"আরে লেখক সাহেব! একটা অটোগ্রাফ দেন!"
অ্যালি আপুর কথা শুনে লজ্জা পেয়ে গেলাম। বিব্রত হলাম তারচেয়ে বেশি। পার্টিতেতো শুধু আমি একা না, সাথে বন্ধুবান্ধবও আছে। এইরকম সরাসরি প্রশংসা শুনে আমি অভ্যস্ত নই।
আপু তাঁর স্বামী হাসিব ভাইকে বললেন, "অ্যাই মাহীন, তুমি কাগজ কলম বের করতো!"
হাসিব ভাই এমনভাবে নড়েচরে উঠলেন, যেন আসলেই তিনি কাগজ কলম বের করবেন।
আমি বললাম, "আরে থাক! থাক! যা প্রশংসা করলেন, এতেই আমি....."
শব্দটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। "উদ্ভাসিত" ধরনের কঠিন শব্দ সাধারণ কথাবার্তায় ব্যবহারের অভ্যাস নেই কিনা।
হাসিব ভাই বললেন, "তুমি জানোনা, আমরা প্রতিদিন সকালে উঠে প্রথম যে কাজটা করি তা হচ্ছে, ক্যানভাসে নতুন কিছু ছাপা হয়েছে কিনা তা দেখা। তারপর সেটা পড়ে, নাস্তা করে গাড়িতে ওটা নিয়ে ডিসকাস করতে করতে অফিসে যাই। "
অ্যালি আপু যোগ দিলেন, "তোমার কারনে কিন্তু আমাদের দুজনের মধ্যে ঝগড়াও লাগে!"
আপুর হাসিমুখ না দেখলে একথা শুনে আমি আঁৎকে উঠতাম।
তিনি বাক্য শেষ করলেন, "দেখা গেল, তোমার লেখার কোন একটা বিষয় নিয়ে আমার দৃষ্টিকোণ একরকম, ওর দৃষ্টিকোণ ভিন্ন। ব্যস, লেগে গেল ঝগড়া!"
হাসিব ভাই এবারে বললেন, "আমাদের কিন্তু এ ছাড়া এতসহজে ঝগড়া লাগেনা। হাহাহা। "
কিছু লিখলে লেখার নিচে ফিডব্যাক পাওয়া একরকম, আর এরকম সামনা সামনি ফিডব্যাক পাওয়া আরেকরকম অনুভূতি। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে পার্টিতে যাবার পর শুধুমাত্র এই কনভার্সেশনই সব ক্লান্তি দূর করে দিল।
দাওয়াতের ভাত-মাংসের মজা কয়েকগুণ বেড়ে গেল, ডেজার্টের পুডিংয়ের মিষ্টি এখন একদম পারফেক্ট মনে হলো!
হাসিব ভাই বললেন, "অনেকদিন পর বুঝতে পারলাম ফেসবুকের মিনিংফুল একটা প্রয়োগ আছে। তোমাদের ক্যানভাস আমাকে সেটা বুঝিয়েছে। ধন্যবাদ!"
পাশে বসা তারেক, যে ক্যানভাসের জন্মের জন্য সমানভাবে দায়ী, এবং অতিরিক্ত আলসেমির কারণে যে লেখালেখি করেনা, এতক্ষণে কথা বলে উঠলো, "থ্যাংক ইউ!"
যাঁরা বাংলায় টাইপ করেন, তাঁরা জানেন "ইহা অনেক কষ্টসাধ্য একটি ব্যাপার। " আমার এক পেজ বাংলায় টাইপ করতে সময় লাগে পনের থেকে বিশ মিনিট। এরমাঝে বানান-গ্রামার খেয়াল করতে গেলে সময় বেড়ে যায় তখন আরও দশ মিনিট।
মোটামুটি দুই পৃষ্ঠা সাইজের একটি লেখা লিখতেই তাই ঘন্টাখানেক সময় লাগে। এত কষ্টের মূল প্রেরণা অ্যালি আপু, হাসিব ভাই, কানিজ আশা, তানভীর ভাই, সুমাইয়া আপু, নীলুফার চৌধুরী(জাপান), আদিত্য স্পার্টান, আলী আকরাম, সেলিনা "রোজী" পারভীন এবং এরকম অসংখ্য পাঠক পাঠিকারা। যাঁরা প্রতিদিন সকালে উঠে ফেসবুকে দেখেন ক্যানভাসে কেউ কিছু লিখেছে কিনা। এই প্রেরণার জন্যই রাফায়েল মুরসালীন, দিলরুবা শারমিন মৌটুসীরা নিয়মিত লিখে যান। রানিয়া রাহীম মাঝে মাঝে ডুব দিলেও মাঝে মাঝে ফিরে ফিরে আসে।
সামারা তিন্নি, ডাক্তারি পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকেও চমৎকার সব লেখা উপহার দেয়। সাদেকুর রহমান, কোথাও কোন ভাল কিছু পেলে শেয়ার করেন। সাজিদ মাহমুদ নিজের বাবাকেও নিয়ে এসেছে ক্যানভাসে। এছাড়াও আছেন রাজ বাবু। যিনি তাঁর কাব্যগ্রন্থ থেকে প্রতিদিন একটি করে চমৎকার কবিতা শেয়ার করেন।
আর রয়েছেন ইকবাল খান কাকন ভাই। নিজের লেখায় আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন হাওরপাড়ের মানুষদের সাথে।
বাড়ি যাওয়ার আগে হাসিব ভাই বললেন, "তোমাকে একটা ইনফরমেশন দেই, আমিও মাঝে মধ্যে লেখালেখি করি। দেশে থাকতে আমি কিন্তু ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে বাংলায় পড়তাম। "
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, "বাংলায় পড়াশোনা করাতো ভীষণ কঠিন!"
