আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হাঁসুলী বাঁকের উপকথা

প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাংলা কথা সাহিত্যের এক অবিস্মরণীয় শিল্পী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। এক দিকে ধর্মশাস্ত্রের অবাধ অনুশীলন এবং অন্যদিকে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে তারাশঙ্করের মানস গঠিত হয়েছিল। ১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে তিনি গ্রেফতার হন। তারাশঙ্করকে বিচারের জন্য সিউড়ি শহরে নিয়ে যাওয়া হয়। বিচারে তাঁর কারাদন্ড হয়।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে অনুকূল জনমত গঠনে তিনি আত্মনিয়োগ করেন। দায়িত্ব গ্রহণ করেন বাংলাদেশ সহায়ক শিল্পী-সহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমিতির সভাপতির গুরুত্বপূর্ণ পদ। এ সময় তিনি দু'টি উপন্যাস রচনা করেন। একটি ‘সুতপার তপস্যা'। অপরটি ‘একটি কালো মেঘের কথা'।

তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘চৈতালী ঘূর্ণি' ১৯৩১ সালে প্রকাশিত হয়। ‘চৈতালী ঘূর্ণি' এই উপন্যাসে গ্রামের দরিদ্র চাষী গোষ্ঠী আর তার স্ত্রী দামিনী গ্রাম্য শোষণের হাত থেকে বাঁচার জন্য শহরে আসে। গোষ্ঠ কারখানায় চাকরি পায়। স্বামী-স্ত্রী বস্তিতে থাকে। গোষ্ঠ মজুরদের ধর্মঘটে অংশ গ্রহণ করে, যার সঙ্গে নিম্ন-মধ্যবিত্ত কর্মীরাও জড়িত ছিল।

তারাশঙ্কর বাংলা কথা সাহিত্যে নতুন বক্তব্য নিয়ে আসেন। বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির সংগ্রামকে বিষয়বস্তু করে তিনি রচনা করেন তার সর্বশেষ উপন্যাস ‘একটি কালো মেয়ের কথা। '। এ গ্রন্থে বাংলাদেশীদের ত্যাগ ও সংগ্রামের অনন্যতাকে সুষ্ঠুভাবে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছেন। হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় তারাশঙ্কর কৌমসমাজের গোষ্ঠীজীবনকে বিষয়ভুক্ত করেছেন।

উপন্যাসটিতে রয়েছে সমান্তরাল দু'টি কাহিনী স্রোত। একটি-বাঁশবাঁদি গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত কোপাই নদীর বিখ্যাত হাঁসুলী বাঁকের কাহার সম্প্রদায়ের জীবন সংহতির অনিবার্য ভাঙন, কৃষি নির্ভর জীবনের ক্রমাবসান এবং বাঁশবন- ঘেরা উপকথার হাঁসুলী বাঁকের বিরান প্রান্তরে পরিণত হওয়ার কথকতা। তারাশঙ্কর দেখাতে চেয়েছেন হাঁসুলী বাঁকের গোষ্ঠী জীবনের বিনাশের ইতিহাস অর্থাৎ মূল্যবোধের বিপর্যয় এবং পরিণতিতে কাহার সম্প্রদায়ে স্বগ্রাম থেকে উচ্ছেদ হওয়ার প্রসঙ্গ। উপন্যাসে দেখি, যুদ্ধের দামামাই নগদ অর্থ উপার্জনের প্রলোভনে আকৃষ্ট করে কাহারদেরকে দিনমজুরে পরিণত করেছে, যুদ্ধের রসদ যোগানোর অনিবার্যতায় নিশ্চিহ্ন হয়েছে বাঁশবাঁদির বাঁশবন। ফলত, স্বভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে কাহারকুল; বুর্জোয়া ধনতান্ত্রিক সমাজের অজগরতুল্য জঠরের আকর্ষণে বাস্তুহারা- সংস্কৃতিহারা কৃষক কাহার রূপান্তরিত হয়েছে যন্ত্রকলের শ্রমদাসে।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের একাধিক উপন্যাসে নিম্নবর্গের জীবন ও চরিত্র উপস্থাপিত হয়েছে। রাঢ় বাংলার কৃষক, কুলি-কামিন, মুটে-মজদুর, বেদে, ডোম-জমাদার, বাগদি, কাহার, সাঁওতাল, মাঝি, চণ্ডাল, বারবনিতা, ডাইনি, কুমার-কামার, টহলদার-চৌকিদার, চোর-ডাকাত, বাজিকর-বাউল-বোষ্টম_বিভিন্ন শ্রেণীর অবহেলিত, পতিত নিম্নবর্গের মানুষ তাঁর উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য। তাঁর উপন্যাসে একদিকে বর্ণগত শ্রেণী-বৈষম্যের চিত্র, অন্যদিকে অর্থনৈতিক পটভূমিতে নিচুতলার দরিদ্র ও অবহেলিত পতিত মানুষের অস্তিত্ব সংকট, রাজনৈতিক বাস্তবতা, নর-নারীর সম্পর্ক, সামাজিক আন্তক্রিয়া চিত্রিত হয়েছে। তারাশঙ্করের উপন্যাসে গোষ্ঠীজীবনের চিত্র বারবার এসেছে। চেতনে বা অচেতনে পল্লীসমাজ তাঁর প্রিয় বিষয়।

গ্রামীণ পূজা, ব্রত, সংকীর্ণতা, কুসংস্কার বা গ্রামের পুরনো রীতিনীতির ওপর আধুনিক যুগের প্রভাব অত্যন্ত তীব্রভাবেই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর অনেক উপন্যাসে। প্রকৃতপক্ষে মানুষ যখন থেকে লিখতে ও ভাবতে শিখেছে তখন থেকেই ইতিহাস, ঐতিহ্য ও পরিবেশ তার চিন্তাকে অধিকার করেছে। খনার বচন যেমন সুদূর অতীতকে আজো চিরজীবন্ত করে রেখেছে। তার "হাঁসুলী বাঁকের উপকথা" (১৯৬২) চলচিত্র তৈ্রি করেন- তপন সিংহ ,একজন বিখ্যাত ভারতীয় বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক । অভিনেত্রী অরুন্ধতী দেবী তাঁর পত্নী ছিলেন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.