে শুনতে পেলাম কোতোয়ালি থানার সামনে জনতার সমাবেশ হয়েছে এবং নিরাপদে আমার গাড়ি থানায় ঢোকার ব্যবস্থা করেছেন বলে অপর প্রান্ত হতে আশ্বস্ত করা হচ্ছে গাড়িতে বসা পুলিশ কর্মকর্তাদের।
থানায় পেঁৗছার পর অনেক বেগ পেতে হয়েছে পুলিশ বাহিনীর। আমাকে এক পলক দেখার জন্য আমার রাজনৈতিক সহকর্মীরা পাগলের মতো হুমড়ি খেয়ে পড়ছে গাড়ির ওপর। আমাকে থানার দোতলা বা তিন তলার একটা কামরায় নিয়ে রাখা হলো। ইতোমধ্যে সারা নগরীতে খণ্ড খণ্ড মিছিল বের করেছে ১৮ দলের নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা। পরদিন অর্থাৎ ২৯ নভেম্বর চট্টগ্রাম আদালতে হাজির করা হলো।
আদালত প্রাঙ্গণ লোকেলোকারণ্য। এ যেন সহকর্মীদের এক অবিশ্বাস্য বিরল সহানুভূতি। এদিকে আমার ছেলে ব্যারিস্টার হেলাল ঢাকা থেকে এসে চট্টগ্রাম আদালতে তার বাবার জামিনের জন্য অন্য বিজ্ঞ আইনজীবীদের সঙ্গে লড়ছেন। সে মুহূর্তের অনুভূতিটা বর্ণনাতীত। আমার ছেলে শুধু বলল, 'বাবা চিন্তা করবেন না, আপনার মেয়ে ব্যারিস্টার ইশরাত আপনার গ্রেফতারের খবর পেয়ে আসতে চাচ্ছে এবং ও ভালো আছে।
' যাক আল্লাহতায়ালার কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম। অন্ততপক্ষে এবার আমার ছেলে তো ইনশাল্লাহ চট্টগ্রামেই আছে এবং বলল আপনার কলিজার টুকরা নাতিরা- হামজা, ডানিয়াল, হামদান, নওশীনসহ (আমার ছেলের বউ) রাতেই ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম এসেছে। খুবই প্রশান্তি পেলাম। সারা দেশে বিএনপির সিনিয়র নেতাসহ ১৮ দলীয় নেতাদের গণগ্রেফতার শুরু হয়ে গেছে। লক্ষ্য একটাই ৫ জানুয়ারি পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের অর্থাৎ আওয়ামী লীগের নিজের মতো করে সরকার গঠন করা।
চট্টগ্রাম কারাগারেও ঠাঁই নেই ১৮ দলীয় নেতাদের গ্রেফতারের কারণে। সারা দেশে তাণ্ডব চালিয়ে সাংবিধানিক ধারাকে অব্যাহত রাখার নামে নির্দলীয় কাউকে ক্ষমতায় না দেওয়া, নিয়ম রক্ষার নামে জনমতকে উপেক্ষা করে তথাকথিত সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নাটক মঞ্চস্থ করা হলো। যে নির্বাচন জন্ম দিল একটি অগ্রহণযোগ্য সংসদ ও সরকার। এই নির্বাচনে ৪০টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে মাত্র ১৫টি, যার একটি বাদে সবই ক্ষমতাসীন জোটের অন্তর্ভুক্ত। সরকারি ঘোষণা মতে ৩৯ ভাগ ভোটার ভোট দিয়েছে, বাস্তবে ৫ ভাগের বেশি ভোটার ভোটকেন্দ্রে যায়নি।
অথচ ২০০৮ সালের নির্বাচনেও ৮৫ ভাগ ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে। হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে গণগ্রেফতার, খুন, গুম করার পর শত চেষ্টা করেও ৫ জানুয়ারির নির্বাচন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। ৫ জানুয়ারির তথাকথিত গণতন্ত্রের নামে সার্কাসতন্ত্রের নির্বাচনে সরকারি দল, দেশের প্রধানমন্ত্রী একটি বেআইনি সংসদের নেতা হয়ে বলতে শুরু করলেন, 'বিএনপিকে জামায়াত ছেড়ে আসতে হবে আলোচনার জন্য এবং জঙ্গিবাদের সঙ্গ ছাড়তে হবে। সরকারি দলের জানার কথা বর্তমান বিএনপির পুনর্জন্ম একটি বিশাল রাজনৈতিক দল হিসেবে। এ দেশের মাটিতে বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি জনগণের স্বীকৃতি লাভ করেছে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয় বছরের রাজপথ কাঁপানো কঠিন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।
বিএনপি কারও ডিকটেশনে এ দেশে রাজনীতি করে না, বিএনপি কোনো স্বৈরশাসকের সঙ্গে অাঁতাত করে রাজনীতি করেনি। যারা আজকে জামায়াতকে বাদ দেওয়ার কথা বলছেন এই আওয়ামী লীগই ২১ বছর পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয়েছিল জামায়াতের সহযোগিতায়। জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন করে ১৯৯৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমেই নির্বাচন করে ক্ষমতায় এসেছিল। সঙ্গে ছিল জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের সর্বজনস্বীকৃত অাঁতাত।
