আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও বঙ্গবন্ধু

প্রতি বছর ২৩ ফেব্রুয়ারি দিনটি আমি গভীরভাবে স্মরণ করি। এ দিনটি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। ১৯৬৯-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি ইতিহাসের মহামানব, বাংলার মুকুটহীন সম্রাট জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পক্ষ থেকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। প্রিয় নেতা তার যৌবনের চৌদ্দটি মূল্যবান বছর পাকিস্তানের কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছিলেন। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলেন, সে নেতাকেই সেদিন জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞচিত্তে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেছিলাম।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয়নি। একদিন বাঙালিকে বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা হতে হবে। সেই লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করে ১৯৪৯-এর ২৩ জুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তারপর সংগ্রামের সুদীর্ঘ পথে নেতৃত্ব দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সংগঠিত করার মধ্য দিয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন।

আমাদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে ১৯৬৮-'৬৯ এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।

কারণ ওই কালপর্বটি ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের 'ড্রেস রিহার্সেল'। বাঙালি জাতির মুক্তিসনদ ছয়দফা দেওয়ার অপরাধে বঙ্গবন্ধু মুজিবসহ মোট ৩৫ জনকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি করে তাদের ফাঁসি দেওয়ার লক্ষ্যে এবং নির্বিঘ্নে পুনরায় ক্ষমতায় আরোহণের এক ঘৃণ্য মনোবাসনা চরিতার্থে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে আইয়ুব খান এগোচ্ছিল। আগরতলা মামলার বিচার যখন শুরু হয় তখন আমরা উপলব্ধি করি, বঙ্গবন্ধুকে যদি ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলানো হয় তাহলে চিরদিনের জন্য বাঙালি জাতির কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে যাবে। তাই আমরা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে ১৯৬৯-এর ৫ জানুয়ারি ১১ দফা কর্মসূচি জাতির সামনে পেশ করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে 'ডাকসু' কার্যালয়ে আমার সভাপতিত্বে এবং চার ছাত্র সংগঠনের নেতাদের উপস্থিতিতে এক সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম 'কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ' গঠন এবং ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি ১১ দফা ঘোষণা করা হয়।

৮ জানুয়ারি সম্মিলিত বিরোধী দল সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আটটি বিরোধী দলের ঐক্যফ্রন্ট কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে আট দফাভিত্তিক এক ঘোষণাপত্র প্রকাশ করে। ৯ জানুয়ারি দেশের আটটি বিরোধী রাজনৈতিক দলের ঐক্যের ভিত্তিতে উবসড়পৎধঃরপ অপঃরড়হ ঈড়সসরঃঃবব সংক্ষেপে 'ডাক' গঠন করে। ১২ জানুয়ারি ডাক প্রাদেশিক সমন্বয় কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। আট দফা দাবির ভিত্তিতে ১৭ জানুয়ারি 'দাবি দিবস' পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৭ জানুয়ারি বায়তুল মোকাররমে ডাক-এর আর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জমায়েত অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের বটতলায় এবং পূর্ব ঘোষিত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হয়।

সেদিনের ব্যাপক পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে ১৮ জানুয়ারি শনিবার ঢাকা শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। সকালে বটতলায় ছাত্র জমায়েতের পর খণ্ড খণ্ড মিছিল এবং সহস্র কণ্ঠের উচ্চারণ_ 'শেখ মুজিবের মুক্তি চাই, আইয়ুব খানের পতন চাই। ' সন্ধ্যায় জিন্নাহ হলে (বর্তমানে সূর্যসেন হল) ইপিআর কর্তৃক ছাত্রদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জ। ১৯ জানুয়ারি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল, পুলিশের বাধা ও গুলিবর্ষণ। ২০ জানুয়ারি ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের মাইলফলক।

এদিন ১১ দফার দাবিতে ঢাকাসহ প্রদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। মিছিলে পুলিশের গুলিতে আসাদের মৃত্যু হয়। শহীদ মিনারের সামনে অনুষ্ঠিত শোকসভায় আমার সংক্ষিপ্ত বক্তৃতার পর আসাদের রক্ত ছুঁয়ে আমরা শপথ গ্রহণ করি। ২১ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে শহীদ আসাদের গায়েবানা জানাজা শেষে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে আমি তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করি : ২২ জানুয়ারি শোক মিছিল, কালো ব্যাজ ধারণ, কালো পতাকা উত্তোলন; ২৩ জানুয়ারি সন্ধ্যায় মশাল মিছিল, পরে কালো পতাকাসহ শোক মিছিল; ২৪ জানুয়ারি বেলা ২টা পর্যন্ত হরতাল। ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে জানাজার পরে লাখো মানুষের মিছিল।

