আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মৃত্যুহীন ভালবাসা

পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় বস্তু হচ্ছে নিজের মন... সবার আগে নিজের মনকে চিনুন... নিজের মনের কাছে অচেনা থাকবেন না ...

ভ্রমনের নেশাটা আমার আজীবনের। যতই ঝামেলাই হোক প্রতি দুমাসে একটা ট্যুর চাইই চাই। সেই রুটিন অনুযায়ী এইবার বেরিয়েছিলাম কাপ্তাই ঘুরব বলে। যাত্রাপথে মাঝে সাঝে আমার অল্পসল্প বমি (আমার ভাষায় ঊর্ধ্বচাপ) হয়। কিন্তু এইবার যাত্রাপথে রাঙ্গুনিয়া পার হবার বেরসিকের মত আমার ভয়াবহ নিন্মচাপ শুরু হল।

পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় আশেপাশে নিন্মচাপ থেকে মুক্তির উপায়ও ছিল না। অবস্থা বেগতিক দেখে রাস্তার পাশেই নেমে পরলাম। প্রায় ১৫ মিনিট হাটার পরে একটা মসজিদ খুঁজে পেলাম। দাতে দাত চেপে মসজিদের কাছে পৌঁছে দেখি টয়লেটে তালা ঝুলছে। আমার অবস্থা তখন প্রায় যায় যায়।

চোখ বন্ধ করে আল্লাহর নাম জপছিলাম। হয়তো এজন্যই আল্লাহ মুখ তুলে তাকিয়েছিলেন। মসজিদের ইমাম সাহেবকে তখন সাক্ষাত দেবদূত মনে হচ্ছিল। চাবি নিয়ে টয়লেটে গিয়ে ফুঁসতে থাকা নিন্মচাপটাকে এক নিমিষেই লঘু করে দিলাম। কিযে শান্তি লাগছিলো তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না।

মনে হচ্ছিল ইমাম সাহেবকে জড়িয়ে ধরি। ইমাম সাহেব আমাকে তার রুমে নিয়ে বসালেন।

প্রত্যন্ত হলেও জায়গাটা অনেক সুন্দর। ইমাম সাহেবকে বেশ বুদ্ধিমান মনে হল। আমরা যেরকম ইমাম দেখে অভ্যস্ত দেখে উনি তার চাইতে আলাদা।

শ্মশ্রুমণ্ডিত হলেও চেহারায় কেমন যেন আভিজাত্য আর বেক্তিত্ত লুকিয়ে আছে। মসজিদের পাশে যে কবরখানা আছে তার দক্ষিন দিকে ছোট্ট একটা চালাঘরে থাকেন। এতো স্মার্ট ইমাম দেখে এমনিতেই অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু উনার সাথে কিছুক্ষন গল্প করে সেই অবাক লাগাটা বেড়ে গেলো। কথার মাঝে ইংরেজির উচ্চারন আর প্রথাগত ধর্মশাস্ত্রের বাইরেও তার অগাথ জ্ঞান দেখে কেমন যেন মেলাতে পারছিলাম না।

পাহাড়ি এলাকায় গণ্ডগ্রামে সাধারণ একটা মসজিদের ইমাম হিসেবে মোটেই মানাচ্ছিল না। আমার একই সাথে যেমন সন্দেহ হচ্ছিল তেমনি লোকটার প্রতি প্রচণ্ড কৌতুহল হচ্ছিল। বেড়ানোর জন্য বেশ ভালোই। এজন্য দুপুর বেলার বাসে কাপ্তাই যাওয়ার প্লানটা বাদ দিয়ে দিলাম। ইমাম সাহেবকে থাকার বেবস্থা করার জন্য বলতেই উনি সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন।

আমি যে সন্দেহ করেছি সেটা তাকে মোটেই টের পেতে দিলাম না। ইমামের বাড়ির পাশেই আমার থাকার বেবস্থা হল। তখনো জানতাম না আমার জন্য কতো বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছে।

দুপুর বেলা ইমামই আমার খাবারের বেবস্থা করলেন। অনেক ক্লান্তি নিয়ে দুপুরে ঘুমিয়ে পরলাম।

বিকেলে ঘুম থেকে উঠে ইমামকে কোথাও খুজে পেলাম না। কবরস্থানের দিকে হাটতে গিয়ে ইমামের দেখা পেলাম। ইমামকে দেখলাম একটা কবরের সামনে দাড়িয়ে জেয়ারত করছেন। কবরটা পুরোটাই শ্বেতপাথরে বাধানো। অন্য কবরগুলোর চাইতে এটা একটু আলাদা।

