ব্রিটিশদের ভারত শাসনের সময় ভারত উপমাদেশে অনেকগুলো স্বশাসিত রাজ্য ছিল। এসকল রাজ্যসমুহকে বলা হত প্রিন্সলী স্ট্রেট বা দেশীয় রাজ্য। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরাজ ভারত ত্যাগের সময় দেশীয় রাজ্যের সংখ্যা ছিল ৫৬৫ টি। আর আয়তনে ভারতবর্ষের ৪০ ভাগ জুড়ে ছিল এই দেশীয় রাজ্যসমুহ।
দেশীয় রাজ্যগুলো ছিল অনেকটা শায়িত্বশাসিত রাজ্যের মতো যা স্থানীয় রাজা, মহারাজা, নবাব, নিজম, খান পদবী ধারী স্থানীয় শাসকদের দ্বারা শাসিত হতো।
রাজ্যগুলো ব্রিটিশ ভারতের অন্তভূক্ত ছিল না। কিন্তু ব্রিটিশদের সাথে এক চুক্তির মাধ্যমে Subsidiary Alliances বা সম্পূরোক জোটের অন্তভুক্ত ছিল। ভারতে ব্রিটিশদের রাজ্য সম্প্রসারনের মুখে অনেক রাজা মহারাজারা বাধ্য হয়ে উক্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। চুক্তির ফলে রাজা-নবাবেরা রাজ্যের সার্বভৌমের বিনিময়ে তাদের শাসন ক্ষমতা ধরে রাখেন। তাছাড়া অন্য রাজ্যের আক্রমন থেকে রক্ষা পাবার জন্যও তারা অপমানজনক চুক্তিগুলো মেনে নেন।
ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল মারকুয়েস ওয়েলেসলি Subsidiary Alliances Doctrine এর প্রবক্তা। উক্ত জোটের প্রধান প্রধান চুক্তিসমুহ নিম্নরূপঃ-
১) জোটের রাজ্যসমুহে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্রিটিশ সৈন্যের উপস্থিতি থাকবে এবং উক্ত সৈন্যদের ব্যয় ভার রাজ্য প্রধানকে বহন করতে হবে। সৈন্যদের ব্যয় ভার বহনের পরিবর্তে রাজ্যের কিয়দাংশ অঞ্চল ব্রিটিশদেরকে প্রদান করতে পারবে।
২) রাজ্যে ব্রিটিশ রেসিডেন্ট মেনে নিতে হবে।
৩) জোটের অন্তভুক্ত রাজ্যসমুহ অন্য কোন শক্তির জোটে যোগ দিতে পারবে না অথবা ব্রিটিশদের অনুমতি ছাড়া কোন শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করতে পারবে না।
৪) শাসকেরা ব্রিটিশ ব্যতীত কোন ইউরোপীয়ানকে কর্মচারী নিযুক্ত করতে পারবে না। যার ইতিমধ্যে ব্রিটিশ ব্যতীত কোন ইউরোপীয়ানকে কর্মচারী নিযুক্ত করেছেন চুক্তি স্বাক্ষরের পর ঐ সকল কর্মচারীদের বরখাস্ত করতে হবে।
৫) জোটের অন্তভুক্ত রাজ্যসমুহহের মধ্যে বিবাদ দেখা দিলে ব্রিটিশদের মিমাংসা সকল পক্ষকে মেনে নিতে হবে।
৬) ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানীকে ভারতের সর্বপ্রধান শক্তি হিসেবে মেনে নিতে হবে।
৭) চুক্তির সকল শর্ত মেনে নিলে কম্পানী দেশীয় রাজ্যসমুহকে বৈদেশিক আক্রমন ও অভ্যন্তরীন নৈরাজ্য থেকে রক্ষা করবে।
৮) রাজ্য প্রধান জোটের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ প্রদান করতে না পারলে শাস্তি হিসেবে রাজ্যের অংশ বিশেষ ব্রিটিশরা দখল করে নিবে।
পরবর্তীতে লর্ড ডালহৌসির স্বত্ববিলোপ নীতি (Doctrine of lapse) এর মাধ্যমে নতুন নিয়ম চালু করেন । এই নীতির মূলকথা ছিল এই যে, ইংরেজদের আশ্রিত কোনো রাজা অপুত্রক অবস্থায় মারা গেলে সেই রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করা হবে এবং দত্তক (পুত্রের বা কন্যার) উত্তরাধিকার স্বীকার করা হবে না ।