হাসিব ভাই হেসে বললেন, "তাহলে তোমাকে একটা কাহিনী বলি।
আমি এমন একটা কলেজে(নটরডেম) পড়েছি, যেখানে আমার সব বন্ধু বান্ধবরা পাশ করার পর ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে গেল। আমিই কেবল ভর্তি হলাম বাংলায়। তাও ইচ্ছাকৃত না। ভর্তি পরীক্ষা দিলাম, নম্বর অনুযায়ী চান্স পেলাম বাংলা ডিপার্টমেন্টে, ভর্তি হয়ে গেলাম। আমার আব্বা আমাকে দেখলেই বলতেন, "এই গাধা দূর হ!" অথচ নিজের বন্ধু বান্ধবদের সামনে পার্ট নিতেন, "ছেলে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে।
খুবই কঠিন সাবজেক্ট সিলেক্ট করেছে, বুঝলেন। " তারপর বিরতি নিয়ে বলতেন, "বাংলা!"
কার্জন হলের সামনে দিয়ে গেলেই বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেখা হয়ে যেত। ওরা পড়াশোনা করছে অ্যাপ্লাইড ফিজিক্স নিয়ে, ওরা জিজ্ঞেস করতো, "কিরে, তোরে ক্লাসে দেখিনা কেন?"
আমি কাউকে আর লজ্জায় বলতাম না বাংলা ডিপার্টমেন্টে পড়ি। তখন বেশিরভাগ মেয়েরাই বাংলা পড়তো। তারপর দেশ ছাড়ার পরে সবাইকে বলেছি, "দোস্ত! আমিতো কলাভবনে ক্লাস করতাম।
"
হাসিব ভাই ইঞ্জিনিয়ার। বেচারাকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। সেই ১৯৯৭-৯৮ সালের কথা, তখনও এত এত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গজিয়ে উঠেনি। দারুন দারুন মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের পছন্দের বিষয়ে পড়াশোনা করতে দেশ ছাড়তে হয়েছে। যারা পারেননি, তাঁদের পড়তে হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে 'গছিয়ে দেওয়া' সাবজেক্টে।
আমি এমন হিন্দু ছেলেকে চিনি, যে "ইসলামিক স্টাডিজ" নিয়ে পড়াশোনা করেছে। সে বেচারা পাশ করে কি করবে? মসজিদের ইমামতি?
হাসিব ভাই জানালেন ইসলামিক স্টাডিজে পাশ করে ব্যাংকে ভাল চাকরি পাওয়া যায়। তাঁর দুইজন বন্ধু আছেন যারা এখন দুটি আলাদা আলাদা ব্যাংকে বড় বড় পজিশনে চাকরি করছেন। তারপরেও, যে ছেলে ব্যাংকে চাকরি করতে চাইবে, সে ইসলামিক স্টাডিজ পড়বে কেন?
আমি যতদূর জানি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে "উর্দু" ডিপার্টমেন্ট এখনও আছে। জানার খুব শখ, ওখানে কারা পড়াশোনা করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ ক্লাস রাতে হবার প্রতিবাদে আমি ছাত্রছাত্রীদের বিক্ষোভ করতেও দেখেছি। যেসব স্টুডেন্ট পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি করতে চান, তাঁদের সুবিধার দিকটা কেউই দেখলো না? আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন কিছুই পরিবর্তন করা যায়না, শিক্ষক, ছাত্র সংগঠনগুলো হইচই শুরু করে দেয়। কিন্তু "নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে" দেখলে কারও কি মনে হয়না আমাদের সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কিছু পরিবর্তন আনা বিশেষ জরুরী হয়ে পড়েছে?