বোঝা যায় নিয়মিত যত্ন নেয়া হয়। সেইরাতে ইমামের সাথে আরও গল্প হল। আমার মনে হচ্ছিল তিনি কিছু এড়িয়ে যাচ্ছেন। আমিও খুব বেশি জোরাজুরি করলাম না। কিন্তু পরের দিন ভোরবেলা ইমামকে দেখে রীতিমত চমকে গেলাম।

আগেরদিন দূর থেকে দেখে ভেবেছিলাম জেয়ারত করছেন। বেচারা দেখি একা একা কবরের সাথে কথা বলছে। এইরকম বেক্তিত্তের একটা এরকম লোকের সাথে এটা মিলাতে পারছিলাম না। এরপর প্রতিটা নামাজের পরই তাকে ওই কবরটার কাছে দেখতে পেতাম। বুঝতে পারলাম কবরটা তার আপন কেউর।

৪ দিন থেকেও তার সমন্ধে কিছুই জানতে পারলাম না। লোকটাকে প্রথম থেকেই ইসলামী জঙ্গি টাইপ কিছু ভেবেছিলাম। কিন্তু চেহারা আর ব্যবহার দেখে আমার সন্দেহগুলো বাতুল মনে হতো। রুমের ভিতর বিভিন্ন বিষয়ের বই দেখে সন্দেহটা বেড়ে গেল। এই ৪ দিনে তাকে এলাকার লোকজনের সাথে তেমন একটা মিশতেও দেখিনি।

ধর্ম সমন্ধে তার চিন্তাভাবনাও বেশ আধুনিক। সবমিলিয়ে ইমামের ব্যাপারটা আমার পুরোপুরিই ঘোলাটে লাগলো। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম সরাসরি উনাকে জিজ্ঞেস করবো।

রাতের বেলা ইমামের রুমে গেলাম। আমি যাই জিজ্ঞেস করি,তা শুনেই মুচকি হাসেন।

মেজাজটা খুব খারাপ হয়ে গেল। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালাম। কিছুটা নরম ভাবেই তাকে অনুরোধ করলাম। আমার পরিচয় দিলাম। আমার দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষন কি যেন ভাবলেন।

তারপর আমাকে ওয়াদা করালেন যেন তার কথা যেন কারো সাথে শেয়ার না করি এবং ওই এলাকায় যেন আর কখনো না যাই। বিনা শর্তে আমি রাজি হয়ে গেলাম। ওইরাতের ৪ ঘণ্টা যে কিভাবে পার হয়ে টেরই পেলাম না। ইমামের কাহিনী শুনে দ্বিতীয় বারের বিশাল ধাক্কা খেলাম। এরকম কাহিনি হতে পারে কল্পনাও করিনি।



ইমাম সাহেবের আসল নাম মুহাম্মদ হাফিজ আল আসাদ। । বাবার একমাত্র সন্তান ছিলেন তিনি। তার জন্মের আগে আরও ২ জন জন্মের অল্পকিছুদিনের মধ্যেই মারা যায়। তাই জন্মের আগে তার বাবা মানত করেছিলেন সন্তান বড় হলে মাদ্রাসায় পড়াবেন।

ছোটবেলা থেকেই অসম্ভব মেধাবী ছিলেন। তাই মাদ্রাসা শিক্ষাও তার মেধা চেপে রাখতে পারেনি। বুয়েট ভর্তি পরীক্ষায় ১১তম হয়ে তড়িৎ প্রকৌশল শাখায় ভর্তি হন। সেইসময় দেশের রাজনৈতিক অবস্থা খারাপ ছিল। এরশাদের পতনের জন্য নুর হোসেন তখন আন্দোলনে নেমেছেন।

সেই সময় একদিন শাহবাগে মিছিলের মাঝ থেকে ছোড়া ঢিলের আঘাতে মাথায় আঘাত পান। তখন সাধারণ আঘাতই ভেবেছিলেন। কিন্তু লালবাগের ওখানে পৌঁছে টের পেলেন মাথা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। মিলিটারির ভয়ে ঢাকা মেডিক্যালে গেলেন না। লালবাগ মোড়ের সামনে একটা বাসায় ঢুকে পরলেন।

