ক’দিন আগে একখানা বই পড়তে পড়তে চমকে গেলাম আমাদের মস্তিষ্কের এক অপারগতা সম্পর্কে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখিত একটি গল্প দেখে। আপাতদৃষ্টিতে সহজ এক গাণিতিক ফাঙ্কশন অনুধাবন করতে গিয়ে আমাদের মনে যে কেমন ধন্ধ লেগে যেতে পারে, তা বলতে গিয়ে লেখক উদাহরণ টেনেছেন দাবা খেলার আবিস্কার-কাহিনীর।
অনেকেরই হয়তো জানা যে দাবার আবিস্কার হয়েছিল প্রাচীন ভারতবর্ষে। “চতুরঙ্গ” নামে এর আবির্ভাব ষষ্ঠ শতাব্দীতে, গুপ্ত সাম্রাজ্যে। তারপর পারস্যদেশে এর প্রসার, ততদিনে খানিকটা বদলে গেছে চেহারা, নিয়েছে নাম “শতরঞ্জ”।
যাইহোক মজার গল্পটা আসলে দাবা যে ব্যাক্তিটি আবিস্কার করেছিল তাকে নিয়ে। কিংবদন্তী আছে সেসা নামের এক ব্রাহ্মণ পন্ডিত ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় পাড়ি জমায় পাটালীপুত্র অভিমুখে, পাটালীপুত্র তখন প্রতাপশালী গুপ্তসাম্রাজ্যের রাজধানী। সাথে তার নিজের আবিষ্কৃত এই অভিনব খেলা। সমঝদার, বুদ্ধিমান রাজা দাবার সৌন্দর্যে যারপরনাই মুগ্ধ হয়ে পন্ডিতকে একটি ইচ্ছাপূরণের সুযোগ দিলেন। পরিবারের জন্যে কটা চাল ছাড়া আর কিছুই চাইল না পন্ডিত।
রাজা বেশ অবাকই হলেন এমন অমায়িক, নির্লোভ ব্যবহারে।
রাজা যেহেতু দাবা দেখে এত মুগ্ধ হয়েছেন সেজন্যে দাবার বোর্ড দিয়েই নির্ধারণ করা হবে চালের পরিমাণটা এই ছিল চালাক পন্ডিতের ইচ্ছে। প্রথম ঘরে একটা চালের দানা দিয়ে শুরু করতে হবে, দ্বিতীয় ঘরে থাকবে দুটো, তৃতীয় ঘরে চারটে, এভাবে চলতে থাকবে একের পর এক; প্রতি ঘরে থাকবে তার পূর্ববর্তী ঘরে যা চালের দানা আছে তার দ্বিগুণ পরিমাণ দানা। গুপ্তরাজ ভাবলেন, “এ আর কি?”, তেষট্টিটি ঘরে দ্বিগুণিতক সংখ্যার বিশালত্ব সম্পর্কে কোন ধারনা না করেই আদেশ দিয়ে দিলেন কোষাধ্যক্ষকে। তবে বত্রিশ ঘর ভরবার পরই বুঝতে পারলেন পথে বসবেন তিনি এই বেয়াড়া আবদার রক্ষা করতে হলে, ইতিমধ্যে এক মাঠ ভরা চার বিলিয়ন চালের দানা দেখে মাথায় হাত পড়েছে সভাসদের।
অবশেষে রাজামশাই বুঝলেন যদি পুরো প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হয় তবে পরিমাণটা হবে, চালের দানা, আঠারো কুইন্টিলিয়ন (বিলিয়ন বিলিয়ন)–এর চাইতেও বেশি; এক জায়গায় জড়ো করলে এভারেস্ট পর্বতশৃঙ্গকেও হার মানাবে ( : ২-কে চৌষট্টিবার পূরণ করলে যে সংখ্যাটি হ্য়)! কথিত আছে, এর ফলশ্রুতিতে পন্ডিত বেচারা ওর মাথাটাই হারিয়েছিল, শিরশ্ছেদেই হল এই প্রতিভাধরের জীবনের নির্মম অবসান। ভাগ্যিস, এ নির্মম পরিণতির কোন তথ্যপ্রমাণ নেই!
