গত বছর ডিসেম্বরে প্লাস্টিক বোতল উৎপাদন ও ব্যবহার, পুনরায় ব্যবহার করে পানি, কোমল পানীয় ও ওষুধসহ বিভিন্ন খাদ্য দ্রব্য সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ বন্ধে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। স্বাস্থ্য সচিব, খাদ্য সচিব, আইন সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি, পরিবেশ অধিদপ্তরের ডিজি, বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিবকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। জনস্বার্থে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আর জে খান রবিনের দায়ের করা রিট আবেদনে বলা হয় প্লাস্টিক বোতলে ব্যবহৃত রাসায়নিক উপাদানকে বিজ্ঞানীরা মানবদেহের জন্য হরমোন বিপর্যয়কারী উপাদান বলেছেন। প্লাস্টিক বোতলে ব্যবহৃত রাসায়নিক উপাদানকে বিজ্ঞানীরা মানবদেহের জন্য হরমোন বিপর্যয়কারী উপাদান বলেছেন। প্লাস্টিক বোতলে ব্যবহৃত উপাদান পানিতে খুব দ্রুত রাসায়নিক বিক্রিয়া সংগঠিত করে।
এ বিক্রিয়া মিশে যায় বোতলজাত পানি, খাদ্য দ্রব্য ও ওষুধের মধ্যে। ফলে প্লাস্টিক বোতল দূষণ থেকে মুক্ত থাকে না। এছাড়া প্লাস্টিক বোতল পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকর এ কারণে প্লাস্টিক বোতল বিপণন ও ব্যবহার বন্ধে রিট আবেদন করা হয়। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারক মির্জা হোসেইন হায়দার ও মুহাম্মদ খুরশিদ আলম সরকারের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রুল জারি করেন। এছাড়া বর্তমানে প্লাস্টিক বোতলের মাধ্যমে বিভিন্ন দ্রব্য সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ ও উপাদনে যেসব উপাদান ব্যবহার হয় সেসব উপাদান বাজার থেকে কেন প্রত্যাহার করা হবে না জানতে চেয়ে নির্দেশ দেওয়া হয়।
ট্যাপের পানির চেয়ে বোতলের পানির দাম অনেক বেশি হলেও তা ভোক্তাদের জন্য কম স্বাস্থ্যকর। নিত্যনতুন গবেষণায় বেরিয়ে আসছে, প্লাস্টিক বোতল-পানি কোনোমতেই নিরাপদ ট্যাপের পানির চেয়ে স্বাস্থ্যকর নয়, বরং ক্ষতির পরিমাণ তাতে অনেক বেশি। কারণ যেসব উপাদান দিয়ে প্লাস্টিক বোতল তৈরি হয়, তা পানিতে এমন কিছু রাসায়নিক উপাদান ছড়িয়ে দেয়, যা পানকারীর স্বাস্থ্যের জন্য দীর্ঘমেয়াদি বিপর্যয় হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। এ কথা অনস্বীকার্য যে আকার আর ওজনের সুবিধা মিলিয়ে সারা বিশ্বেই প্লাস্টিকের বোতলজাত পানির কদর বেড়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে বোতলজাত পানি ব্যবসায়ীদের নানা বাহারি বিজ্ঞাপন।
যে কারণে এটি এখন ফ্যাশনেরও অনুষঙ্গ। বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয় পানির বোতল তৈরিতে। তবে আতঙ্কের আরো বিষয় হচ্ছে, প্লাস্টিক থেকে ক্ষতিকর উপাদান দূর করার যে মানদণ্ড দেয়া হয়, বিশ্বব্যাপীই তা মানা হয় না। একই সঙ্গে পানির উত্স, এর বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া ও দাম বিষয়েও ঘাপলা তৈরি হয়। পরীক্ষায় দেখা গেছে, বিশ্বজুড়েই অন্তত ২২ শতাংশ প্লাস্টিকের বোতলে ক্ষতিকর মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হয় না।
ফলে এ বোতল তৈরির ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ উত্পাদিত হয়। ক্ষতিকর উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে নিকেল, ইথাইলবেনজিন, ইথিলিন অক্সাইড, বেনজিন প্রভৃতি। এসব রাসায়নিক পদার্থ মানবদেহে ঢোকার পর হরমোনের স্বাভাবিক কাজে বাধা দেয়। পাশাপাশি মুটিয়ে যাওয়া, অকালে যৌবনের চিহ্ন দেহে ফুটে ওঠা, উর্বরতা বা সন্তান জন্মদানের হার কমে যাওয়া, স্তন ক্যান্সার, প্রোস্টেট ক্যান্সার, জরায়ু ক্যান্সার, হাইপারঅ্যাকটিভ শিশু, অটিজম, হূদরোগও এসব রাসায়নিক পদার্থের কারণে হচ্ছে বলে গবেষকরা দাবি করছেন। বিজ্ঞানীরা এসব রাসায়নিক পদার্থের নাম দিয়েছেন ‘এন্ডোক্রাইন ডিজরাপ্টার্স’।