১৭৯৮ সালে হায়দ্রাবাদের নিজাম সর্বপ্রথম চুক্তিতে সাক্ষর করে গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ হন। ১৭৯৯ সালে টিপু সুলতানের যুদ্ধে পরাজয় ও মৃত্যুর পর মহিশুরকে চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য করা হয়।
তারপর এক এক করে শত শত রাজ্য স্বেচ্ছায় কিংবা বাধ্য হয়ে চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।
দেশীয় রাজ্যসমুহের বৈদেশিক ও সামরিক নীতি ছিল ব্রিটিশ নির্ভর। তবে তারা অভ্যন্তরীন শাসন ও বিচারকার্য পরিচালনা করতে পারতেন। রাজ্যসমুহের নিজস্ব জাতীয় পতাকা ছিল। রাজ্যসমুহে ব্রিটিশরা রেসিডেন্ট বা পলিটিকেল এজেন্ট নিযুক্ত করতেন যারা রাজ্যে ব্রিটিশ প্রতিনিধি ও দেশীয় রাজার উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করত।
দেশীয় রাজারা ছিল ব্রিটিশদের প্রতি অনুগত। যখন ভারতের মূল ভূখন্ডে চলছিল স্বদেশী আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন তখন রাজারা এসব ব্রিটিশ বিরোধী কর্মকান্ড নিজ রাজ্যে ঠেকিয়ে রাখতেন। বিভিন্ন সংকটের সময় তারা ব্রিটিশরাজকে সাহায্য করতেন। যেমন সিপাহী বিপ্লবের সময় পাঞ্জাব সৈন্যরা ব্রিটিশদের পক্ষে যুদ্ধ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় হায়দ্রাবাদের নিজাম ব্রিটিশ যুদ্ধ তহবিলে ২৫ লক্ষ পাউন্ড দান করেন।
গোয়ালিয়রের রাজা তিন ব্যাটালিয়ন পদাতিক ও একটি হাসপাতাল জাহাজ দিয়ে যুদ্ধে ব্রিটিশদের সাহায্য করে। যোধপুরের অশ্বারোহী বাহিনী তুর্কীদের কাছ থেকে হাইফা বন্দর দখলে ব্যপক অবদান রাখে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়পুরের মহারাজা ইতালীতে ফাস্ট জয়পুর ইনফ্যান্ট্রির নেতৃত্ব দেন। বার্মায় যুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য বুন্দীর মহারাজাকে মিলিটারি ক্রস পদক দেওয়া হয়।
সে সময় ব্রিটিশ রাজা, রাজপরিবার, সন্মানিত রাজ প্রতিনিধি/ কর্মচারীদের সন্মানে গান স্যালুটের প্রচলন ছিল।
এটি হলো তোপধ্বনির মাধ্যমে কাউকে সন্মান করা। যার সন্মান যতো বেশি তার জন্য ততো বেশি তোপধ্বনি। যেমন ব্রিটিশ রাজা বা রানীর সন্মানে ১০১ বার তোপধ্বনি, রাজ পরিবারের সদস্য/ভাইসরয়/ভারতের গভর্নর জেনারেলের সন্মানে ৩১ বার তোপধ্বনি। দেশীয় রাজ্যের অনেক রাজা-মহারাজার ভারতের রাজধানিতে ( প্রথমে কলকাতা পরে দিল্লী) আগমন ঘটলে তোপধ্বনির মাধ্যমে সন্মান দেখানো হত। হায়দ্রাবাদ, কাশ্মীর, গোয়ালিয়র, মহীশূর, এবং বরোদার রাজাদেরকে ( সুলতান, নিজাম সবাইকেই রাজা বলা হল) সর্বচ্চ ২১ বার তোপধ্বনির সন্মান দেখান হত।
অন্য অনেক রাজার জন্য বিভিন্ন সংখ্যক তোপধ্বনির বরাদ্দ ছিল। তবে ৫৬৫ টি দেশীয় রাজ্যের মধ্যে ৪২৫ টি রাজ্যের প্রধানদের জন্য কোন তোপধ্বনি বরাদ্দ ছিল না। রাজকোষের সমৃদ্ধি, রাজরক্তের কৌলিন্য, ব্রিটিশরাজের আনুগত্য ইত্যাদি বিবেচনা করে তাদের তোপধ্বনির সংখ্যা ঠিক করা হত।
অধিকাংশ রাজা ভোগ বিলাসে নিমজ্জিত থাকলেও তাদের অনেকেই রাজ্যের উন্নয়নে মনযোগী ছিলেন। ফলে সেসব রাজ্যের প্রজাদের সার্বিক অবস্থা ব্রিটিশ শাসিত ভারতের জনগনের তুলনায় অনেক উন্নত ছিল।