অ্যামেরিকায় এই একটা সুবিধা। যে যা খুশি সাবজেক্ট নিয়ে পড়াশোনা করতে পারে। কেউ ইঞ্জিনিয়ার হতে চাইলে ইঞ্জিনিয়ারিং ক্লাস নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যায়।
যদি পাশ করতে পারে, তাহলেতো কেল্লাফতে। যদি না পারে, তাহলে ভিত শক্ত করার জন্য প্রি-রেকুইজিট ক্লাস নিতে পারে। যদি তাও কঠিন মনে হয়, তাহলেও নন ক্রেডিট কিছু ক্লাস নিতে পারে ভিত আরেকটু মজবুত করার জন্য। মোট কথা, এখানে নিজের শখের বিষয় নিয়ে পড়াশোনার সুযোগ আছে। যে মিউজিশিয়ান হতে চায়, মিউজিকের উপর তাঁদেরকেই ডিগ্রী নিতে দেখি।
যে লেখক হতে চায়, তাঁকেই কেবল দেখি লিটারেচারে ডিগ্রী নিতে। তেমনি থিয়েটার, ডান্স এসবের উপরও ডিগ্রী আছে। যাঁরা সাধারণ চাকরি করতে চায়, তাঁদের জন্য আছে আমাদের অ্যাকাউন্টিং, ফাইন্যান্স, ইঞ্জিনিয়ারিং সাবজেক্টগুলো। এই নিয়মটা কি আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করা সম্ভব হতো না?
অনেকেই বলবেন এত স্টুডেন্ট কি করে ক্লাস করবে? উদাহরণ হতে পারে ধানমন্ডির "স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়" আছে। আমার মনে আছে, আমাদের সময়ে ভাড়া করা কয়েকটা বাড়িতেই তারা হাজার হাজার ছাত্র ছাত্রীর ক্লাসের ব্যবস্থা করে ফেলতে পারতেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটের মত বিরাট বিরাট ক্যাম্পাসের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি তা পারবে না? একটা ক্লাস শেষ হলেই কিন্তু সেখানে ক্লাসরুম ফাঁকা পড়ে থাকে।
ব্যাচে ব্যাচে সেখানে ক্লাস হলে সমস্যা কোথায়? কোয়ালিটি নেমে যাবে বলে ভয়? তাহলে বিশ্বের সেরা দুইশো বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও নেই কেন? তার মানে সমস্যা অন্য কোথাও। "দূর্বল" ছাত্রছাত্রীরাই কেবল দায়ী নয়।
ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি অ্যামেরিকা খুবই বদমাইশ একটা জাতি। এরা খুবই ধূর্ত। এরা বিশ্বের বুদ্ধিমান মানুষদের মাথা কিনে ফেলে, তারপর বাকিদের নিচে ফেলে নিজেরা উঠে যায়।
বাস্তবেও দেখলাম ঠিক তাই। এরা আসলেই মাথা কিনে নেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা একটি ছেলেকে আমি দেখেছি মাত্র বিশ হাজার টাকায় একটা দেশী কোম্পানিতে চাকরি শুরু করতে। মাস্টার্স পাশ করার পরেও বেচারার বেতন খুব বেশি বাড়েনি। অথচ এখানে এসে পিএইচডি করার সাথে সাথেই সে শুরু করলো বছরে একলাখ ডলারেরও বেশি বেতনের চাকরি দিয়ে।
এতে অ্যামেরিকার দোষ কোথায়? আমরা আমাদের গুণী সন্তানদের মূল্য দিতে পারিনা, ওরা দেয়, ওরা কেন খারাপ হবে? জাতিগতভাবেই আমরা নিজেদের ব্যর্থতা অন্যের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হবার চেষ্টা করি।
বেরিয়ে যাবার আগে পায়ে জুতা চাপাতে চাপাতে হাসিব ভাই বললেন, "এই বিষয়েই কিছু একটা লিখ। "
আমি বললাম, "আমি লিখলে কি কিছু হবে?"
"কে জানে? মানুষের মাথায় আইডিয়াটা ধরায় দাও। কিছু হলে হবে, না হলে নাই!"
আমি লিখে ফেললাম। আশা করি অ্যালি আপু এবং হাসিব ভাই লেখাটি পড়বেন।
এও আশা করি অন্তত আজকের এই লেখা পড়ে তাঁদের মধ্যে ঝগড়া বাঁধবে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।