আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মৌলবি নূরুল হক বাঙালি চিন্তকদের এক মহাজন......... সৈয়দ মবনু

প্রাচীনতম সাহিত্য প্রতিষ্ঠান। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত প্রসঙ্গ কথা আমরা একজন মহাজনের কথা আলোচনা করবো, যিনি ছিলেন আড়তদার মহাজন। বিশাল সঞ্চয় আছে তাঁর আড়তে। এই আড়ত থেকে প্রকাশ্য কিংবা গোপনে ব্যবসা করে আরো অনেক হয়েছেন আড়তদার মহাজন। আমরা যদিও আড়তদার মহাজন হতে পারিনি এখনও।

তবে তা কি সত্য নয়, আতরের দোকানে চাকুরী করলে তা খরিদ করে ব্যবহার করতে হয় না? আমরা যে মহাজনের কথা বলছি, তিনি মৌলবি নুরুল হক। হ্যা, মৌলবি নূরুল হক একজন বড় আড়তদার মহাজন ছিলেন। তিনি পিঁয়াজÑরসুন কিংবা অন্য নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তুর মুনাফাখোর আড়তদার ছিলেন না। তিনি ছিলেন জ্ঞান আর চিন্তার আড়তদার মহাজন। একেবারে প্রকৃত চিন্তক মহাজন।

তাঁর আড়তের নাম হলো মাসিক আল-ইসলাহ, সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ। পূঁজি ছিলো নিজের অধ্যয়ন। আর ব্যবসায়ী হলেন বাংলা-আসামের লেখক, সাহিত্যিক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক কিংবা পাঠক;বিশেষ করে সিলেটের হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, সকল মুসলমানতো অবশ্যই। দৈহিক এবং আত্মিক দুটি দিক নিয়ে প্রতিটি প্রাণী-অপ্রাণীর অস্তিত্ব হয়ে থাকে, এটা দর্শনের কথা। সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের প্রতিষ্ঠাকালিন সময় এবং তৎপরবর্তি অর্ধশতাব্দির কথা আমরা যদি বিবেচনা করি তবে বলতে হবে মৌলবি নূরুল হক ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের মূল আত্মা আর বাকি সবকিছু দেহ।

একটি কথা আমাদের সবার স্বীকার করতে হবে, মৌলবি নূরুল হকের জন্ম না হলে হয়তো এই কেন্দ্রিয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের জন্ম হতো না। সিলেটে অবস্থান করে সিলেটি কিংবা ননসিলেটি যারা মুসলিম সাহিত্য সংসদের জন্মের পর লেখক হিসেবে স্বীকৃত হয়েছেন তাদের সবার উপর কিছু না কিছু কেন্দ্রিয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের অবদান আছে, এই কথা অস্বীকার আমার মনে হয় কেউ করবেন না। প্রজন্ম আমরা পর্যন্ত সিলেটে অনেক লেখক আছেন যাদের লেখালেখির প্রথম হাতেখড়ি মৌলবি নূরুল হকের সরাসরি প্রভাবে। আমাদের প্রজন্মের যারা, তারা হয়তো তখন খুব ছোট ছিলাম। দুঃখিত, হয়তো নয়, ছোটই ছিলাম।

তখন পড়তাম দরগাহ মাদ্রাসার মক্তবে। মৌলবি নুরুল হকের বাসা হলো দরগামহল্লাস্ত ঝর্ণারপারে। তাঁর বাসা থেকে মুসলিম সাহিত্য সংসদে যেতে হতো হযরত শাহজালাল (রহ.)Ñএর মাজারের ভেতরের রাস্তা দিয়ে। সেই সময়ে মৌলবি নূরুল হকের সাথে আমার সম্পর্কটা সাহিত্যের ছিলো না, ছিলো আমার নানা মরহুম পির মনফর উদ্দিনের বন্ধুত্বের সূত্রে। হয়তো মৌলবি নূরুল হকও আমায় দেখতেন এই সূত্রের øেহে, করতেন শাসন।

আমি এখন সাহিত্যের তেজারতিতে মুসলিম সাহিত্য সংসদে আসি। আমার মা এখনও প্রায় অবেগি হয়ে উঠতেন মৌলবি নূরুল হক, তাঁর মেয়ে শিউলী, রুবি, ভাতিজা আব্দুল হামিদ, যুগভেরি সম্পাদক আমিনুর রশিদ, যুগভেরি অফিস, মুসলিম সাহিত্য সংসদ, আল-ইসলাহ ইত্যাদির আলোচনায়। আমার মা তাঁর ভাইÑবোনের সবার বড় ছিলেন, তিনি তাঁর বাপ-মায়ের খুব আদর-সোহাগের ছিলেন। এই আদর- সোহাগের ফাঁক দিয়ে প্রথম জীবনে তিনি তাঁর বাপের সাথে এই সব এলাকায় অনেক গিয়েছেন। বড় মামা কবি ফরিদ আহমদ রেজা তাঁর স্মৃতিচারণে বলেন-‘আল-ইসলাহের সাথে আমার পরিচয়ের কোন দিনক্ষণ নেই।

জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই কিংবা জ্ঞান হওয়ার আগ থেকেই বলা যেতে পারে। আব্বা যখন বাড়ীতে থাকেন তখন একগাদা বই-পত্রিকা নিয়ে বাংলা ঘরের বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে বসে শুধু পড়েন আর পড়েন। পড়েন আর বনেদী ফারসী হুক্কা টানেন। ভালো শ্রোতা পেলে গল্প করেন, ভালো খেলোয়ার পেলে দাবাও খেলেন। ’.......‘ আব্বা আল-ইসলাহ অফিস, কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ এর লাইব্রেরী এবং সর্বোপরি এসবের পেছনে যে কর্মবীর নীরবে নিভৃতে হাল ধরে বসে আছেন সেই অবহেলিত কৃতি পুরুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

’......‘ কিছু দিন পর আল-ইসলাহ কর্তৃপক্ষ কিশোর মজলিস খুলবেন বলে ঘোষণা দিলেন। পরিচালক থাকবেন ‘ওলী ভাই’ হিসেবে গল্পকার মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ। আমি তখন খুশিতে আটখানা। এ যাবৎ যা লিখেছি প্রায় সবই শিশুÑকিশোরদের উপযোগী পদ্য অথবা ছড়া। আব্বা ও দাদাজানের অনুকরণে কিছু গান লিখার চেষ্টা করলেও তা কথা-সুর বা ছন্দ বিচারে কাউকে দেখানোর মতো ছিলো না।

কিশোর মজলিসে তাই সাথে সাথে ভর্তি হওয়ার জন্য আমি ও আমার বড়পা আবেদন করে বসলাম। ’(আল-ইসলাহ, নুরুল হক সাহেব এবং আমি, আল-ইসলাহ পঞ্চাশ বর্ষপূর্তি বিশেষ সংখ্যা, সম্পাদক মুহাম্মদ নুরুল হক, প্রকাশকাল-এপ্রিল ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দ)। এখানে কবি ফরিদ আহমদ রেজার ‘বড়পা’ হলেন আমার মা বেগম ফয়জিয়া কামাল। মা এক সময় আল-ইসলাহ এবং যুগভেরীতে কবিতা লিখতেন। আল-ইসলাহে প্রকাশিত মায়ের ‘ঈদের চাঁদ’ (আল-ইসলাহ, ৩৪:৯-১০, ৭০৬) এবং ‘ মাগুরা নদীর তীরে’(আল-ইসলাহ, ৩৫: ৫, ১৮২) কবিতাদ্বয়ের কথা গবেষক নন্দলাল শর্মা তাঁর ‘আল-ইসলাহের লেখক তালিকা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।

কবিতার স্মৃতি এক সময় বন্ধাত্বে কবিকে অনেক কাঁদায়। মা বেশ স্মৃতিচারণ করেন তাঁর প্রথম জীবনের কথা আর চোখের জল গোপনে ফেলেন। মা কবিতা লিখতেন, নানার সাথে মুসলিম সাহিত্য সংসদে যেতেন, মৌলবি নূরুল হক-আমিনুর রশীদ চৌধুরি প্রমূখের বাসায় যেতেন, ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় সাহিত্যের আলোচনায় বসতেন। বড় মামা ফরিদ আহমদ রেজা কিংবা ছোট মামা আহমদ ময়েজ সাহিত্যের পথে যাত্রি হলেও মা বিয়ের পর আর সেদিকে এগিয়ে যেতে পারেননি। শেকড় রেখে গাছ কাটার পর যদি এই শেকড়ে নতুন গাছ উঠে তবে সে সাধারণ গাছ থেকে দ্রুত বড় হতে থাকে।

সাহিত্যে আমার প্রতিভা মূলত এই গাছ কাটা শেকড়ে। মা-ই আমার স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা মাদ্রাসা। আমার স্মরণে প্রথম মুসলিম সাহিত্য সংসদে যাওয়া মৌলবি নূরুল হকের মাধ্যমে। যদি এর আগে নানা, মা, মামাদের কারো সাথে গিয়ে থাকি তবে এই মুহূর্তে স্মরণে নেই। এই যে গেলাম, আর ফিরে আসতে পারিনি।

তাই আমি প্রায় বলি, আমাদের বন্ধুদের মধ্যে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের সাথে অনেকের সম্পর্ক সদস্য, জীবন সদস্য কিংবা কমিটির লোক হিসেবে হলেও আমাদের সম্পর্কটা রক্তের বন্ধনের মতো ঐতিহ্যগত। আমি আমার নানা, মা-বাবা, মামাদেরকে দেখি এই সংসদের ভেতর, দেখি আমার কৈশোর এবং যৌবনের অনেক স্মৃতি। আমার নানা আড্ডা দিয়েছেন এই সংসদে মৌলবি নূরুল হক, আমিনুর রশীদ চৌধুরি, মুসলিম চৌধুরি, চৌধুরি গোলাম আকবর প্রমূখদের সাথি হয়ে। আমার মা কিংবা বড় মামা আড্ডা দিয়েছেন মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ, রাগিব হোসেন চৌধুরি, আব্দুল হামিদ মানিক, হারুনুজ্জামান চৌধুরি, সৈয়দ মোস্তফা কামাল, মহিউদ্দিন শীরু, মুকতাবিস উন নুর, হারুন আকবর চৌধুরি প্রমূখ বয়স্য কিংবা বয়সের কাছাকাছিদের সাথে। আমি আর ছোটমামা আহমদ ময়েজ বয়েসের ব্যবধানের ভেতরও এক সময় আড্ডায় একাকার হয়ে যাই এই সংসদের ভেতর।

