অপদার্থ এবং অশুভ আমি, সৃষ্টির বড় ত্রুটি আমি
এইতো কিছুদিন আগেও আমি আম্মুর গলা জড়িয়ে ঘুমোতাম । একই কম্বলের উষ্ণতা ভাগাভাগি করে নিতাম আম্মু আর আমি । আম্মু আমার অগোছালো লম্বা চুলগুলো গোছানোর ভান করে এলোমেলো করে দিত । আমি গল্প শোনার বায়না করতাম । প্রথম প্রথম আম্মু রূপকথা বলতো ।
সেই রূপকথায় রাজপুত্র থাকতো । যে রাজপুত্র শুভ্র ঘোড়ার পিঠে চেপে রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে আসে দৈত্যদের হাত থেকে । আমি তখন চুপিচুপি নিজেকে রাজকন্যা ভাবতাম আর ঠোঁট টিপে হাসতাম । একটু বড় হওয়ার পর গল্পগুলো বদলে গেলো । গল্পে জায়গা করে নিলো সুফিয়া কামাল, কুসুম কুমারী দাস এবং বেগম রোকেয়ার মতো মহীয়সী নারীরা ।
আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম । মনে মনে ভাবতাম একদিন আমিও বেগম রোকেয়ার মতো হবো । নিচু গলায় আম্মুকে বলতাম "আম্মু , আজকে থেকে আমার নাম বেগম রোকেয়া । তুমি আজকে থেকে আমাকে এই নামে ডাকবে । "
আম্মু ঠোঁট টিপে হাসতো শুধু ।
***
আমার নাম প্রাপ্তি । আমি গতবার পিএসসি দিয়েছি । এখন ক্যাডেট কোচিং করছি । গত ডিসেম্বরে আমার তেরো বছর পূর্ণ হয়েছে । এ বছর চৌদ্দতে পা দিয়েছি ।
কেউ বয়স জিজ্ঞেস করলে আমি অস্বস্তিতে পড়ে যাই । চৌদ্দ বলবো নাকি তেরো বলবো !
যেদিন আব্বু আম্মু আমাকে কোচিং এ ভর্তি করাতে নিয়ে এলো সেদিন আমি অনেক খুশী ছিলাম । ঠিক কি কারণে খুশী ছিলাম সেটা এখনো চিন্তা করে বের করতে পারিনি । যাই হোক, প্রথমদিন কোচিং এর এক স্যার গাল টিপে জিজ্ঞেস করেছিলো, "মামণি তোমার বয়স কতো ?"
আমি অনেকক্ষন চুপ থেকে বলেছিলাম, "তের বছর তিন মাস নয় দিন । " স্যার সেদিন কেমন অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে ।
তারপর কাগজে কি কি সব লিখে আমাকে ভর্তি করিয়ে নিলেন কোচিংয়ে ।
কোচিং করতে এসেছিলাম আনন্দ নিয়ে । তখনও জানতাম না সবাইকে ছেড়ে একা একা আমাকে এখানে থাকতে হবে । কোচিং করার জন্য আবার আব্বু আম্মুকে ছেড়ে থাকতে হয় নাকি ?সবার সাথে থেকে কি কোচিং করা যায় না ? পরে শুনেছি ক্যাডেটে নাকি নিয়ম শৃঙ্খলাকে অনেক গুরুত্ব দেয়া হয় । তাই ক্যাডেটে পড়তে হলে আমাকে নিয়ম মাফিক চলার অভ্যাস করতে হবে ।
সে জন্যই কোচিং এর তত্বাবধানে একটা বোর্ডিং এ রাখা হয়েছে আমাকে ।
একটা মাঝারি সাইজের ঘরে মোট ছয়টা বিছানা । আমি, নীলা, ঐশী, ঐন্দ্রিলা, স্নেহা আর অর্পিতা আমরা ছয়জন সেই ঘরে থাকি । ঘরের একদম এক কোনায় আমার বিছানা । আমার বিছানার সাথেই লাগোয়া বাথরুম ।
আমাদের ছয় জনের জন্য বরাদ্দ সেটা । প্রতি শুক্রবার আমরা পালা করে ময়লা কাপড় ধুয়ে দেই ।
প্রথমদিন রাতে যখন আমি ঘুমোতে আসি তখন বিছানাটা খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছিলো । হাত বাড়িয়ে আম্মুর গলা জড়িয়ে ধরতে গিয়ে স্বপ্ন ভাঙে । স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার কষ্টে আমার চোখ ভারী হয়ে আসে ।
ভেতরে কালবৈশাখি শুরু হয়ে যায় । আমি বালিশে মুখ গুঁজে ঝড় থামানোর চেষ্টা করি । ঝড় কমে না, বরং বৃষ্টিতে বালিশ ভিজে যায় । ভেজা বালিশে মাথা রেখে আমি বুঝতে পারি এখানে আমি একা । একদম একা ।
ওদিকে আমার চিরপরিচিত বিছানায় আমার গল্পবলা আম্মুও একা । সেই একা আম্মুও হয়তো ঝড় থামাতে গিয়ে বালিশ ভিজিয়ে ফেলেছে । হয়তো আমার নাম ধরে ডাকাডাকি করছে বারবার, ঠিক যেভাবে আমি নিঃশব্দে তাকে ডাকছি । ঝড়ের গতি বেড়ে যেতে গিয়েও হঠাত্ একদম থেমে যায় একটা হাতের স্পর্শে । আমি কেঁপে উঠি ।
আম্মু এসেছে ভেবে চকিতে উঠে বসি । চোখ মুছে তাকাই । দেখি নীলা উঠে এসেছে আমার বিছানায় । ভালো করে তাকিয়ে দেখি ওর চোখদুটোও ভেজা । নীলা ওর ভেজা চোখ হাতের উল্টোপিঠে মুছে নেয় ।
হাসি হাসি মুখে জিজ্ঞেস করে,
-"কাঁদছো কেন ? এখনও কি ছোট্টটি আছো নাকি ?"
