“জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজনে চীনেও যাও” - এ উক্তিটি পবিত্র কুরআন শরীফে উল্লেখ আছে এমন ধারণা প্রচলিত আছে। তেমনি চীনা ভাষায় কথিত আছে “যদি বৌদ্ধ ধর্মের উৎসের সন্ধান চাও তাহলে পশ্চিমের স্বর্গে যাও”। ‘পশ্চিমের স্বর্গ’ বলতে সেই পুণ্যভূমির কথা বলা হয় যেখানে ভগবান বুদ্ধের জন্ম, যার নাম মগধ রাজ্য যা আজকের ভারতের বিহার রাজ্যের দক্ষিণে অবস্থিত।
চীন পূর্ব এশিয়ার একটি রাষ্ট্র। ১৩০ কোটি জনসংখ্যার অধিকারী চীন পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল এবং আয়তনের দিক থেকে এশিয়ার সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র।
চীনারা তাদের দেশকে চুংকুও নামে ডাকে, যার অর্থ "মধ্যদেশ" বা "মধ্যবর্তী রাজ্য"। "চীন" নামটি বিদেশীদের দেওয়া; এটি সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকের ছিন রাজবংশের নামের বিকৃত রূপ। ৭ম শতাব্দী থেকে ১৪শ শতাব্দী পর্যন্ত চীন ছিল বিশ্বের সবচেয়ে অগ্রসর সভ্যতা। কাগজ, ছাপাখানা, বারুদ, চীনামাটি, রেশম এবং দিকনির্ণয়ী কম্পাস সবই চীনে প্রথম উদ্ভাবিত হয় এবং সেখান থেকে বিশ্বের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে। চীনের স্থলসীমার দৈর্ঘ্য প্রায় ২২,৮০০ কিলোমিটার।
বিশ্বের পঞ্চম শীর্ষ অস্ত্র রফতানিকারক দেশ হয়ে উঠেছে চীন। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন। বাংলাদেশ চীনের অস্ত্র রফতানির ৭ ভাগ ক্রয় করে। পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীনের অন্যতম সংখ্যালঘু হলো মুসলমান সম্প্রদায়।
১৯৪৯ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি গৃহযুদ্ধে জয়লাভ করে এবং চীনের মূল ভূখণ্ডে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে।
বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন ওয়েন চিয়া পাও। বর্তমানে চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদের অধীনে মোট ২৮টি মন্ত্রনালয় পর্যায়ের বিভাগ আছে। চীনের বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হচ্ছেন লি চাও সিন । চীন হলো পাহাড় বহুল একটি দেশ । এই সব পাহাড়ী অঞ্চলের আয়তন দেশের মোট আয়তনের দুই-তৃতীয়াংশ ।
এদেশের জিডিপি (GDP) ৮.১৮৫ ট্রিলিয়ন আমেরিকান ডলার। রেলপথ চীনের প্রধান পরিবহন ব্যবস্থা। বর্তমানে চীনের রেলপথের মোট দৈর্ঘ্য ৮৬,০০০ কিমি। ১৯৬২ সালে ভারত চীনের সাথে সীমান্ত বিরোধ সমাধার জন্য যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। তারপরই চীন-ভারত সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
১৯৭১ সালে চীন ও আমেরিকা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন বা মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দেয়নি।