সেই বাসায় গিয়ে সবকিছু খুলে বলার আগেই জ্ঞান হারালেন তিনি। বাসার লোকজন মাথায় পট্টি বেধে কোনরকমে রক্ত বন্ধ করলেন। ৬ঘণ্টা পর তিনি জ্ঞান ফিরে পেলেন। ওই বাসার লোকজনের আন্তরিক সেবাশুশ্রূষায় তিনি মুগ্ধ হয়ে গেলেন। এর মধ্যে হিজাব পরা একটা মেয়েকে মাঝে মাঝে দেখেছিলেন।

নেকাবপরা মেয়েটার শুধু চোখটাই শুধু দেখা যেত। সুস্থ হবার পর হবার পর বেশ কবার ওই বাসায় গিয়েছিল হাফিজ। কিন্তু ওই মেয়েটার আর দেখা পাননি।

মাদ্রাসায় পরলেও বুয়েটের পরিবেশ হাফিজকে ধর্মপালন থেকে বিচ্যুত করতে লাগলো। একসময় আধুনিক হতে গিয়ে দাড়িও কেটে ফেললেন।

ছেলের এইসব কাণ্ড দেখে হাতখরচ বন্ধ করে দিলেন তার বাবা। ভয়ানক অর্থসংকটে পরে হন্য হয়ে টিউশনি খুঁজতে লাগলেন তিনি। অবশেষে লালবাগের সেই বাসা থেকেই একটা টিউশনি জোগাড় করে দেয়া হল। ছাত্রী হল সেই হিজাব পরা মেয়েটি। হাফিজ সেই মেয়েটিকে আরো সাড়ে তিন বছর প্রাইভেট পড়িয়েছিলেন।

কিন্তু কখনো চোখদুটোর বেশি কিছু দেখতে পাননি তিনি। শুধু চোখদুটোরই প্রেমে পরেছিলেন তিনি। দুটো মায়াবী চোখ দেখার লোভই তার টিউশনির মেয়াদটা সাড়ে তিন বছর হয়েছিল। কিন্তু প্রচণ্ড রক্ষণশীল পরিবার তার এই প্রেম সহ্য করতে পারবেনা ভেবেই প্রেমটাকে বুকের মধ্যে পাথর চাপা দিয়ে রাখলেন তিনি। প্রাইভেটটা শেষ হয়ে যাওয়ায় ভয়াবহ শূন্যতা তাকে আঁকড়ে ধরল।

বহু কষ্টে নিজেকে সামলে রাখলেন। পাশ করেই একটা ভালো বেতনের চাকরী পেয়ে গেলেন। কিন্তু সেই চাকরিতে ১৩ দিনের বেশি মন টেকাতে পারলেন না। শত চেষ্টাতেও মেয়েটাকে ভুলতে পারলেন না। নিজের কষ্ট ভুলতে আজমির শরীফ গেলেন।

সেখানের এক খাদেম ঘটকের মাধ্যমে প্রস্তাব পাঠানোর পরামর্শ দিলেন। আল্লাহর উপর ভরসা করে এক মুরুব্বীর মাধ্যমে প্রস্তাব পাঠালেন। মেয়েটির পরিবার কোনরকম বারাগম্বর ছাড়াই রাজি হয়ে গেল। এতো সহজে কাজটা হয়ে যাবে হাফিজ ভাবতেই পারেননি। আল্লাহর প্রতি অদ্ভুত কৃতজ্ঞটায় মনটা ভরে গেল।

পারিবারিকভাবেই হাফিজের বিয়ে হল। প্রিয় মানুষটাকে কাছে পেয়েই বোধহয় বদলে যেতে শুরু করলেন। শৃঙ্খলাময় জীবনে ফিরে আসতে শুরু করলেন। ভালো বেতনের একটা চাকরীও পেয়েও গেলেন। স্ত্রীর তাড়নাতেই আবার দাড়ি রাখলেন,ধর্মচর্চা নিজেকে নিয়োজিত করে ফেলতেন।

আল্লাহর কাছে স্ত্রীকে যেমন ভাবে পেতে চেয়েছিলেন তেমনি পেলেন। এমন কাউকেই চেয়েছিলেন যে কিনা তাকে অন্ধকারে আলোর পথ দেখাবে।

আমার মতোই ভ্রমণের নেশাটা হাফিজের সেই ছেলেবেলা থেকেই ছিল। বুয়েটে পড়াকালে সেমিস্টার শেষ হলেই বন্ধুদের নিয়ে বেড়িয়ে পরতেন। যদি কাউকে না পেতেন একাই বেরিয়ে যেতেন।

