বহুমুখী সমস্যায় জর্জরিত এফডিসি। ফ্লোর, মেকাপ রুম, কালার ল্যাব, প্রশাসনিক ভবনসহ সংস্থাটি এখন শ্রীহীন ও সংস্কারবিহীন অবস্থায় পড়েছে। এতে এখানে বিদেশি অতিথিদের আমন্ত্রণ জানাতে গিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন চলচ্চিত্রকাররা। চলচ্চিত্র নির্মাণেও বেগ পেতে হচ্ছে তাদের। চলচ্চিত্রকাররা এফডিসিকে এখন গোডাউন বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
সংস্থাটিকে ডিজিটালের আওতায় আনার দাবিও দীর্ঘদিনের। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এখানে স্থাপিত এবং বর্তমানে প্রায় নষ্ট মেশিনে জোড়াতালি দিয়ে কাজ চলছে। ২০০৪ সালে সংস্থাটিতে ডিজিটাল কমপ্লেঙ্ স্থাপনের জন্য সরকার ২১ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল। কিন্তু সেই অর্থ লুটপাটের কারণে ডিজিটাল কমপ্লেঙ্টি আজও আলোর মুখ দেখেনি। ২০১১ সালের ১৮ অক্টোবর একনেকের বৈঠকে এফডিসির আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্প প্রস্তাবটি পাস হয়।
মাত্র ৫৮ কোটি টাকার এ প্রকল্প এখনো দরপত্র আহ্বানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। চলচ্চিত্রকারদের কথায়, ১৯৫৭ সালে এফডিসি প্রতিষ্ঠার পর ৫৭ বছরে ৩২ বার এমডি বদল হয়েছে। কিন্তু এফডিসির ভাগ্যের বদল হয়নি। অনেক এমডির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে চলচ্চিত্রকারদের। এফডিসিতে একটি সাব টাইটেল মেশিন থাকলেও সেটি অকেজো।
ছয় বছর আগে কোটি টাকা ব্যয়ে ডিটিএস মেশিন কেনা হলেও ত্রুটিপূর্ণ থাকায় আজও তা সচল হয়নি। একই সময়ে কেনা ডিজিটাল এডিটিং মেশিনগুলোও অচল। সংস্থার একমাত্র কালার ল্যাবের মেশিনগুলো পুরাতন হওয়ায় প্রায় সময় বিকল হয়ে যায়। যন্ত্রাংশ স্থানীয় বাজারে না থাকায় টেন্ডার আহ্বান করে বিদেশ থেকে আমদানি করতে গিয়ে অতিরিক্ত সময় লাগে। এফডিসির স্টোর ব্যবহার অনুপযোগী হওয়ায় সেখানে নষ্ট হয়ে গেছে কালজয়ী চলচ্চিত্রের সব নেগেটিভ ও প্রিন্ট।
সাউন্ড নেগেটিভের অভাবে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে গিয়ে লোকসানে পড়তে হয় নির্মাতাদের। ঝরনা স্পটের ঝরনা অকেজো। সুইমিংপুল ময়লা আবর্জনায় ভর্তি। এফডিসির পুরো আঙিনাজুড়ে শুধুই আবর্জনার স্তূপ। যত্রতত্র পোস্টার লাগানো এবং চুনকাম না করায় শ্রীহীন অবস্থায় রয়েছে সংস্থার ভবন ও বাউন্ডারি দেয়ালগুলো।
নয়টির মধ্যে চালু সাতটি শুটিং ফ্লোরের অবস্থাও জরাজীর্ণ। প্রায় সময় ফ্লোরের ফলস সিলিং ও আস্তরণ খসে পড়ে আহত হন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা। এফডিসির প্রতিষ্ঠালগ্নে নির্মাণ হয় ১নং ফ্লোরটি। অথচ অর্ধশত বছরেও কোনো সংস্কার হয়নি এটির। ২নং ফ্লোরটি ২০১১ সালে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল নিজস্ব অনুষ্ঠান নির্মাণের প্রয়োজনে সংস্কার ও এতে শীতাতপ যন্ত্র স্থাপন করে।
৩ ও ৪ নং ফ্লোর দুটি মমতাজ আলা শাকুর আহমদ এমডি থাকাকালে যৎসামান্য সংস্কার করা হয়। ৫ ও ৬নং ফ্লোর দুটি দীর্ঘদিন ধরে স্টোর রুম হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। ৭ নম্বর ফ্লোরটির বয়স চলি্লশের কোঠায়। স্থাপনের পর থেকে এটিরও কোনো সংস্কার হয়নি। ৮ ও ৯ নম্বর ফ্লোর দুটি '৯০ দশকে স্থাপিত হয়।