আহমদ ময়েজের বয়সের কাছাকাছি বন্ধু মূলত শারিক শাসসুল কিবরিয়া, সেলিম আউয়াল, হোসনে আরা হেনা, ফতেহ ওসমানি, হেলাল উদ্দিন রানা, মালেক ইমতেয়াজ প্রমূখ। ওরা সবাই খুব আড্ডাবাজ। আমি ছোটমামার সাথে ওদের বেশ কিছু আ্ড্ডায় অংশ নিয়েছি। বিশেষ করে দরগাহ গেটের কেন্দ্রিয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে, তাতিপাড়াস্থ সাপ্তাহিক সমাচার অফিস এবং শহরের অন্য আরো কিছু আড্ডার কথা আমার এই মূহুর্তে স্মরণ হচ্ছে। এভাবে এক সময় কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের সাথে আমার নিজের আত্মার সম্পর্ক হয়ে যায়।

আর সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের কথা স্মরণ হওয়া মানে মৌলবি নূরুল হকের স্মৃতি উজানি কৈ মাছের মতো স্মৃতিতে নড়ে উঠা। কতো মানুষইতো বৈশাখের শুরুতে উজানি কৈ মাছ শিকারে যায়, কিন্তু হাসি মুখে বাড়ি ফিরে ক’জন? অনেকের ধারণা মৌলবি নূরুল হক মানে আলÑইসলাহ, মুসলিম সাহিত্য সংসদ আর কিছু অনুষ্ঠান ছাড়া অন্য কিছু নয়। আমরা মনে করি এগুলো মৌলবি নূরুল হকের মূল কর্ম কিংবা কর্মের মূল উদ্দেশ্য নয়। দুর্গ কিংবা ভবনের নামতো রাজ্যত্ব নয়, ওমর বিন খাত্তাবেরতো এসব কিছুই ছিলো না। কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ কিংবা আল-ইসলাহ প্রতিষ্ঠান বিশ্বাসীদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ হলেও প্রকৃত অর্থে তা প্রয়োজন পর্যন্তই গুরুত্ব।

চেঙ্গিসখান, হালাকুখান, বুশ প্রমূখের হাতে ধ্বংস প্রাপ্ত ঐতিহাসিক শহর-নগর দেখার পর আমরা আর ইতিহাসের প্রাতিষ্ঠানিকতায় ঈমান রাখতে পারছি না। তাই আমাদেরকে অনুসন্ধান করতে হবে মৌলবি নূরুল হক কেনো তৎকালিন প্রাতিষ্ঠাকিতাকে বাইপাস করে এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়তে গেলেন, যার মূল শক্তি দেহে নয়, থাকবে আত্মা কিংবা চিন্তায়। তাই মৌলবি নূরুল হকের মূল পরিচয় আমরা মনে করি তিনি এই বাংলার একজন চিন্তক মহাজন ছিলেন। আজকে খুব ইছে মৌলবি নূরুল হককে নিয়ে লিখবো, তবে ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ নয়, একেবারে তাঁর কর্মের চিন্তা অথবা তাঁর চিন্তার উৎস নিয়ে। জানি না আমার প্রিয় এবং সম্মানিত পাঠকদের নিয়ে হাসি মুখে বাড়ি ফিরতে পারবো কি না? আমরা এই আলোচনার মূল পথ হিসেবে ব্যবহার করবো মৌলবি নুরুল হকের গ্রন্থসমূহ।

আমরা তাকে তাঁর লেখা থেকে আবিস্কারের চেষ্টা করবো। মৌলবি নুরুল হকের সময়ে তাঁর প্রকাশিত প্রায় সকল বই লেটার প্রেসে ছাপা। আমি যে বইগুলো মুসলিম সাহিত্য সংসদের সংরক্ষণ থেকে পেয়েছি মূলত সেগুলোই আমার আলোচনার মূল পুঁজি। তবে মৌলবি নুরুল হকের হাতের লেখা কিছু অপ্রকাশিত প্রবন্ধ এবং চিঠি দিয়ে তাঁর নাতি রাজিব এবং বর্তমান আল-ইসলাহ সম্পাদক সেলিম আউয়াল আমাকে কৃতজ্ঞ করেছেন। আমরা এখন ধীরে-ধীরে মৌলবি নুরুল হকের চিন্তায় প্রবেশের চেষ্টা করবো।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৫ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।