২২ জানুয়ারি ঢাকায় সব বাড়ি আর গাড়িতে কালো পতাকা আর প্রতিটি মানুষের বুকে কালো ব্যাজ। ২৩ জানুয়ারি ঢাকা শহর মশাল আর মিছিলের নগরী। ইতিহাসের বৃহত্তম মশাল মিছিল। ২৪ জানুয়ারি হরতাল। ছাত্র-গণমিছিলে গুলিতে ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউটের নবম শ্রেণীর ছাত্র মতিউর রহমানের মৃত্যু।

'দৈনিক পাকিস্তান', 'মর্নিং নিউজ' এবং 'পয়গাম' পত্রিকা অফিসে আগুন। শহীদদের তালিকায় যুক্ত হয় আনোয়ার, রুস্তম, মিলন, আলমগীরসহ আরও অনেক নাম। দুপুরে জানাজা অনুষ্ঠিত হয় পল্টন ময়দানে। আমার বক্তৃতার পর সেখান থেকে মিছিল জমায়েত হয় ইকবাল হলের (বর্তমানে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) মাঠে। সান্ধ্য আইন অমান্য করে রাজপথে লাখো মানুষের ঢল নামে।

গণবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয় গণঅভ্যুত্থান। ২৫, ২৬ ও ২৭ জানুয়ারি সান্ধ্য আইন বলবৎ থাকে। ২৭ জানুয়ারি ঢাকায় গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে পশ্চিম পাকিস্তানে গণবিক্ষোভ। ১ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খানের বেতার ভাষণ। বিরোধী দল এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রত্যাখ্যান।

৬ ফেব্রুয়ারি আইয়ুবের পূর্ব পাকিস্তান সফর। সংবাদ সম্মেলনে দেশরক্ষা আইন ও অর্ডিন্যান্সের প্রয়োগ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত ঘোষণা। ৮ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাক-এর ছাপাখানা নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেসের ওপর থেকে বাজেয়াপ্ত আদেশ এবং দৈনিক ইত্তেফাকের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার। ৯ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পল্টন ময়দানে 'শপথ দিবস' পালন। পরিষদের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র হিসেবে আমার সভাপতিত্বে পল্টন ময়দানে এক বিশাল সমাবেশে ১০ জন ছাত্রনেতা জীবনের বিনিময়ে ১১ দফা দাবি প্রতিষ্ঠা করার সংকল্প ঘোষণা করেন এবং শেখ মুজিবসহ সব রাজবন্দীর নিঃশর্ত মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখার শপথ গ্রহণ করেন।

এই দিন স্লোগান ওঠে_ 'শপথ নিলাম শপথ নিলাম মুজিব তোমায় মুক্ত করব, শপথ নিলাম শপথ নিলাম মা-গো তোমায় মুক্ত করব। ' ১১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনে ধৃত রাজবন্দীদের বিনা শর্তে মুক্তি লাভ। ১২ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদের মুক্তিলাভ। ১৪ ফেব্রুয়ারি 'ডাক'-এর সারা দেশে হরতাল আহ্বান। পল্টনের সভায় জনতা কর্তৃক নুরুল আমিন ও ফরীদ আহমদ লাঞ্ছিত।

১৫ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে নির্মমভাবে হত্যা। ১৫ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সান্ধ্য আইন জারি। আইয়ুব খানের 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা' প্রত্যাহার এবং প্যারোলে মুক্তি দিয়ে শেখ মুজিবসহ বিরোধী নেতৃবৃন্দকে গোলটেবিল বৈঠকে আমন্ত্রণ। ছাত্র-জনতা কর্তৃক প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান। ১৬ ফেব্রুয়ারি দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে ঢাকা।

বাংলা একাডেমি সংলগ্ন স্টেট হাউসে অগি্নসংযোগ। পল্টনে লক্ষাধিক লোকের অংশগ্রহণে সার্জেন্ট জহুরুল হকের গায়েবানা জানাজা। ১৭ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে পূর্ণদিবস হরতাল পালন। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও রসায়ন বিভাগের রিডার শামসুজ্জোহাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে পাকিস্তানি সেনাদের বেয়োনেট চার্জে নির্মমভাবে হত্যা। ২০ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৫টায় সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার।