যেমন বরোদা রাজ্যে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু ছিল। রাজ্যে বহু বিবাহ নিষিদ্ধ হয় এবং অস্পশ্যতা দূর করতে বিভিন্ন সরকারী প্রদক্ষেপ গ্রহন করা হয়। ভূপালের রাজা রাজ্যে নারী অধীকার রক্ষায় প্রশংসনীয় প্রদক্ষেপ গ্রহন করেন। মহীশূরের রাজা রাজ্যে অনেকগুলো জল-বিদ্যুত বাঁধ নির্মাণ করেন। এতে সাধারন চাষীর খুব উপকার হয়েছিল।
আবার অনেক রাজ্যেই শক্তিশালি সামরিক বাহিনী ছিল। যেমন- হায়দ্রাবাদে নিজামের গোলন্দাজ, বিমান বাহিনী সহ বড় সৈন্য বাহিনী ছিল, পাতিয়ানা রাজ্যে ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়াযান সহ শক্তিশালী সেনাবাহিনী।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারত স্বাধীন আইন – ১৯৪৭ পাশ হয়। উক্ত আইনে দেশীয় রাজ্যসমুহকে অপশন নির্বাচনের সুযোগ দেওয়া হয়। চাইলে তারা ভারতের সাথে যুক্ত হতে পারবে অথবা পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হতে পারবে অথবা স্বাধীন হতে পারবে।
প্রথমে অনেক রাজা স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েম করতে চাইলেন। পরে কনফেডারেশন চাইলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রায় সকল রাজ্যই ভারত কিংবা পাকিস্তানে যোগ দিতে বাধ্য হলেন। কয়েকটি রাজ্য স্বাধীনতা ঘোষনা করলেও শেষ পর্যন্তু স্বাধীনতা ধরে রাখতে পারেনি। সর্দার বল্লভভাই পেটেলের নেতৃত্বে ভারতের নতুন সরকার এই রাজ্যগুলির সঙ্গে রাজনৈতিক বোঝাপড়া শুরু করে।
পেটেল তার দিল্লীর বাসভবনে রাজাদেরকে চায়ের নিমন্ত্রন করে তাদেরকে ভারতে যোগ দিতে আহবান করতেন। যুক্তি তর্ক দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করতেন, নিজ রাজ্যের উন্নতি, সমৃদ্ধি ও জনগনের বৃহত্তর কল্যানে তাদের ভারতে যোগ দেওয়া উচিত। ভারতে যুক্ত হলে রাজাদের নিজ নিজ পদবী বহাল থাকবে, তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি তাদের মালিকানায় থাকবে, মাসে মাসে মাসহারা প্রদান করা হবে এবং বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হবে। তাদেরকে আকারে ইংগিতে বুঝিয়ে দিতেন ভারতের অধীনতা স্বীকার না করলে তাদের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
রাজ্যসমুহের কংগ্রেস দলের নেতা-কর্মীরা সক্রিয় হয়ে পড়ে।
ভারতে যুক্ত হতে রাজ্যে রাজ্যে দেখা দেয় বিক্ষোভ ও আন্দোলন। গনবিক্ষোভের মুখে, ভারতের সামরিক অভিযানের ভয়ে কিংবা স্বেচ্ছায় রাজারা ভারতে যোগদান করে। অনেক রাজ্য আবার পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হয়।
জুনাগড়ের মুসলিম নবাব স্বাধীন থাকতে চাইলেন। ভারত সৈন্য প্রেরন করলে নবাব ভারতে যোগ দেন।