কিন্তু এখানে পুুকুরভর্তি করেই সঠিকভাবে পাইলিং ও সয়েলটেস্ট না করে ভবন নির্মাণ করায় ইতোমধ্যে ভবনের বিভিন্ন স্থানে ফাটল ধরেছে এবং দেয়ালের আস্তরণ খসে পড়ছে। চলচ্চিত্রকাররা বলছেন এই ভবনটি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। মেকআপ রুমগুলোও অপরিচ্ছন্ন এবং এ সংলগ্ন টয়লেটগুলো নিয়মিত পরিষ্কার না করায় দুর্গন্ধে শিল্পীদের এখানে বসতে কষ্ট হয়। এফডিসির প্রবেশদ্বারেই রয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাস্কর্য। এটি চরম অবহেলায় নোংরা আবর্জনার মধ্যে পড়ে আছে।
এডিটিং ভবনের বারান্দাগুলো স্টিলের আলমারি দিয়ে দখল করে রেখেছে বিভিন্ন প্রযোজনা সংস্থা। তাই এখানে হাঁটাচলায় সমস্যা হয়। এই অভিযোগ করে এডিটরস গিল্ডের সভাপতি আবু মুসা দেবু বলেন, এখন ডিজিটাল প্রযুক্তিতে চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়। তাই নেগেটিভ রাখার প্রয়োজন নেই। তারপরেও নেগেটিভের কথা বলে অবৈধভাবে ভবনের বারান্দাগুলো দখল করে রাখা হয়েছে।
জহির রায়হান কালার ল্যাবটি ল্যাবে ব্যবহৃত কেমিক্যালের বিরূপ প্রভাবে দেয়াল ও ছাদের আস্তরণ খসে পড়ছে এবং ভবনটি ধসের মুখে পড়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কজন চলচ্চিত্রকার বলেন, অত্যাবশ্যকীয় লোকের পরিবর্তে এখন বহিরাগতদের দখলে রয়েছে এফডিসি। ঝরনাস্পট, কড়ইতলা, আমতলাসহ আনাচে কানাচে অবাধে চলে অসামাজিক কর্মকাণ্ড। এঙ্ট্রা নারী শিল্পীর নামে অহরহ এখানে আনা হয় পতিতা। তাছাড়া মাদকসেবনেরও আসর বসে প্রতিনিয়ত।
অথচ সংস্থার প্রবেশ দ্বারেই রয়েছে পুলিশ চৌকি এবং প্রায় ৩০ জন প্রহরী। চলচ্চিত্রকারদের অভিযোগ এরা অর্থের বিনিময়ে যে কাউকে ভেতরে প্রবেশের সুযোগ করে দেয়। পাস নিয়ে প্রবেশের বাধ্যবাধকতা থাকলেও এখন তার বালাই নেই। মেটাল ডিটেকটর দিয়ে মানুষ এবং গাড়ি চেকের ব্যবস্থাও নেই। খোদ প্রশাসনিক ভবনই রয়েছে শ্রীহীন অবস্থায় এবং এখানেও নেই কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
চলচ্চিত্রকারদের কথায় এখানে কোনো প্রশাসন আছে বলে মনে হয় না। প্রশাসনের নামে চলে স্বজনপ্রীতি আর দুর্নীতি। তাই প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড সবসময়ই স্থবির। এফডিসির এমডি পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, রাতারাতি সব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। যোগদানের পর থেকেই সংস্থাটিকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করছি।
শীঘ্রই আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। তাই অচিরেই বদলে যাবে এফডিসির চেহারা। চলচ্চিত্রকারদের দাবি ২ এপ্রিল জাতীয় চলচ্চিত্র দিবস। এর আগেই যেন পরিচ্ছন্ন ও পরিপূর্ণ চেহারা ফিরে পায় এফডিসি। ওইদিন সুশ্রী এফডিসিতে তারা বসাতে চান চলচ্চিত্রের মিলনমেলা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।