আমিও নীলার মতো চোখ মুছে ফেলি । পাল্টা জিজ্ঞেস করি
-"তুমি কাঁদছিলে কেন ?তুমি কি বড় হও নি ?"
ঠিক সেই মুহুর্ত থেকে আমরা বড় হয়ে গেলাম । এক এক করে বাকী ছয়জনের চোখ থেকে কষ্টের ছাপ মুছে গেলো । আমরা ঐ মাঝারি সাইজের ঘরেই একটা ছোট্ট পৃথিবী তৈরী করে নিলাম । সে পৃথিবীতে কান্নার প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়া হলো ।
আমরা অভিনয় শিখে গেলাম ।
***
এক সপ্তাহ পর আব্বু আম্মু আর বড়ভাইয়া এলো । দূর থেকে আমাকে দেখতে পেয়েই আম্মু দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো । কাঁদতে লাগলো অঝড় ধারায় । আমি ততদিনে পাকা অভিনেত্রীর মতো কান্না লুকোনো শিখে গেছি ।
হাসতে হাসতে বললাম, "ও কি ! কাঁদছো কেন ? রাতে একলা থেকে ভয় পেয়েছো বুঝি !"
আম্মু কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো আমার দিকে । তারপর আবার জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো । হঠাত্ করে আমার কি যেন হলো ! বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেলো , গলার কাছে কি যেন একটা এসে আটকে গেলো । আমি
ঠোঁট কামড়ে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করলাম । চোখ তুলে আব্বুর দিকে তাকালাম আব্বুর দিকে ।
চোখ দুটো আব্বুর কোটরে ঢুকে গেছে । আমার দিকে ঠিকমতো তাকাচ্ছেই না । বারবার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে । স্পষ্ট বুঝতে পারলাম সেটা অশ্রু লুকানোর চেষ্টা মাত্র ।
বড়ভাইয়া বহুকষ্টে মুচকি হাসি ধরে রেখে এগিয়ে আসলো ।
মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বললো,
"কি রে বুড়ি! কষ্ট হচ্ছে নাকি আমাদের ছেড়ে থাকতে ?"
একমুহুর্ত আমার ইচ্ছা করলো চিত্কার করে বলি "হ্যাঁ ভাইয়া খুব কষ্ট হচ্ছে ! খুব খুব খুব কষ্ট হচ্ছে । মনে হচ্ছে আমাকে যেন নির্বাসন দেয়া হয়েছে কিংবা যাবজ্জীবন কারাদন্ড !"
খুব সাবধানে বেপরোয়া ইচ্ছাটাকে দমন করলাম । তারপর বিকট হাসি দিয়ে বললাম "দেখাই তো যাচ্ছে কার কষ্ট হচ্ছে ! হিহিহি"
সেদিন আব্বু আম্মু অনেক কান্নাকাটি করলেন । ফিরে যাবার সময় হাসিমুখে গেলেন । যাবার আগে ভাইয়া হাতে এত্তগুলা গল্পের বই ধরিয়ে দিয়ে গেলো ।
আমি বই হাতে নিয়ে এমন ভাব করলাম যেন এমন খুশী আমার জীবনেও হয়নি । আমার খুশী দেখে ভাইয়া খুশী হলো । কিন্তু ভাইয়া জানে না এখানে গল্পের বই পড়তে দেয়া হয় না । এখানে শুধু পাঠ্যবই পড়তে হয় রাতদিন একাকার করে ।
আম্মু খুব সুন্দর একটা ফ্রগ দিলো যেটা আমি মিনিট পাঁচেক গালে ঠেকিয়ে রেখে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলাম ।
আর সবশেষে আব্বু দিলো একটা টেডিবিয়ার আর কিছু পকেটমানি । টেডিবিয়ারটা কোলে নিয়ে আব্বুকে একশো একটা থ্যাংকস দিলাম ।
আব্বু, আম্মু, খুশী মনে ফিরে গেলো । তাদের মেয়ে আনন্দে আছে । ভালো আছে ।
আমি অনেকক্ষন তাকিয়ে থাকলাম তাদের ফিরে যাওয়া পথের দিকে । হাসি হাসি মুখে হাত নাড়ছিলাম ধীরে ধীরে আমার কানদুটো অবশ হয়ে আসতে লাগলো । চারদিক নিঃশব্দে ভরে গেলো । করিডোর পেরিয়ে আমার রুমে পৌঁছতে মনে হলো একযুগ পেরিয়ে গেছে ।
সে রাতে আমি মনখুলে কাঁদলাম, প্রাণভরে কাঁদলাম ।
বালিশ ভিজে গেলো, ভিজে গেলো আমার মতো পাঁচজনের কাঁধ । ওরা ফুলে ফেপে ওঠা সমুদ্রে সান্ত্বনার বাঁধ দেয়ার চেষ্টা করলো বৃথাই । ওরা এখনো জানে না যে সমুদ্রে বাঁধ দেয়া যায় না ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।