ছোট কাকা হজ করে দেশে ফেরার সময় আমার জন্য একটা খেলনা প্লেন নিয়ে এসেছিলেন। তখন আমার বয়স সাত-আট। সময় পেলেই রিমোট কন্ট্রলার দিয়ে প্লেনটি চালাতাম। প্লেনটি এদিক-সেদিক ছুটত কিন্তু উড়ত না। উড়তে না পারলেও সেই সময়ে সেই প্লেনটিই ছিল আমার প্রিয় খেলনা।
তখন মনে মনে ভাবতাম বড় হয়ে আমি একদিন সত্যি সত্যিই প্লেন চালাবো। যদিও কৈশোরে পা রাখতেই বুঝতে পেরেছিলাম আমার পক্ষে পাইলট হওয়া সম্ভব না।
ছোট কাকা শহরে ব্যবসা করতেন। তার পরিবার নিয়ে সেখানেই থাকতেন। ঈদ বা গ্রীষ্মের ছুটিতে কাকা তার ছেলেমেয়ে নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসতেন ছুটি কাটাতে।
আর সেইসব দিনগুলো আমার সবচেয়ে ভাল যেত। স্কুলে যেতে হতনা, সারাদিন কাকাতো ভাইবোনদের সাথে খেলে আর ঘুরাঘুরি করে দিন কাটাতাম।
কাকাতো ভাইবোনদের মাঝে এক বোন রিমু’র সাথে সবচেয়ে বেশি সখ্যতা ছিল আমার। রিমু বয়সে আমার থেকে দেড় বছরের বড় ছিল। তবে আমরা একে অপরকে বন্ধুর মতই ভাবতাম।
সারা গ্রাম আমরা দুজন ঘুরে বেড়াতাম। তবে শৈশব ছেড়ে কৈশোরে পৌছাতেই সেই বন্ধুত্বে ভাটা পড়ল। ‘ছেলে আর মেয়ে বড় হইলে একসাথে থাকতে অয় না’- পারিবারিক এই অনুশাসনের কাছে হার মানে আমাদের নিষ্পাপ বন্ধুত্ব।
অন্যান্য যে কারো চেয়ে ছোট কাকা সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন আমাকে। যতবার আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসতেন ততবারই আমার জন্য কিছু না কিছু নিয়েই আসতেন।
শার্ট, প্যান্ট, খেলনা ইত্যাদি। ধার্মিক মানুষ ছিলেন বলে আমাকে প্রায়ই নামাজ পড়তে বলতেন। মাঝে মাঝে তার সাথে করে আমাকে মসজিদে নিয়ে যেতেন। একবার বেড়াতে এসে কাকা দেখলেন যে আমার জ্বর হয়েছে। আমাকে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখে কাকার সে কি উৎকণ্ঠা।
ডাক্তার ডাকা, ওষুধ কেনা এমনকি মাথায় পানি ঢালা সব নিজে করলেন। তারপর...
তারপর এক ঈদে শুরু হোল প্রচণ্ড ঝড়। সেই ঝরে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল সব। আমার বাবা আর ছোট কাকা নিজেদের ভাই-ভাই সম্পর্ক ছিন্ন করলেন, সাথে ছিন্ন হল পারিবারিক সম্পর্কও। বাবার বাধ্য সন্তানের মত আমিও ভুলে গেলাম ছোট কাকার সব আদর-ভালবাসা।
তারপর কেটে গেছে অনেকবছর। ছোট কাকার সাথে আমাদের কোন প্রকার যোগাযোগ নেই। আজ টি.এস.সি থেকে আজিজ মার্কেটে যাচ্ছিলাম বন্ধুদের নিয়ে। ফুটপাত দিয়ে হাটার সময় হটাত এক লোক আমার হাত টেনে ধরলেন। মুখভরা পাকা দাড়ির লোকটিকে প্রথমে চিনতে পারছিলাম না।
পরে সেই পরিচিত কণ্ঠের ডাক শুনে বুঝলাম এনি আমার সেই ছোট কাকা।
খুব অবাক হচ্ছিলাম এটা ভেবে যে কাকা আমাকে চিনলেন কিভাবে। তিনি আমাকে শেষবার যখন দেখেছিলেন তখন আমার বয়স তের-চোদ্দ। আমার চেহারায় অনেক পরিবর্তন এসেছে এতদিনে। তের-চোদ্দ বছরের ছেলেটির মুখে আজ চে-গুয়েভারার মত দাড়ি।
‘রাজু, বাপ, কেমন আছস?’- কাকার কণ্ঠ শুনে আমার ঘোর কাটল। কিন্তু কি বলবো তা ভেবে পেলাম না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম তার মুখের দিকে। কাকা আরো কি কি যেন বলছিলেন কিন্তু আমি তার কথা খেয়াল করছিলাম না। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম কাকার চোখের পানি কীভাবে একটু একটু করে জমে ভাসিয়ে দিল দুচোখ।
তারপর তা চোখের কোণা বেয়ে নেমে এসে গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। এক অসহায় নিরীহ বালকের মত আকুতির ছাপ কাকার চখে-মুখে। মুখ খুলে ক্ষমা চেতে পারলো না কাকা। তবে চেহারায় তা ফুটে উঠল স্পষ্ট।
আমার কিছু বলার ছিল না।
পাশ কাঁটিয়ে হেঁটে চলে এলাম অনেক দূরে। একবার ফিরে তাকিয়ে দেখলাম কাকা বিমূঢ়ের মত দারিয়ে আছেন সেইখানেই। জানিনা, ছোট কাকাও কি আমার চোখেমুখে কোন লুকিয়ে থাকা আকুতির চিহ্ন পেয়েছিলেন কিনা?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।