এই ফটকাবাজির দেশে স্বপ্নের পাখিগুলো বেঁচে নেই ...
সাম্প্রতিক সময়ের উত্তরণ থ্রিজি তথা তৃতীয় প্রজন্মের ইন্টারনেট। কিছুদিন আগে একটু চমকে গেলাম থ্রিজি নিয়ে একটি বিজ্ঞাপন দেখে। যেখানে দেখানো হচ্ছে থ্রিজি ব্যবহার করে বাবা-মায়ের সাথে মিথ্যে বলছে আর রাতে পার্টি করছে দূরে পড়তে আসা এক ছাত্র। বিজ্ঞাপনটি সম্ভবত নিষিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হল আমাদের চারদিকের পরিবেশকে যা প্রতিনিধিত্ব করে না, একটা পণ্যের সত্যিকারের উপকারী দিক যা তুলে ধরে না, যা নেতিবাচক একটা বার্তা পৌঁছে দেয়-এমন বিজ্ঞাপন কেন তৈরি হচ্ছে দেশে সাম্প্রতিক সময়ে? যেকোন পণ্যের ভোক্তার বিশাল একটি অংশ তরুণেরাই।
সেকারণেই তারুণ্যনির্ভর ও তরুণদের লক্ষ্য করে আজকাল বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস’া বিজ্ঞাপন নির্মাণ করছে। অবশ্যই একটা সৃজনশীল চিন্তা। কিন’ তারুণ্যের নেতিবাচক দিকগুলোকে কেন অধিকাংশ বিজ্ঞাপনে তুলে ধরা হচ্ছে?
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য আর অস্ট্রেলিয়ার মত দেশগুলো যখন ফোর জি প্রযুক্তিতে প্রবেশ করেছে সেই সময়ে আমরা একটু দেরিতে হলেও থ্রিজি প্রযুক্তিতে প্রবেশ করেছি। থ্রিজি প্রযুক্তির কারণে খুব দ্রুত যেকোন তথ্য মোবাইল বা কম্পিউটার ব্যবহার করে পাওয়া যাবে।
একজন ব্যাংকার যেকোন জায়গায় বসে মুঠোফোন থেকেই লেনদেন করতে পারবেন, একজন শিক্ষক ক্লাসে প্রবেশের আগে জেনে নিতে পারবে গতকাল কি সাম্প্রতিক তথ্য যুক্ত হয়েছে ক্লাসের পাঠ্যসূচির সাথে প্রাসঙ্গিক, একজন বিজ্ঞানী মুঠোফোন থেকেই খুব স্পষ্ট দেখতে পারবেন যেকোনো গবেষণা পদ্ধতির ভিডিও, একজন প্রকৌশলের ছাত্র খুব দ্রুত পেয়ে যাবে আন্তর্জাতিক বৃত্তির খবর, একজন ব্যবসায় প্রশাসনের ছাত্র যেকোন জায়গায় বসেই ১৫মিনিটে আবেদন করতে পারবে বিদেশে যেকোন চাকরির, একজন চলচ্চিত্র বা নাটক নির্মাতা গাড়িতে বা বাসে বসেই খুব উন্নত মানের ভিডিও তে দেখতে পারবেন তার স্মার্টফোন থেকে বিদেশের যেকোন কালজয়ী নাটক বা চলচ্চিত্র।
এত এত গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও কেন একটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটকেই বিজ্ঞাপনে তুলে ধরা হচ্ছে? ভয় হয়, এসব দেখে ভুল ধারণা নিয়ে, নব্বই দশকে সাবমেরিন কেবল না নেয়ার মত থ্রিজিও ব্যবহার না করার আবার সিদ্ধান্ত হয়ে যায় কিনা।
থ্রিজি ব্যবহার করবে সেই তরুণটি যে দিনশেষে অনেকগুলো টিউশন করে ছাত্র পড়িয়ে ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে ছাত্রাবাস বা মেসে ফিরে আসে, সেই মেয়েটি যে কোচিং এ পড়িয়ে ট্রাফিক জ্যামে আটকে ছিল এক ঘণ্টা। টিএসসি মোড়ে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাওয়া সেই দুজন বন্ধু আর টং এর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আড্ডা দেয়া খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির সেই ছেলেটা, সন্ধ্যেবেলা মায়ের সাথে খুনসুটি করা মেয়েটা। এরাই বাংলাদেশের আশিভাগ তরুণকে প্রতিনিধিত্ব করে। রাতের বেলা পার্টি করে মিথ্যে বলা তরুণ তরুণীরা কখনই বাংলাদেশের তারুণ্যকে প্রতিনিধিত্ব করে না।
একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমরা আসলে বিজ্ঞাপন থেকে কি প্রত্যাশা করি? পুঁজিবাদের দ্রুতবেগে ধাবমান ঘোড়াটি তার অশ্বমেধ সহকারে পদচিহ্ন যেখানেই ফেলেছে সেখানেই তৈরি হয়েছে নতুন ভোক্তাশ্রেণি, তাই আমরা কখনই অস্বীকার করতে পারব না আজকের বিশ্বের প্রেক্ষিতে বিজ্ঞাপনকে। আমরা কখনই চাই না বিজ্ঞাপন ভুল মেসেজ বা বৈষম্য সৃষ্টি করে এমন কোন তথ্য বা মন্তব্য করবে।
একজন মেয়ের গায়ের রঙ কৃষ্ণবর্ণ হলে চাকরি হবে না -আসলেই কি এটা যোগ্যতার মাপকাঠি? মুঠোফোন বেশি ব্যবহার করার উদ্দেশ্য হচ্ছে বেশি বেশি প্রেম করা-তাহলে কি মুঠোফোনের আর কোন ব্যবহার নেই? ছোট্ট একটি ছাত্র শিক্ষকের সাথে মিথ্যে বলে বাইরে গিয়ে খাওয়ার জন্য দাঁড়াল-সত্য কথা বলার চাইতে খাওয়াটাই কি বেশি গুরুত্বপূর্ণ এর কোনটাই কাম্য ছিল না।
ফ্রি অফারের নামে এমন সব অফার দেয়া হবে কেন যা স্বাভাবিক জীবনযাপনের উল্টো? একারণেই শঙ্খ ঘোষ হয়ত বিদ্রূপ করে বলেছিলেন-মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে। দিনের একটা অস্বাভাবিক সময়ে অস্বাভাবিক কলরেটে কথা বলে তরুণ প্রজন্মের জীবনযাপন পাল্টে দেয়ার প্রচেষ্টার মাঝে আসলে আদৌ কোন উপকার হবে সমাজের? অন্তত পাশ্চাত্যের কোন দেশে এরকম অস্বাভাবিক ফ্রি অফার দেয়ার নজির দেখিনি।
বিজ্ঞাপন আমাদেরকে আসল প্রয়োজনীয় দিকটা তুলে ধরতে পারে।
বিজ্ঞাপন আমাদের ঐতিহ্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে জীবনের কথা বলবে। পণ্যের উপস’াপন হবে আমাদেরকে পজিটিভ বা ইতিবাচক কোন মেসেজ দিয়ে যা সেই পণ্যটিকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলে।
প্রশ্ন আসতে পারে, কেন আমরা বিজ্ঞাপন নিয়ে কথা বলছি? বিজ্ঞাপন নিয়ে ভাবার জায়গাটা কোথায়? বিজ্ঞাপন নিয়ে এজন্যই ভাবতে হবে কারণ একটি বিজ্ঞাপন একটি ধারণার নেতৃত্ব দেয়। যেমনটা মিশেল ফুকোর মত করে বললে- প্রত্যেকটি সত্তাই একেকটি নেতা।
এই নেতৃত্বকে কেন্দ্র করে তৈরি হয় ক্ষমতার বলয়, যা আকৃষ্ট করে কোটি কোটি ভোক্তাকে। সমাজে একজন জনপ্রিয় মডেলের প্রভাব দেখলেই সেটা বোঝা যায়। একজন মডেল একটি স্টাইল প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিচ্ছে, একজন বিজ্ঞাপন নির্মাতা একটি ধারণা সবার মনে গেঁথে দেয়ার নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
বিজ্ঞাপন এতটাই শক্তিশালী যে, একটি বিজ্ঞাপন দেখেই গানের প্রতিযোগিতার অডিশনে জমায়েত হয় লক্ষাধিক লোকের, একটি প্রজন্মের পুরো কথা বলার ভাষাই পরিবর্তন করে দিতে পারে কেবলমাত্র একটি ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন, শুধুমাত্র বিজ্ঞাপন দেখেই কোন প্রতিষ্ঠান তৈরির জন্য উঠে আসে লক্ষ লক্ষ টাকা। একারণেই বিজ্ঞাপন একটি হাতিয়ার।
একটি বিজ্ঞাপন একটি প্রজন্মের এবং একটি জাতির রুচিবোধকে প্রতিনিধিত্ব করে এবং অনেক সময় রুচিবোধের জায়গাটি তৈরি করে কিংবা বদলে দিতে পারে।
বিজ্ঞাপন হোক সবার জন্য। বিজ্ঞাপন কথা বলবে সত্যিকারের বাংলাদেশের, বাস্তবিক তারুণ্যের আর পণ্যের কার্যকর গুণাগুণের। বিজ্ঞাপন ধারণ করুক আমাদের শত বছরের ঐতিহ্যকে, যেন কখনই পথ হারাতে না হয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।