এন্ডোক্রাইন হচ্ছে দেহের এমন একটি গ্রন্থি যা থেকে নির্গত রস রক্তের মাধ্যমে আমাদের টিস্যুতে পৌঁছায়। তারা বলেছেন, প্লাস্টিকের ক্ষতিকর উপাদান পানি ও খাদ্যের মাধ্যমে দেহে ঢোকার পর তা প্রাকৃতিক এস্ট্রোজেনের মতোই আচরণ করে। এতে দেহের হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়।
মূলত দুই ধরনের প্লাস্টিক দিয়ে এসব তথাকথিত মিনারেল বা ড্রিংকিং ওয়াটারের বোতল তৈরি হয়। এর একটি পলিকার্বন, যা বিসফেনল এ (বিপিএ) থেকে উত্পাদিত এবং অন্যটি পলিইথিলিন টেরেফথালেট বা পিইটি, যা পলিইথিলিন থেকে উত্পাদিত।
পলিইথিলিনকে নিরাপদ বিবেচনা করা হলেও বিপিএ ক্ষতিকর কারণ বিপিএ প্লাস্টিকের আধারে জমে থাকা উপাদান দ্রবীভূত করার ক্ষমতা রাখে। পানিতে এসব উপাদান মিশে যায় সহজেই। বিপিএর সঙ্গে এক প্রকার হরমোনের গাঠনিক মিল রয়েছে। এটি ওয়েসট্রোজেন মিকি হরমোন নামে পরিচিত। অধ্যাপক উইনডার জানিয়েছেন, বিপিএ নানা স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির কারণ।
যেমন— অনুর্বরতা, মোটা হয়ে যাওয়া, ডায়াবেটিস, গলার ক্যান্সার, এমনকি এ উপাদান কেন্দ্রীয় সংবেদনশীলতাকেও অবশ করে দিতে পারে। স্তন ও জরায়ু ক্যান্সারের কারণও হয়ে উঠতে পারে এ বিপিএ। ১৯৫০ সাল থেকেই বাণিজ্যিকভাবে প্লাস্টিক উত্পাদনে এর ব্যবহার হয়ে আসছে; যার ক্ষতিকর বিষয়গুলো এরই মধ্যে প্রমাণিত।
বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয় পানির বোতল তৈরিতে। প্লাস্টিক তৈরির মূল উপাদান হচ্ছে খনিজ তেল।
গবেষকরা অবশ্য বলেছেন, পানিতে বিদ্যমান কিছু মাইক্রো-অর্গানিজম মানব স্বাস্থ্যের জন্য খুব একটা বিপজ্জনক নয়। কিন্তু প্লাস্টিকের বোতলে ঢুকানোর পর তা সত্যি বিপজ্জনক হয়ে যেতে পারে। গবেষকরা বলেছেন, প্লাস্টিক বোতল-পানিতে যে মাত্রায় ক্লোরিন মেশানো হয়, তাতে পানির অপকারী ব্যাকটেরিয়ার পাশাপাশি উপকারী ব্যাকটেরিয়াও মারা যায়। আর এটার চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে, মানবদেহের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্রমশ দুর্বল বা অকার্যকর হয়ে যাওয়া। গবেষকরা এটাও বলেছেন, গ্লাস তৈরির জন্য কাচ তৈরিকালে যে পরিমাণ ক্ষতিকর পদার্থ নির্গত হয়, সমপরিমাণ প্লাস্টিক তৈরিতে তার চেয়ে একশ গুণ বেশি ক্ষতিকর পদার্থ নির্গত হয়।
অস্ট্রেলিয়ার ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষবিদ্যার শিক্ষক ক্রিস উইনডার সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখিয়েছেন প্লাস্টিকের বিক্রিয়া ও মানবশরীরে এর ক্ষতিকর প্রভাব। তিনি জানিয়েছেন, প্লাস্টিক বোতলের পুনর্ব্যবহার ব্যাকটেরিয়াদূষণের জন্য দায়ী। প্রতিবার ব্যবহারের পর তা এমনভাবে ধুতে হবে, যেন অন্য কোনো উপাদান, যেমন- সাবান প্রভৃতি এর সঙ্গে লেগে না থাকে। তাহলে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ থেকে অন্তত রেহাই মিলবে। তবে অবশ্যই তা ঠাণ্ডা পানিতে ধুতে হবে।
কারণ তাপে প্লাস্টিকে ব্যবহূত রাসায়নিক পদার্থগুলো উন্মুক্ত হয়; যা শরীরের ক্ষতি করে। এ ব্যাপারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও বিশিষ্ট পরিবেশ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. জসিমউদ্দীন আহমেদ বলেনঃ তাপ লাগলে প্লাস্টিক বোতলের পানিতে খুব দ্রুত রাসায়নিক বিক্রিয়া সংঘটিত হয়। এ পানি মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে।