চীনের অভ্যন্তরীণ নদী আর সামুদ্রিক জলসীমা নিয়ে গঠিত সামুদ্রিক অঞ্চলের মোট আয়তন ৩ লক্ষ ৮০ হাজার বর্গকিলোমিটার। চীনের সামুদ্রিক অঞ্চলে ৫০০০-এরও বেশি দ্বীপ রয়েছে। মওলানা ভাসানী’র লেখা মাও সে তুঙ’র দেশে গ্রন্থে চীনের সাধারণ মানুষের সততার অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। চীনের রাজধানী বেজিং-এ বসবাসকারি বাংলাদেশীর সংখ্যা শতাধিক।
এদের বেশীর ভাগই ছাত্র। তারা মেডিকেল, আইটি সহ বিভিন্ন প্রকৌশল বিষয়ে পড়াশুনা করছে। অনেকে লেখাপড়া শেষ করে এখানে চাকুরিও নিয়েছে। চীনে বাংলাদেশী দক্ষ শ্রমিকের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। সরকারি ভাবে একটু উদ্যোগ নিলে এখানে জনসংখ্যা রপ্তানী সম্ভব।
আধা লিটারের একটি পানির বোতলের দাম ৩ ইয়েন, অর্থাৎ বাংলাদেশী মুদ্রায় ৪০ টাকার উপরে। বড় শপিং মলে দাম জানতে কষ্ট করার দরকার হয়না এমনকি চীনের ফুটপাতের ঝুড়িতেও অনেক সময় প্রাইস ট্যাগ থাকে।
চীন এখন বাংলাদেশের পরম বন্ধু। খন্দকার মোশতাকই চীন ও সৌদি আরবের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কোন্নয়নের উদ্যোগ নেন। তখন মোশতাক আহমদ চীনপন্থী সাংবাদিক ফয়েজ আহমদকে চীনে পাঠান।
এরপরই চীন ও সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। চীনকে জানার জন্য কয়েকটি মাত্র মাধ্যম আছে। যার মধ্যে ইন্টারনেট হল অন্যতম। মাউস হাতে নিয়ে Bengali.cri.cn ক্লিক করলেই চোখের সামনে ডেসে উঠবে বর্ণময় এক জগত্। কেনাকাটার জন্যে চীনের চেয়ে ভাল জায়গা সম্ভবতঃ পৃথিবীর আর কোথাও নেই।
চীনারা শুধু যে প্রযুক্তিতে এগিয়েছে তাই নয়, বিভিন্ন ধরণের ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতা মাথায় রেখে পণ্য প্রস্তুতের টেকনিকটাও তারা আয়ত্তব করেছে। চীনে সস্তার দোকান যেমন আছে দামী জিনিষের দোকানেরও অভাব নেই। কেনা কাটা খুবই আনন্দদায়ক এবং লাভ জনক হয় যদি আপনার প্রয়োজনটা দোকানিকে বোঝাতে পারেন।
সাংহাই চীনের দক্ষিণাংশের একটি প্রধান শহর। এটি চীনের সবচেয়ে জনবহুল শহরগুলির অন্যতম।
Yangtze নদীর মুখ অবস্হান সাংহাই শহর , সাংহাই প্রতি বছর প্রায় ৬.৭ মিলিয়ন দর্শক ভ্রমন করে। বাঁধ এবং শহরের ঈশ্বরের মন্দির পর্যটক আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। মূলত সাংহাই কে চীনের বাণিজ্যিক রাজধানী বলা হয়। শিচুয়ান ইউনিভার্সিটি, চীনের নামকরা ইউনিভার্সিটি গুলোর একটি। রবীন্দ্র রচনাবলির প্রায় সবই চীনা ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের রচনা পড়ে চীনা পাঠকরা জানেন, বিশ্ব কবির দয়া ও উদারতা চিরদিন চীন দেশের লোকের মনে থেকে যায়। চীনা পাঠকদের রবীন্দ্রনাথের রচনা খুব ভালো লাগে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি তাঁদের গভীর ভালোবাসা। সারা বিশ্বে যতগুলো দেশ আছে এরমধ্যে চীন দেশ সবচেয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ দেশ। চীন দেশ প্রতিবেশি দেশ সহ সবদেশের সাথে সুন্দর যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু রেখেছে।