প্রতি মাসেই স্ত্রীকে নিয়ে বেরিয়ে পরতেন তিনি। তার স্ত্রী এতিম বাচ্চাদের খুব মায়া করতেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরার সময় বিভিন্ন এতিমখানায় যেতেন। ৬ বছর আগে রাঙ্গুনিয়ার একটা এতিমখানায় যাবার সময় তার জীবনের সবচেয়ে ট্রাজেডিটা ঘটে গেল। বাস হার্ড ব্রেক করায় মাথায় আঘাত খেয়েছিলেন হাফিজের স্ত্রী।

এতিমখানা ঘুরে দেখার সময়ও কোন সমস্যা হয়নি। কিন্তু আসার সময় আদর করে সবচেয়ে ছোট এতিমটা কোলে নিতে গিয়েই মাথা ঘুরে পরে গেলেন। সেই থেকে একনাগাড়ে বমি হতে লাগলো। ৩ দিনের মাথায় শকে চলে গেলেন। ঢাকা নেবার পথেই হাফিজের জীবনসঙ্গিনীর জীবনবসান হয়ে গেল।

সেইদিনই বোধহয় হাফিজ দুনিয়ার যাবতীয় মোহ কাটিয়ে ফেললেন। স্ত্রীর জন্য তার চোখে একফোঁটা জলও দেখা গেলনা। অদ্ভুত শান্ত আর স্থির হয়ে গেলেন। শ্বশুর বাড়ির সবার না সত্তেও রাঙ্গুনিয়ার ওই এতিমখানার কাছাকাছি একটা মসজিদে স্ত্রীকে দাফন করলেন। এখানে তাকে কেউই চেনে না।

চাকরী ছেড়ে দিয়ে রাঙ্গুনিয়া চলে গেলেন। এতো কিছু করেও হাফিজের পাগলামি থামল না। এলাকার মাতব্বরকে ধরে সেই মসজিদে ইমামের চাকরীটা জুটিয়ে নিলেন। সুন্নতি লেবাস আর মাদ্রাসালব্দ জ্ঞান দিয়ে ইমামতির কাজটা ভালভাবেই রপ্ত করেছিলেন। এলাকার লোকজন কখনো জানতেও পারলোনা তাদের ইমাম সাহেব একজন বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার,জানতে পারেনি মসজিদের শ্বেতপাথরে বাঁধানো কবরস্থানটি তাদেরই ইমাম সাহেবের স্ত্রীর।



এইটুকু বলে হাফিজ ইমাম থামলেন। মোমবাতির আলোয় আমি দেখলাম তার চোখদুটো পানিতে টলমল করছে। লোকটার নিস্পাপ চেহারার দিকে তাকিয়ে খুব মায়া লাগছিলো। স্ত্রীকে মানুষ এতোটা ভালবাসতে পারে জানা ছিল না। স্ত্রীর স্মৃতিকে ধরে রাখতেই সবকিছু ছেড়েছুরে এই পাড়াগাঁয়ে পরে আছেন।

অথচ এই লোকটা সমন্ধে আমি কি আজেবাজেই না ভেবেছি। সেইরাতে আর ইমামের সাথে কথা হল না। পরেরদিন ভোরে ফজর নামাযের পর ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। দূর থেকে শ্বেতপাথরে বাঁধানো কবরটা দেখা যাচ্ছে। ইমামকে দেখলাম পরম মমতায় কবরের ঘাসগুলো পরিস্কার করতে আর বিড়বিড় করে কি জানি বলতে।

এমন ভাবে কথা বলছে যেন আপন কেউ তার সামনে দাড়িয়ে আছে। ২৮ বছরের জীবনে অনেকবারই ভ্রমনে বের হয়েছি। কিন্তু এবারের মতো এমন অদ্ভুত ভ্রমন আর হয়নি। রাঙ্গুনিয়ার ওই মসজিদের ইমামের কথা কোনদিনই ভুলতে পারব না। ভুলতে পারবোনা শ্বেতপাথরের কবরে শুয়ে থাকা পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবতী নারীটির কথা।

বরং মৃত্যুটাই যেন স্বামীর ভালবাসার বাঁধটা আরও ভেঙ্গে দিয়েছে। প্রায়ই ইচ্ছা হয় ইমামকে একবার দেখে আসি। কিন্তু নিজেকে অনেকে কষ্টে দমিয়ে রাখি। আমি চাই না ইমামের ভালবাসাটা তার লোকজন জেনে যাক। বাসুক না সে ভালো...একটু আড়ালে আবডালে,করুক না পুজা ভালবাসার,গেয়ে যাক প্রেমেরই জয়গান...




অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।