প্লাস্টিক বোতল-পানির বিশুদ্ধতা নিয়ে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ বাড়ার পরও পানির ব্যবসা দিন দিন বাড়ছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিশ্বব্যাপী প্রতি সেকেন্ডে প্রায় দেড় হাজার পানির বোতল নিঃশেষ করা হয়।
আর মার্কিনিরা প্রতিবছর ২৯ বিলিয়ন পানির বোতল ডাস্টবিনে ফেলে। এ সংখ্যক বোতল বানাতে ১৫ লাখ ব্যারেল তেল লাগে, যা দিয়ে এক লাখ মোটর গাড়ি এক বছর চালানো যায়। আর ১৫ লাখ ব্যারেল তেল থেকে প্লাস্টিক বানাতে বায়ুতে মেশে ২৫ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড। এসব বোতল অপসারণ করতেও সরকারকে গুনতে হয় বিপুল পরিমাণ অর্থ। প্লাস্টিক বোতল আধুনিক সভ্যতায় ‘থ্রোঅ্যাওয়ে কালচার’ বা ছুড়ে ফেলার সংস্কৃতি চালু করেছে।
আমরা এখন মিনারেল ওয়াটার পান করে বোতল ছুড়ে ফেলছি। কিন্তু বিজ্ঞানীদের গবেষণা এটাই প্রমাণ করছে প্লাস্টিক বোতলও আমাদেরকে জীবন থেকে ছুড়ে ফেলছে অকালমৃত্যুর দরজার দিকে। সবচেয়ে উদ্বেগের ব্যাপার হচ্ছে, এসব প্লাস্টিক মাটিতে মিশে যেতে হাজার বছর লাগবে। এর কারণে নষ্ট হয় ভূমির উর্বরতা ও ব্যাহত হয় জলাধারের স্বাভাবিক গতি। এত কিছু জানা সত্বেও তথাকথিত মিনারেল ওয়াটারের নামে প্লাস্টিকের বোতলে মানহীন পানির ব্যবসার পিছনে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর শত কোটি ডলারের বিনিয়োগ থাকায় বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে সাহসী হয় না।
প্লাস্টিক বোতল-পানির বিশুদ্ধতা ও কথিত গুণ নিয়ে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ বাড়ার পরও কেন পানির ব্যবসা দিন দিন বাড়ছে, কেন এই ক্ষতিকর পাণির প্রতি মানুষের আগ্রহ তা নিয়ে ‘থার্স্ট’ নামে একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানিয়েছেন অ্যালন ফ্লিটো এবং ডিবেরাহ কাউফমান। এতে তারা দেখিয়েছেন, পানি এখন করপোরেট জগতের কবজায়। বিশ্বের নানা প্রান্তের মিউনিসিপ্যালিটি বেসরকারিকরণের কারণে তা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অর্থনীতিতে কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, তা ডকুমেন্টারিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। শুধু তাই নয়, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো পানিকে ‘মৌলিক মানবাধিকার’ আখ্যা দিয়ে কিভাবে আগ্রাসী কায়দায় ভূগর্ভস্থ পানির কপিরাইট কিনছে, তার প্রমাণও দিয়েছেন। এই দুই নির্মাতা পরে ‘থার্স্ট: ফাইটিং দি করপোরেট থেপ্ট অব আওয়ার ওয়াটার’ শিরোনামে পৌনে তিনশ পৃষ্ঠার একটি গবেষণাধর্মী বইও প্রকাশ করেছেন।
প্লাস্টিক বোতল-পানি নিয়ে গুটি কয়েক গবেষণার মাধ্যমে হয়তো এ পৃথিবীকে রক্ষা করা যাবে না, কিন্তু রক্ষার সূচনা হয়ে গেছে। আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বে প্লাস্টিক বোতল-পানির ক্ষতিকর দিক নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। আশার কথা বাংলাদেশেও প্লাস্টিক বোতল উৎপাদন ও ব্যবহার, পুনরায় ব্যবহার করে পানি, কোমল পানীয় ও ওষুধসহ বিভিন্ন খাদ্য দ্রব্য সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ বন্ধে রুল জারি করেছে হাইকোর্ট। অস্ট্রেলিয়ার ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষবিদ্যার শিক্ষক ক্রিস উইনডার আশা করছেন, মানুষ শিগগিরই এর বিপদ সম্পর্কে অবহিত হবে, ১০ বছরের মধ্যেই এ উপাদানের ক্ষতি সম্পর্কে সবাই জানবে এবং ২০ বছরের মধ্যেই প্লাস্টিকের বোতলে পানি খাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে।
সূত্রঃ দি টেলিগ্রাফ
Bottled water 'not as safe as tap variety'।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।