পরে গণভোটের মাধ্যমে জুনাগড়ের জনগণ ভারত অন্তুভূক্তির পক্ষে রায় দেয়। ভারত সামরিক অভিযান চালিয়ে ১৯৪৮ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর হাইদ্রাবাদ, ১২ই অক্টোবর বিলাসপুর, ১৯৪৯ সালের ১লা মে ভুপাল দখল করে। পাকিস্তান সয়ামরিক বাহিনী সমর্থিত পাঠান উপজাতীর আক্রমনের মুখে জম্মু ও কাশ্মীরের রাজা ১৯৪৭ সালের ২৭ অক্টোবর রাজ্যটিকে ভারতের সাথে যুক্ত করেন। জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধে। রাজ্যটি ভারত, পাকিস্তান ও চিনের দখলে তিন খন্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
আর স্বাধীন রাজ্য সিকিমকে ১৯৭৫ সালে ভারত কৌশলে দখল করে নেয়। প্রিন্সলি স্টেটের মধ্যে কেবল নেপাল ও ভূটান স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে এখনো টিকে আছে। অবশ্য ১৯৪৯ সালের এক চুক্তির ফলে ভারতের উপদেশ অনুযায়ী ভূটান তার বৈদেশীক নীতি পরিচালনা করে।
দেশীয় রাজারা তাদের রাজ্য ভারতের হাতে তুলে দেয়। বিনিময়ে ভারত অনেক রাজা মহারাজাকে বিভিন্ন দেশে ভারতের রাষ্ট্রদূত নিয়োগ প্রদান করে।
আবার অনেককে ভারতে প্রজাতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ট করে। তাদের নিজ পদবী ধারনসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করে। তাদের জন্য সন্মানজনক মাসহারার ব্যবস্থা করে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ভারত সরকার তাদেরকে ভুলে যেতে থাকে। ধিরে ধীরে তাদেরকে গুরুত্বপুর্ণ পদ থেকে প্রত্যাহার করা হতে থাকে।
ইন্দিরা গান্ধী প্রধান মন্ত্রী থাকাকালীন ১৯৭১ সালে সংবিধান সংশোধন করে তাদের মাসহারা ও বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা বন্ধ করে দেয়।
ব্রিটিশদের ভারত শাসনের সময় ভারত উপমাদেশে অনেকগুলো স্বশাসিত রাজ্য ছিল। এসকল রাজ্যসমুহকে বলা হত প্রিন্সলী স্ট্রেট বা দেশীয় রাজ্য। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরাজ ভারত ত্যাগের সময় দেশীয় রাজ্যের সংখ্যা ছিল ৫৬৫ টি। আর আয়তনে ভারতবর্ষের ৪০ ভাগ জুড়ে ছিল এই দেশীয় রাজ্যসমুহ।
দেশীয় রাজ্যগুলো ছিল অনেকটা শায়িত্বশাসিত রাজ্যের মতো যা স্থানীয় রাজা, মহারাজা, নবাব, নিজম, খান পদবী ধারী স্থানীয় শাসকদের দ্বারা শাসিত হতো। রাজ্যগুলো ব্রিটিশ ভারতের অন্তভূক্ত ছিল না। কিন্তু ব্রিটিশদের সাথে এক চুক্তির মাধ্যমে Subsidiary Alliances বা সম্পূরোক জোটের অন্তভুক্ত ছিল। ভারতে ব্রিটিশদের রাজ্য সম্প্রসারনের মুখে অনেক রাজা মহারাজারা বাধ্য হয়ে উক্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। চুক্তির ফলে রাজা-নবাবেরা রাজ্যের সার্বভৌমের বিনিময়ে তাদের শাসন ক্ষমতা ধরে রাখেন।
তাছাড়া অন্য রাজ্যের আক্রমন থেকে রক্ষা পাবার জন্যও তারা অপমানজনক চুক্তিগুলো মেনে নেন।
ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল মারকুয়েস ওয়েলেসলি Subsidiary Alliances Doctrine এর প্রবক্তা। উক্ত জোটের প্রধান প্রধান চুক্তিসমুহ নিম্নরূপঃ-
১) জোটের রাজ্যসমুহে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্রিটিশ সৈন্যের উপস্থিতি থাকবে এবং উক্ত সৈন্যদের ব্যয় ভার রাজ্য প্রধানকে বহন করতে হবে। সৈন্যদের ব্যয় ভার বহনের পরিবর্তে রাজ্যের কিয়দাংশ অঞ্চল ব্রিটিশদেরকে প্রদান করতে পারবে।