২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে আমার সভাপতিত্বে পল্টনের মহাসমুদ্রে সংগ্রামী ছাত্রসমাজের অগ্রনায়কদের সংগ্রামী শপথ এবং শেখ মুজিবসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আটক সবার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম প্রদান। সমগ্র দেশ গণবিস্ফোরণে প্রকম্পিত। জনরোষের ভয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব শাহী কর্তৃক সব রাজবন্দীকে বিনাশর্তে মুক্তি দিলে দেশজুড়ে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়।

বস্তুত ১৯৬৬-এর ৮ মে'র গভীর রাতে ছয় দফা কর্মসূচি প্রদানের অভিযোগে দেশরক্ষা আইনে যে মুজিব গ্রেফতার হয়েছিলেন, ৩৩ মাস পর ১৯৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি যে মুজিব মুক্তি লাভ করেন_ নাম বিচারে এক হলেও বাস্তবে ওই দুই মুজিবের মধ্যে ছিল গুণগত ফারাক। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাটি ছিল সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য অগি্নপরীক্ষার মতো।

সেই অগি্নপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি বন্দীদশা থেকে মুক্ত মানব হয়ে বেরিয়ে আসেন। ২২ তারিখ আমরা ইকবাল হলের প্রভোস্টের কক্ষে সারা রাত সভা করি। অনেক প্রস্তাব এসেছিল এই গণসংবর্ধনার_ মওলানা ভাসানী, মণি সিংহ, জুলফিকার আলী ভুট্টো তাদেরও অভ্যর্থনা দেওয়ার প্রস্তাব এসেছিল। কিন্তু আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেই, আমরা একজনকেই সংবর্ধনা জানাব। তিনি আমাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিব।

সেই অনুসারেই রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৩টায় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে জনসভার আয়োজন করা হয়।

শুরুতেই বলেছি, এ দিনটি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। সেদিনের রেসকোর্স ময়দান যারা দেখেননি তাদের বলে বোঝানো যাবে না সেই জনসমাবেশের কথা। আমরা যখন সেখানে পেঁৗছি, তখন রেসকোর্স ময়দানে মানুষ আর মানুষ। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ট্রেন, বাস, ট্রাক, লঞ্চ-স্টিমার বোঝাই হয়ে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, কৃষক-শ্রমিক, সাধারণ মানুষ ছুটে এসেছে।

ঢাকার মানুষ তো আছেই। অভিভূত হয়ে পড়লাম আমি। এর আগে এত বড় জনসভা আমি দেখিনি। এটা জনসভা ছিল না, ছিল জনসমুদ্র। সেই জনসমুদ্রে লাখ লাখ লোক এসেছে প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে একনজর দেখতে।

প্রিয় নেতাকে নিয়ে আমরা মঞ্চে উঠলাম। তখন একটা রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিল, আমি প্রতিটি সভার সভাপতিত্ব করতাম এবং সভা পরিচালনা করতাম। কে বক্তৃতা করবে সেই নামটিও আমিই ঘোষণা করতাম। সেদিন ওই মঞ্চে চারটি ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রেখেছিলেন। চিরাচরিত প্রথা ভঙ্গ করে আগেই সভাপতির ভাষণ দেওয়ার জন্য মঞ্চে দাঁড়িয়ে লাখ লাখ মানুষকে অনুরোধ জানিয়ে বলেছিলাম, 'সবার শেষে আমার বক্তৃতা করার কথা থাকলেও আপনাদের অনুমতি নিয়ে আমি আগেই বক্তৃতা করতে চাই।

' দশ লাখ লোক আমাকে সম্মতি জানাল। বঙ্গবন্ধুর আগেই বক্তৃতা দিলাম। আমার জীবনে এই বক্তৃতাটির কথা চিরদিন মনে থাকবে। সেদিন কী ভালোবাসা যে আমি মানুষের কাছ থেকে পেয়েছি তা বলে বোঝাতে পারব না। বক্তৃতায় আমি বঙ্গবন্ধুকে 'তুমি' বলে সম্বোধন করে বলেছিলাম, 'প্রিয় নেতা তোমার কাছে আমরা ঋণী, বাঙালি জাতি চিরঋণী।