শাসক দল যখন জামায়াতকে বিএনপির সঙ্গে দেখে তখন বেমালুম ভুলে যায় যে, বিগত নির্বাচনী সমাবেশে কুষ্টিয়ায় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ জেলা জামায়াতের রোকন ও জামায়াতের শ্রমিক ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি এবং পরিবহন মালিক সমিতির নেতা নওশর আলীকে আওয়ামী লীগে যোগদান করিয়েছেন ফুলের মালা দিয়ে।
এখানেই ক্ষান্ত হয়নি, বিগত আগস্ট মাসের ২৫ তারিখে শরীয়তপুর পৌর শিবিরের সভাপতি এবং জামায়াতের সক্রিয় কর্মী বিএম ইউছুফ আলী আওয়ামী লীগের আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হকের হাত ধরে শোক দিবসের অনুষ্ঠানে যোগদান করে আওয়ামী লীগের শোকসভাকে সমৃদ্ধ করেছিল। সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর নামে একনায়কতন্ত্রের যে নব্য অধ্যায় শুরু হয়েছে তার ইতি টানতে হলো ১৫তম সংশোধনীকে বাতিল করতেই হবে, নইলে যে দল সরকারে থাকবে সে দলই ক্ষমতায় আসবে জনগণের রায়কে পদদলিত করে।
যেখানে সংবিধানে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে যে, সংসদ নির্বাচন জনগণের ইচ্ছা ও রায়ের প্রতিফলন ঘটায় না তা বৈধ সংসদ হয় না। 'ঊষবপঃরড়হ ঃযধঃ ৎবভষবপঃং ঢ়বড়ঢ়ষবং রিষষ' এবং যে নির্বাচনে জনগণের রায় প্রতিফলন হয় সেই রায়ের মাধ্যমেই গঠিত সংসদ হচ্ছে জনগণের বৈধ সংসদ। দশম সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রের কবলে বাংলাদেশ আজ নিমজ্জিত।
সরকারি দলের নেতারা এখন অতি উৎসাহী হয়ে বলছেন, উনারা পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। অতএব পাঁচ বছর উনারা ক্ষমতায় থাকবেন। যে নির্বাচনে জনগণের কোনো অংশগ্রহণ নেই, যে নির্বাচনে কোনো ধরনের নৈতিক ভিত্তি নেই, সে নির্বাচনকে নিয়েই তাদের গলাবাজি নিজেদের দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ।
আমাদের সরকারি দলের নেতাদের কথা বার্তায় মনে হয় তারা রোমান সম্রাটের মতো সর্বশক্তিমান, চেঙ্গিস খাঁর মতো তারা কাউকে পরোয়া করে না। আর তাই এক অভিনব কাঠামোর মধ্য দিয়ে তারা সরকার পরিচালনা করছে যেখানে বিরোধী দল বার্গেনিং করে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করে, হায়রে লজ্জা।
এ লজ্জা রাখি কোথায়। এ লেখা লিখতে বারবার আমার স্মৃতিপটে ভাসছে বন্ধুবর ওবায়দুল কাদের ও মো. নাসিমের অত্যন্ত মূল্যবান রাজনৈতিক বিশ্লেষণের কথা। ওয়ান ইলেভেনের পর কারাগারে বিকালে হাঁটার সময় এবং অন্য সময়ের আলাপচারিতায় মেধাবী রাজনীতিবিদ বন্ধুবর ওবায়দুল কাদের আগামী দিনের রাজনীতি নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী যে রূপরেখা তুলে ধরতেন আমরা তা নিয়ে সবাই আলাপ করতাম। আজ তারা তাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মোহে সেই অনুভূতিটার দাফন কার্য সমাপ্ত করে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ, এমকে আনোয়ার, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, অ্যাডভোকেট খোন্দকার মাহবুব হোসেনসহ অসংখ্য জাতীয় নেতাকে যেভাবে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নিক্ষিপ্ত করেছেন তাতে স্পষ্ট হয় মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র তথা রক্তে কেনা গণতন্ত্র আজ স্বৈরতন্ত্রের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত। গণতন্ত্র যেন বন্দী কারাগারের নির্জন কক্ষে।
আওয়ামী লীগ আর গণতন্ত্র যে একসঙ্গে চলে না, ইতিহাস বার বার তার সাক্ষ্য দেয়। ১৯৭৩ এর নির্বাচন এবং বিগত নির্বাচনের মধ্যে তেমন কোনো ফারাক নেই, সরকার তাদের ক্ষমতা দেখিয়ে দিয়েছে, ভোটারবিহীন নির্বাচনের নাটক মঞ্চস্থ করেছে আর জনগণ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে তাদের ক্ষমতা সরকার ও বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছে। ১/১১ এর সময় আমরা সবাই কারাগারে একমত হয়েছিলাম যে সবাই বের হয়েই জাতীয় ইস্যুগুলোতে ঐকমত্যের ভিত্তিতে কাজ করব। যা ছিল আমাদের কারাগারেরই শপথ। কোথায় আজকে সেই শপথ।