২) রাজ্যে ব্রিটিশ রেসিডেন্ট মেনে নিতে হবে।
৩) জোটের অন্তভুক্ত রাজ্যসমুহ অন্য কোন শক্তির জোটে যোগ দিতে পারবে না অথবা ব্রিটিশদের অনুমতি ছাড়া কোন শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করতে পারবে না।
৪) শাসকেরা ব্রিটিশ ব্যতীত কোন ইউরোপীয়ানকে কর্মচারী নিযুক্ত করতে পারবে না। যার ইতিমধ্যে ব্রিটিশ ব্যতীত কোন ইউরোপীয়ানকে কর্মচারী নিযুক্ত করেছেন চুক্তি স্বাক্ষরের পর ঐ সকল কর্মচারীদের বরখাস্ত করতে হবে।
৫) জোটের অন্তভুক্ত রাজ্যসমুহহের মধ্যে বিবাদ দেখা দিলে ব্রিটিশদের মিমাংসা সকল পক্ষকে মেনে নিতে হবে।
৬) ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানীকে ভারতের সর্বপ্রধান শক্তি হিসেবে মেনে নিতে হবে।
৭) চুক্তির সকল শর্ত মেনে নিলে কম্পানী দেশীয় রাজ্যসমুহকে বৈদেশিক আক্রমন ও অভ্যন্তরীন নৈরাজ্য থেকে রক্ষা করবে।
৮) রাজ্য প্রধান জোটের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ প্রদান করতে না পারলে শাস্তি হিসেবে রাজ্যের অংশ বিশেষ ব্রিটিশরা দখল করে নিবে।
পরবর্তীতে লর্ড ডালহৌসির স্বত্ববিলোপ নীতি (Doctrine of lapse) এর মাধ্যমে নতুন নিয়ম চালু করেন । এই নীতির মূলকথা ছিল এই যে, ইংরেজদের আশ্রিত কোনো রাজা অপুত্রক অবস্থায় মারা গেলে সেই রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করা হবে এবং দত্তক (পুত্রের বা কন্যার) উত্তরাধিকার স্বীকার করা হবে না ।
১৭৯৮ সালে হায়দ্রাবাদের নিজাম সর্বপ্রথম চুক্তিতে সাক্ষর করে গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ হন।
১৭৯৯ সালে টিপু সুলতানের যুদ্ধে পরাজয় ও মৃত্যুর পর মহিশুরকে চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য করা হয়। তারপর এক এক করে শত শত রাজ্য স্বেচ্ছায় কিংবা বাধ্য হয়ে চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।
দেশীয় রাজ্যসমুহের বৈদেশিক ও সামরিক নীতি ছিল ব্রিটিশ নির্ভর। তবে তারা অভ্যন্তরীন শাসন ও বিচারকার্য পরিচালনা করতে পারতেন। রাজ্যসমুহের নিজস্ব জাতীয় পতাকা ছিল।
রাজ্যসমুহে ব্রিটিশরা রেসিডেন্ট বা পলিটিকেল এজেন্ট নিযুক্ত করতেন যারা রাজ্যে ব্রিটিশ প্রতিনিধি ও দেশীয় রাজার উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করত।
দেশীয় রাজারা ছিল ব্রিটিশদের প্রতি অনুগত। যখন ভারতের মূল ভূখন্ডে চলছিল স্বদেশী আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন তখন রাজারা এসব ব্রিটিশ বিরোধী কর্মকান্ড নিজ রাজ্যে ঠেকিয়ে রাখতেন। বিভিন্ন সংকটের সময় তারা ব্রিটিশরাজকে সাহায্য করতেন। যেমন সিপাহী বিপ্লবের সময় পাঞ্জাব সৈন্যরা ব্রিটিশদের পক্ষে যুদ্ধ করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় হায়দ্রাবাদের নিজাম ব্রিটিশ যুদ্ধ তহবিলে ২৫ লক্ষ পাউন্ড দান করেন। গোয়ালিয়রের রাজা তিন ব্যাটালিয়ন পদাতিক ও একটি হাসপাতাল জাহাজ দিয়ে যুদ্ধে ব্রিটিশদের সাহায্য করে। যোধপুরের অশ্বারোহী বাহিনী তুর্কীদের কাছ থেকে হাইফা বন্দর দখলে ব্যপক অবদান রাখে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়পুরের মহারাজা ইতালীতে ফাস্ট জয়পুর ইনফ্যান্ট্রির নেতৃত্ব দেন। বার্মায় যুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য বুন্দীর মহারাজাকে মিলিটারি ক্রস পদক দেওয়া হয়।