চীনের মহাপ্রাচীর মানুষের হাতে তৈরি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্থাপত্য।
শত্রুর হাত থেকে চীনের উত্তর সীমান্ত রক্ষার জন্য পাথর ও মাটি দিয়ে এটি নির্মাণ করা হয়। এটি সাংহাইপাস থেকে শুরু হয়ে শেষ হয়েছে লোপনুর নামক স্থানে। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতক থেকে এই প্রাচীর নির্মাণ শুরু হয়। যায়। পৃথিবীর যেখানেই সভ্যতা সেখানেই নদী।
তারই ধারাবাহিকতায় চীনে ইয়াং সিকিয়াং এবং হোয়াংহো নামে দুটি নদী আছে। মাঝ খানের সমতল ভূমিতে চীনারা বসবাস শুরু করল। চীনাদের এক রাজা ছিলেন নাম শি-হুয়াংতি,চীনের “প্রথম সম্রাট” বলে তাকে সম্মানিত করা হয়। চীনে জন্ম নেয়া মহাপন্ডিতদের একজন হচ্ছেন কনফুসিয়াস(খ্রীস্টপূর্বঃ ৫৫১-৪৭৯)। গণচীনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মাও একদিন তার ব্যক্তিগত চিকিৎসককে জিজ্ঞেস করলেন “গণচীনের চারপাশে শত্রুভাবাপন্ন রাষ্ট্র, আমাদের এ অবস্থায় কি করা উচিত?” কোনো জবাব না পেয়ে মাও নিজেই বললেন, “দেখো, জাপানের ওপাশে সাগর পাড়ের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
আমাদের পূর্বসূরী রাজন্যবর্গ কি এ উপদেশ দেননি যে কাছের শত্রুর সঙ্গে যদি যুদ্ধ করতেই হয় তাহলে সর্বাগ্রে দূরের কোনো শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালানো উচিত। ” সে ছিল ১৯৬৯ সালের কথা।
চীনের দ্বিতীয় রাজবংশ হিসেবে মহাপরাক্রমশালী হান রাজবংশের কথা চীনের ইতিহাসে সঙ্গত কারণেই উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছে। হান বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন লিউ বাং নামীয় এক বিপ্লবী শ্রমিক নেতা। খৃষ্টপূর্ব ২০৬ থেকে ২২০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে এই রাজবংশের শৌর্য-গৌরব বিভিন্ন কারণে একটি বিশেষত্বের দাবীদার।
আজো চীনের জনগণের এক বৃহৎ অংশ নিজেদের ‘হান’ বংশোদ্ভূত চীনা বলে দাবি করে। এমনকি প্রবাসী চীনাদের মধ্যে ‘হান’-চীনাদের প্রতিপত্তির প্রমান পাওয়া যায় যখন চীনা নববর্ষ তাদেরই সবচেয়ে বেশি জাকজমকের সাথে উদযাপন করতে দেখা যায় ।
পাঁচ হাজার বছর আগে চীনের সম্রাট হুয়াংয়ের পত্নী লুও জু প্রজাদের রেশমী পোকা চাষের পদ্ধতি শিখিয়েছিলেন । চীনের কচ্ছপের খোলের উপরে খোদিত যে চীনা শব্দগুলো আবিস্কৃত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে তুঁত, রেশমী গুটি, রেশমী সুতো এবং রেশমী কাপড় প্রভৃতি শব্দ ছিল । জুলাই মাস শীর্ষক চীনের প্রথম কাব্য সংকলন “ কাব্য গ্রন্থ”এর একটি কবিতায় বলা হয়েছে : বসন্তের সুর্য্য উঠেছে , কোকিল গান গাইছে , গ্রামের মেয়েরা তুঁতের কচি পাতা সংগ্রহের জন্য হাতে ঝুলি নিয়ে মেঠো পথে হাঁটছে ।