সেদিন কারাগারে খবর পেলাম দুই নেত্রীকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবেন। এর পরপরই আজকের প্রধানমন্ত্রী বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন আর বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন দেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই, এদেশই হচ্ছে আমার শেষ ঠিকানা। এখানে মাননীয় হাইকোর্টের একজন বিচারপতির মন্তব্য অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, এক নেত্রী বিদেশে ঘুরবেন আর এক নেত্রী জেলে থাকবেন এটা কোন নীতি।
ওবায়েদ ভাই আপনাকে বিব্রত করতে চাই না।
তবে সেদিনের সেই ইস্যুতে আপনার চিন্তা-চেতনা, অনুভূতি ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকে আমি সারাজীবন স্যালুট করব আর স্যালুট করব খানদানি রাজনীতিবিদ বিশাল হৃদয়ের নাসিম ভাইকে। আর আজ যখন টেলিভিশনে নাসিম ভাই ও ওবায়দুল ভাইয়ের বক্তব্য শুনি ভাবতে খুব কষ্ট লাগে, তবে কি উনারাই ওয়ান ইলেভেনের সময় কারাগারে ছিলেন? উনাদের সেদিনের অনুভূতি, চিন্তা-চেতনা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আজ কোথায় হারিয়ে গেল? মনকে প্রবোধ দেওয়ার জন্য বলি, আমি যেভাবে কর্মীদের নিয়ে জনসভায় বক্তৃতা করি কিংবা টকশোতে হাসিমুখে আলোচনা করি আসলে এটাই কী আমার আসল চেহারা? যে হৃদয়ে প্রতিনিয়ত রক্তক্ষরণ হচ্ছে আপনজন হারানোর বেদনায় তা যে কত প্রচণ্ড লিখে প্রকাশ করা যায় না। সে বেদনা কর্মী কিংবা দর্শকদের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখে একান্ত নীরবে চোখের পানি ফেলে মনকে কিছুটা হালকা করি, যা চলবে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। আমার মনে হয় আমার নাসিম ভাই ও ওবায়দুল কাদের ভাই তাদের হৃদয়ে আসল অনুভূতিগুলো লুকিয়ে রেখেছেন আগামী সুন্দর গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য। জনগণের গণতন্ত্রের ট্রেনের যাত্রী হওয়ার আশায়।
আর ১৫ তম সংশোধনীকে চতুর্থ সংশোধনীর নব সংস্করণের মধ্য দিয়ে দেশকে আবার একদলীয় সরকারের দিকে নিয়ে যাওয়ার যে প্রস্তুতি তারা সমাপ্ত করেছে তার বিরুদ্ধে উত্তাল গণআন্দোলনে গণতন্ত্রকামী মানুষের নেতা হিসেবে কেউ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করবে না, আওয়ামী লীগ নেতারা যতই না নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে উল্লাসিত হয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে অতিকথন চালিয়ে যাচ্ছেন, আসলে জনগণের রুদ্রমূর্তির ভয় সবার কাছে বিদ্যমান।
পাদটিকা : এক লোক রেলওয়েতে চাকরি করতেন। একদিন তার ভাইপো বিদেশ থেকে এসে চাচাকে বলল, চাচা আপনার কী কী ক্ষমতা আছে? চাচা বললেন, জান আমি যে কোনো মুহূর্তে একটি চলন্ত ট্রেনকে বন্ধ করে দিতে পারি। ভাইপো বলল, তাহলে দেখতে চাই আপনার ক্ষমতা। চাচা হচ্ছে রেলওয়ের লাইনম্যান, ট্রেন যখন আসছিল তখন চাচার হাতে থাকা লাল পতাকা দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে ট্রেন বন্ধ হয়ে গেল।
সবাই হতচকিত হয়ে গেল কী হলো, ট্রেন থেকে গার্ড নেমে এসে তারা চাচাকে ট্রেন থামানোর কারণ জিজ্ঞাসা করায় উনি ওই ক্ষমতা দেখানোর কথা বলতেই গার্ড তার গালে জোরে এক থাপ্পড় মারল এবং ট্রেন চালু করে দিল। তখন ভাইপো জিজ্ঞাসা করল, চাচা এটা কী হলো? চাচা বললেন, আমি আমার ক্ষমতা দেখিয়েছি আর উনি উনার ক্ষমতা দেখিয়ে দিলেন। তাই যখন সময় আসবে ট্রেনভর্তি যাত্রীরা তাদের গণতন্ত্রের অভীষ্ট লক্ষ্যে পেঁৗছবেই। আর গণতন্ত্রবিরোধী ক্ষমতালোভীরা ছিটকে পড়বে রাজনীতির অাঁস্তাকুড়ে, ইতিহাস তাই বলে।
লেখক : সাবেক কূটনীতিক, আইনজীবী ও মন্ত্রী।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।