এই ঋণ কোনো দিনই শোধ করতে পারব না। সারা জীবন এই ঋণের বোঝা আমাদের বয়ে চলতে হবে। আজ এই ঋণের বোঝাটাকে একটু হালকা করতে চাই জাতির পক্ষ থেকে তোমাকে একটা উপাধি দিয়ে। ' আমি যখন ১০ লাখ লোককে জিজ্ঞেস করলাম, 'প্রিয় নেতাকে আজ আমরা একটা উপাধি দিতে চাই। ' তখন ১০ লাখ লোক হাত তুলে আমাকে সম্মতি জানিয়েছিল।

আর তখনই আমি ঘোষণা করেছিলাম, 'যে নেতা তার জীবনের যৌবন কাটিয়েছেন পাকিস্তানের কারাগারে, ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন সেই নেতাকে জাতির পক্ষ থেকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করতে চাই। ' ১০ লাখ লোক তুমুল করতালির মধ্য দিয়ে সেদিন এই প্রস্তাব গ্রহণ করে প্রিয় নেতাকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করে লাখ লাখ কণ্ঠে ধ্বনি তুলেছিল 'জয় বঙ্গবন্ধু'।

এমন একটি মধুর দিন আমার জীবনে আর কোনো দিন আসবে না। বছর ঘুরে দিনটি যখন ফিরে আসে হৃদয়ের মানসপটে কত স্মৃতি ভেসে ওঠে। এ দিনের প্রতিটি মুহূর্তে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে মনে পড়ে।

সে দিন বক্তৃতায় আমি আরও বলেছিলাম, 'ছয় দফা ও ১১ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের রক্তের বিনিময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে আমরা ফিরে পেয়েছি। তাদের সে রক্ত যেন বৃথা না যায়, তার জন্য জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানাই। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্রসহ সব মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য এই আন্দোলন শুরু হয়েছে। প্রিয়নেতা, মানুষ তোমার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে। যদি এই বিশ্বাসের বরখেলাপ কর, তবে বাংলার মানুষ তোমাকে ক্ষমা করবে না।

' বক্তৃতা শেষ করে ঘোষণা করেছিলাম, 'এখন বক্তৃতা করবেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব'। তুমুল করতালির মধ্যে তিনি বক্তৃতা করতে দাঁড়ালেন, চারদিকে তাকিয়ে উত্তাল জনসমুদ্রের উদ্দেশে বললেন, ''রাতের অন্ধকারে সান্ধ্য আইনের কঠিন বেড়াজাল ছিন্ন করে যে মানুষ 'মুজিবকে ফিরিয়ে আনতে হবে' বলে আওয়াজ তুলে গুলির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে তাদের দাবির সঙ্গে আমি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না। " সংগ্রামী ছাত্রসমাজকে আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেছিলেন, 'আমি ছাত্রদের ১১ দফা শুধু সমর্থনই করি না, এর জন্য আন্দোলন করে আমি পুনরায় কারাবরণে রাজি আছি। ছাত্রদের ১১ দফার মধ্যে আমার ছয় দফা দাবিও নিহিত রয়েছে। আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন।

আমি যদি এ দেশের মুক্তি আনতে ও জনগণের দাবি আদায় করতে না পারি, তবে আন্দোলন করে আবার কারাগারে যাব। '

পরিশেষে তিনি স্বভাবসুলভ কণ্ঠে কৃতজ্ঞস্বরে বলেন, 'ভায়েরা আমার, তোমরা যারা রক্ত দিয়ে জীবন দিয়ে আমাকে কারাগার থেকে মুক্ত করেছ, যদি কোনো দিন পারি নিজের রক্ত দিয়ে আমি সেই রক্তের ঋণ শোধ করে যাব। ' কী বিশাল হৃদয়ের মানুষ ছিলেন তিনি। অবাক লাগে আজ ভাবতে, তিনি একা রক্ত দিয়ে যাননি_ ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে রক্ত দিয়ে বাঙালি জাতির রক্তের ঋণ তিনি শোধ করে গেছেন। বাঙালি জাতির ইতিহাসে ২৩ ফেব্রুয়ারি একটি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ দিন।

যতদিন বেঁচে থাকব হৃদয়ের গভীরে লালিত এ দিবসটিকে স্মরণ করব।

লেখক : মন্ত্রী, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

ঃড়ভধরষধযসবফ৬৯@মধসরষ.পড়স

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।