এই কবিতা পড়ে জানা যায় যে , প্রাচীনকালে চীনারা রেশমী পোকা চাষ,রেশমী সুতো তোলা এবং রেশমী কাপড় বোনার কৌশল আয়ত্ত করেছিলেন ।
প্রাচীন চীনে বিয়ের মোট ছয়টি অনুষ্ঠান আছে , এগুলোর মধ্যে আছে মেয়েপক্ষকে যৌতুক দেওয়া অনুষ্ঠান , বিবাহের বাগদান অনুষ্ঠান আর বিয়ের ভোজ ইত্যাদি । অতীতকালে একটি ছেলে যদি এক মেয়েকে পছন্দ করতেন , তাহলে তিনি মেয়ের বাড়ীতে বিয়ের প্রস্তাব করতে ঘটককে পাঠাতেন । যাওয়ার আগে ছেলেটি ঘটককে কিছু উপহার দেয়া ছাড়াও মেয়েকেও কিছু উপহার দিতেন । ঘটক দু পক্ষের নাম , বয়স আর পারিবারিক অবস্থা প্রভৃতি তথ্য দু পক্ষকে জানিয়ে দিত ।
দু পক্ষ মোটামুটি রাজি হলে ঘটক মেয়ে পক্ষের বাড়ীতে ছেলে পক্ষ যাওয়ার দিন বেছে দিত । ছেলে মেয়ের বাড়ীতে গিয়ে মেয়ের চেহারা নিজ চোখে দেখা ছাড়া মেয়ের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ও মেয়ের চরিত্র ও মেজাজ খোজখবর নিতে পারতেন । প্রাচীন চীনে বিয়ের আগে মেয়ে ছেলের বাড়ীতে যেত না , এখন যুগ পরিবর্তন হয়েছে ,আধুনিককালে বিয়ের আগে অনেক মেয়ে বাবা মার সংগে ছেলের বাড়ীতে গিয়ে ছেলে পরিবারের অবস্থার খোজখবর নেন । পেইচিংয়ের উপকন্ঠের কিছু কিছু জায়গায় এরকম রীতি আছে , যদি মেয়ে ও তার বাবা মা বা আত্মীয়সজন ছেলের বাড়ীতে বেড়াতে গিয়েছেন এবং দুপুর বেলায় এক সংগে খেতে রাজী হন , তাহলে ছেলে পক্ষ বুঝতে পারে যে মেয়ে ছেলেকে পছন্দ করেছেন।
সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস নামের মহানবীর এক সাহাবি ইসলামের দাওয়াত নিয়ে প্রথম চীনে আসেন ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে।
তাং সম্রাট ইয়াং উই পছন্দ করেন এই সাহাবির বয়ে আনা বার্তা। তিনি দেখলেন যে ইসলামের বার্তা সে সময়কার সনাতনী কনফুসিয়াসের মতবাদের সঙ্গে অনেকটাই সামঞ্জস্যপূর্ণ। রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় শিয়ান শহরে একটি মসজিদ বানানো হয়। চীনের প্রথম এই মসজিদটি বানানো হয় চীনা সনাতন পদ্ধতির বৌদ্ধ প্যাগোডার কায়দায়।
বসন্তকালে চীনে ফুল ফোটার সময় এবং ছুটিতে প্রতিটি দর্শনীয় স্থানে লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে।
গত দশ বছরে বিদেশে চীনা পর্যটকের সংখ্যা বছরে ১৮ শতাংশ হারে বেড়েছে এবং পর্যটনের ধারাও পরিবর্তিত হয়েছে। নিউজিল্যান্ডে বিদেশি পর্যটকদের মধ্যে চীনা পর্যটকের সংখ্যা দ্বিতীয় এবং চীন সবচেয়ে দ্রুত উন্নয়নশীল একটি বাজার। চীনা পর্যটকরা ১ মে থেকে নিউজিল্যান্ডে দুই বছরের মাল্টিপল-এন্ট্রি ভিসার জন্য আবেদন করতে পারছে। ২০১২ সালে ব্রিটেন ৩ লাখ চীনা নাগরিকের ভিসা আবেদন গ্রহণ করে এবং ৯৬ শতাংশকেই ভিসা দেয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।