আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মার্চেই সিদ্ধান্ত নিই অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে মুক্তিযুদ্ধে

রক্তভেজা পথ ধরেই এসেছিল ১৯৭১-এর মার্চ। এই মাসের ব্যাপ্তি ক্যালেন্ডারের পাতার হিসাব দিয়ে নির্ণয় করা যাবে না। ১ মার্চ ইয়াহিয়া সংসদ অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা দিলে বাঙালি গর্জে ওঠে। ২৫ দিনের একটানা অসহযোগ আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরু করে। এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় হানাদার বাহিনীর সঙ্গে আমাদের সশস্ত্র লড়াই।

১ মার্চ আমি অনার্সের শেষ দুটি বিষয়ের পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু ইয়াহিয়ার ঘোষণা কানে আসামাত্র আমি সিদ্ধান্ত নেই পরীক্ষা আপাতত স্থগিত। নামতে হবে রাজপথে, তৈরি করতে হবে সশস্ত্র প্রতিরোধ বাহিনী। অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে মুক্তিযুদ্ধে। অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলোতে আমরা প্রস্তুতি শুরু করলাম।

২৫ মার্চ রাতের অাঁধারে পাকিস্তানি বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আক্রমণ শুরু করলে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে সারা বাংলায়। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রত্যক্ষ সশস্ত্র লড়াইকে এগিয়ে নিতে কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়ন সমন্বিতভাবে বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করে। অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীতে আওয়ামী লীগ নেতারা ছাড়াও কমিউনিস্ট পার্টির কমরেড মণি সিংহ, ন্যাপের অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ ও মওলানা ভাসানী এবং কংগ্রেসের মনোরঞ্জন ধর অন্তর্ভুক্ত হন। এ ছাড়া রাশেদ খান মেনন ও হায়দার আকবর খান রণোর নেতৃত্বাধীন বামপন্থি শক্তির সঙ্গে সেতুবন্ধন গড়ে তোলার জন্যও চেষ্টা করা হয়।

অক্টোবর মাসের দিকে এফএফ, বিএলএফ, বিশেষ গেরিলা বাহিনী প্রভৃতি পৃথক পৃথক গেরিলা যোদ্ধাদের মধ্যে সমন্বয় গড়ে তোলার জন্য যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, তার পেছনে একটা প্রধান উদ্যোগ ছিল কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের। ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের অনেক তরুণ কর্মী বিভিন্ন সেক্টর কমান্ডারের অধীনে গঠিত এফএফ বাহিনীতে যোগ দিয়ে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে। ঢাকার ক্র্যাক প্লাটুনসহ বিভিন্ন এলাকার ঐতিহাসিক সাহসী অপারেশনগুলোতে বামপন্থি তরুণরা তাদের দেশপ্রেম, সাহস ও নিষ্ঠার প্রমাণ রেখেছে। মে মাসে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের 'বিশেষ গেরিলা বাহিনী' গঠনের কাজ শুরু হয়। জুন মাসের মধ্যে ছয় সপ্তাহের বিশেষ ট্রেনিংপ্রাপ্ত এই বাহিনীর প্রথম দল প্রশিক্ষণ শেষ করে বেইস ক্যাম্পে সংগঠিত হওয়া শুরু করে।

গেরিলা যুদ্ধ কৌশলের এসব বিশেষ সামরিক প্রশিক্ষণ শিবিরে পাঠানোর আগে প্রাথমিক প্রশিক্ষণের জন্য বিস্তৃীর্ণ এলাকাজুড়ে বিভিন্ন স্থানে কয়েক ডজন ইউথ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। নেতাদের তত্ত্বাবধানে এসব ক্যাম্পে হাজার হাজার তরুণ রাজনৈতিক মতাদর্শগত ও আধাসামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে থাকে। জুলাই মাসের শেষ দিক থেকে বিশেষ গেরিলা বাহিনীর এসব সদস্য পৃথক পৃথক গেরিলা দলে বিভক্ত হয়ে দেশের অভ্যন্তরে অবস্থান নিতে শুরু করে। দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের চিন্তা কৌশল অবলম্বন করে এ দলগুলো নিজ নিজ ভিত্তিভূমি রচনা করতে শুরু করে। কিছু কিছু দল সেপ্টেম্বর মাস থেকে ছোটখাটো অপারেশন আরম্ভ করে।

একে একে চারটি ব্যাচের প্রশিক্ষণ শেষ হতে হতে এসে পড়ে নভেম্বর মাস। তখন ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি রূপ নাও নিতে পারে। নভেম্বরের মাঝামাঝির পর যুদ্ধের কায়দা বদল করে 'সরাসরি মোকাবিলা' কৌশল গ্রহণ করা হয়। কিন্তু এ সিদ্ধান্তে উত্তরণের প্রক্রিয়া চলাকালেই ১১ নভেম্বর বেতিয়ারায় ঘটে যায় হানাদারদের সঙ্গে সম্মুখ সমরে যুদ্ধ। এতে শহীদ হন আজাদ, মুনীর, রশিদ, দুদু মিয়া, শহীদসহ ৯ জন বীর গেরিলা।

ইতোমধ্যে দেশের অভ্যন্তরে অবস্থানরত গেরিলা গ্রুপগুলো প্রত্যক্ষ 'অপারেশন'-এর কাজ বাড়িয়ে দেয়। ডিসেম্বরের শুরুতেই ঢাকার চতুর্দিকে গেরিলাদের একটি বৃত্ত রচনার অপারেশন শুরু করা হয়। গেরিলাদের এক বিরাট বাহিনী ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে পেঁৗছে যায় ঢাকার উপকণ্ঠে। গজারিয়া, কেরানীগঞ্জ, নবাবগঞ্জ, দোহার প্রভৃতি এলাকা দিয়ে দক্ষিণ দিক থেকে গেরিলা দলগুলো অস্ত্রসজ্জিত হয়ে ও সমর সম্ভার নিয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এই এগিয়ে যাওয়া পথেই ১৬ ডিসেম্বর দুপুরের পরে ঘোষণা আসে হানাদার পাক বাহিনীর আত্দসমর্পণের।

রাত ভোর হতেই গেরিলা দল রাজধানী অভিমুখে মার্চ শুরু করে দেয় এবং সকালের মধ্যে পেঁৗছে যায় ঢাকা শহরে। বিধ্বস্ত শহীদ মিনারে অস্ত্র উঁচিয়ে মুক্তিযোদ্ধারের প্রথম যে দলটি শপথ নেয় তা ছিল ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের 'বিশেষ গেরিলা বাহিনী'র। হানাদারমুক্ত স্বাধীন দেশের আকাশে-বাতাসে তখন কোটি কোটি মানুষের কণ্ঠের বিজয়ের জয়ধ্বনী। লাখো শহীদের রক্তে মুক্ত স্বদেশ। সেই রক্তে মিশেছে কমিউনিস্ট পার্টি-ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়নের অগণিত কমরেডের রক্ত।

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/index.php     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।