সে সময় ব্রিটিশ রাজা, রাজপরিবার, সন্মানিত রাজ প্রতিনিধি/ কর্মচারীদের সন্মানে গান স্যালুটের প্রচলন ছিল। এটি হলো তোপধ্বনির মাধ্যমে কাউকে সন্মান করা। যার সন্মান যতো বেশি তার জন্য ততো বেশি তোপধ্বনি। যেমন ব্রিটিশ রাজা বা রানীর সন্মানে ১০১ বার তোপধ্বনি, রাজ পরিবারের সদস্য/ভাইসরয়/ভারতের গভর্নর জেনারেলের সন্মানে ৩১ বার তোপধ্বনি। দেশীয় রাজ্যের অনেক রাজা-মহারাজার ভারতের রাজধানিতে ( প্রথমে কলকাতা পরে দিল্লী) আগমন ঘটলে তোপধ্বনির মাধ্যমে সন্মান দেখানো হত।
হায়দ্রাবাদ, কাশ্মীর, গোয়ালিয়র, মহীশূর, এবং বরোদার রাজাদেরকে ( সুলতান, নিজাম সবাইকেই রাজা বলা হল) সর্বচ্চ ২১ বার তোপধ্বনির সন্মান দেখান হত। অন্য অনেক রাজার জন্য বিভিন্ন সংখ্যক তোপধ্বনির বরাদ্দ ছিল। তবে ৫৬৫ টি দেশীয় রাজ্যের মধ্যে ৪২৫ টি রাজ্যের প্রধানদের জন্য কোন তোপধ্বনি বরাদ্দ ছিল না। রাজকোষের সমৃদ্ধি, রাজরক্তের কৌলিন্য, ব্রিটিশরাজের আনুগত্য ইত্যাদি বিবেচনা করে তাদের তোপধ্বনির সংখ্যা ঠিক করা হত।
অধিকাংশ রাজা ভোগ বিলাসে নিমজ্জিত থাকলেও তাদের অনেকেই রাজ্যের উন্নয়নে মনযোগী ছিলেন।
ফলে সেসব রাজ্যের প্রজাদের সার্বিক অবস্থা ব্রিটিশ শাসিত ভারতের জনগনের তুলনায় অনেক উন্নত ছিল। যেমন বরোদা রাজ্যে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু ছিল। রাজ্যে বহু বিবাহ নিষিদ্ধ হয় এবং অস্পশ্যতা দূর করতে বিভিন্ন সরকারী প্রদক্ষেপ গ্রহন করা হয়। ভূপালের রাজা রাজ্যে নারী অধীকার রক্ষায় প্রশংসনীয় প্রদক্ষেপ গ্রহন করেন। মহীশূরের রাজা রাজ্যে অনেকগুলো জল-বিদ্যুত বাঁধ নির্মাণ করেন।
এতে সাধারন চাষীর খুব উপকার হয়েছিল। আবার অনেক রাজ্যেই শক্তিশালি সামরিক বাহিনী ছিল। যেমন- হায়দ্রাবাদে নিজামের গোলন্দাজ, বিমান বাহিনী সহ বড় সৈন্য বাহিনী ছিল, পাতিয়ানা রাজ্যে ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়াযান সহ শক্তিশালী সেনাবাহিনী।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারত স্বাধীন আইন – ১৯৪৭ পাশ হয়। উক্ত আইনে দেশীয় রাজ্যসমুহকে অপশন নির্বাচনের সুযোগ দেওয়া হয়।
চাইলে তারা ভারতের সাথে যুক্ত হতে পারবে অথবা পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হতে পারবে অথবা স্বাধীন হতে পারবে। প্রথমে অনেক রাজা স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েম করতে চাইলেন। পরে কনফেডারেশন চাইলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রায় সকল রাজ্যই ভারত কিংবা পাকিস্তানে যোগ দিতে বাধ্য হলেন। কয়েকটি রাজ্য স্বাধীনতা ঘোষনা করলেও শেষ পর্যন্তু স্বাধীনতা ধরে রাখতে পারেনি।
সর্দার বল্লভভাই পেটেলের নেতৃত্বে ভারতের নতুন সরকার এই রাজ্যগুলির সঙ্গে রাজনৈতিক বোঝাপড়া শুরু করে। পেটেল তার দিল্লীর বাসভবনে রাজাদেরকে চায়ের নিমন্ত্রন করে তাদেরকে ভারতে যোগ দিতে আহবান করতেন। যুক্তি তর্ক দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করতেন, নিজ রাজ্যের উন্নতি, সমৃদ্ধি ও জনগনের বৃহত্তর কল্যানে তাদের ভারতে যোগ দেওয়া উচিত। ভারতে যুক্ত হলে রাজাদের নিজ নিজ পদবী বহাল থাকবে, তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি তাদের মালিকানায় থাকবে, মাসে মাসে মাসহারা প্রদান করা হবে এবং বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হবে। তাদেরকে আকারে ইংগিতে বুঝিয়ে দিতেন ভারতের অধীনতা স্বীকার না করলে তাদের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
রাজ্যসমুহের কংগ্রেস দলের নেতা-কর্মীরা সক্রিয় হয়ে পড়ে। ভারতে যুক্ত হতে রাজ্যে রাজ্যে দেখা দেয় বিক্ষোভ ও আন্দোলন। গনবিক্ষোভের মুখে, ভারতের সামরিক অভিযানের ভয়ে কিংবা স্বেচ্ছায় রাজারা ভারতে যোগদান করে। অনেক রাজ্য আবার পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হয়।
জুনাগড়ের মুসলিম নবাব স্বাধীন থাকতে চাইলেন।
ভারত সৈন্য প্রেরন করলে নবাব ভারতে যোগ দেন। পরে গণভোটের মাধ্যমে জুনাগড়ের জনগণ ভারত অন্তুভূক্তির পক্ষে রায় দেয়। ভারত সামরিক অভিযান চালিয়ে ১৯৪৮ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর হাইদ্রাবাদ, ১২ই অক্টোবর বিলাসপুর, ১৯৪৯ সালের ১লা মে ভুপাল দখল করে। পাকিস্তান সয়ামরিক বাহিনী সমর্থিত পাঠান উপজাতীর আক্রমনের মুখে জম্মু ও কাশ্মীরের রাজা ১৯৪৭ সালের ২৭ অক্টোবর রাজ্যটিকে ভারতের সাথে যুক্ত করেন। জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধে।
রাজ্যটি ভারত, পাকিস্তান ও চিনের দখলে তিন খন্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আর স্বাধীন রাজ্য সিকিমকে ১৯৭৫ সালে ভারত কৌশলে দখল করে নেয়। প্রিন্সলি স্টেটের মধ্যে কেবল নেপাল ও ভূটান স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে এখনো টিকে আছে। অবশ্য ১৯৪৯ সালের এক চুক্তির ফলে ভারতের উপদেশ অনুযায়ী ভূটান তার বৈদেশীক নীতি পরিচালনা করে।
দেশীয় রাজারা তাদের রাজ্য ভারতের হাতে তুলে দেয়।
বিনিময়ে ভারত অনেক রাজা মহারাজাকে বিভিন্ন দেশে ভারতের রাষ্ট্রদূত নিয়োগ প্রদান করে। আবার অনেককে ভারতে প্রজাতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ট করে। তাদের নিজ পদবী ধারনসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করে। তাদের জন্য সন্মানজনক মাসহারার ব্যবস্থা করে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ভারত সরকার তাদেরকে ভুলে যেতে থাকে।
ধিরে ধীরে তাদেরকে গুরুত্বপুর্ণ পদ থেকে প্রত্যাহার করা হতে থাকে। ইন্দিরা গান্ধী প্রধান মন্ত্রী থাকাকালীন ১৯৭১ সালে সংবিধান সংশোধন করে তাদের মাসহারা ও বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা বন্ধ করে দেয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।