হাল আমলে, “২”-এর এহেন যাদুকরী গুণিতক গুণে মুগ্ধ হলেন গর্ডন মূর নামে এক প্রবাদপুরুষ। “ইন্টেল” (Intel) কোম্পানীর একজন প্রতিষ্ঠাতা, অসম্ভব মানবদরদী-পরোপকারী, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের “প্রেসেডিন্সিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম” নামকরা পুরস্কারধারী—এতসব খ্যাতির মালিক হওয়া সত্ত্বেও শুধু একখানা ভবিষ্যতবাণীর জন্যেই তিনি অমর হয়ে থাকবেন। ১৯৬৫ সাল, “আইসি” (IC: Integrated Circuit) সবে শৈশবে পা দিয়েছে, একটু একটু করে মানুষের মনে বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর স্বপ্ন-মায়াজাল বিস্তার করার পালায় রত, এমন সময় গর্ডন মূর দুম করে একটি ভবিষ্যতবাণী করে বসলেন।
“আইসি” সম্পর্কে কারো যদি কৌতুহল থাকে তবে এ বেলা বলে ফেলা ভাল এটি আসলে কি; মূর সাহেবের ভবিষ্যতবাণীর সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত বস্তুটি – ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে, মানব সভ্যতায় বিদ্যুতের(Electricity) ব্যাপক ব্যবহার শুরু হওয়া অবধি পদার্থবিজ্ঞানীদের, বিশেষ করে প্রকৌশলীদের যেন দম ফেলবার ফুরসত নেই- কিভাবে মানুষের জীবনকে আরো নতুন নতুন বৈদুতিক যন্ত্রপাতিতে ভরিয়ে তোলা যায়, জীবনটাকে আরো আকর্ষনীয়, আরো কর্মময়, আরো উৎপাদনমুখী করে তোলা যায়।
এডিসন, গ্রাহাম বেল, হিভিসাইড, কেল্ভিন, সিমেন্স, টেসলা, ওয়েস্টিংহাউস এসময়ের একেক জন উজ্জ্বল নক্ষত্র। বিদ্যুৎ শিল্পবিপ্লবের অন্যতম হাতিয়ারে রূপ নিয়েছে এদের হাত দিয়ে।
এসব যন্ত্রপাতির নানারকম নিখুঁত কার্যক্রমের জন্যে বিদ্যুৎ বা ইলেক্ট্রন (পরিবাহী পদার্থের পারমাণবিক কণা) প্রবাহের নিখুঁত নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন, অনেকটা ট্রাফিক পুলিশের যানবাহন নিয়ন্ত্রনের মত। বিভিন্ন ধরনের ভাল্ভ (Valve), পরিবাহী বর্তনী (Wires), বলবর্ধক (Amplifiers), রোধক (Resistance), চার্জ ধারক (Capacitance), ট্রানজিস্টার (একধরনের সুইচ), ইত্যাদি, যন্ত্রাংশের (Components) আবিস্কার দিনকে দিন ইলেক্ট্রিকাল যন্ত্রপাতিগুলোকে নিখুঁত থেকে নিখুঁততর করে তুললো । ছোট্ট একটা উদাহরন দেই- ধরুন, বিদ্যুতকে প্রবল বেগে এবং প্রচুর পরিমাণে একটি রোধকের (Resistance) ভিতর দিয়ে প্রবাহিত করা শুরু করলেন, তাহলে কি হতে পারে তা নিশ্চয়ই কিছুটা বুঝতে পারছেন।
এই কম্পোনেন্ট-এর নাম থেকেই কল্পনা করে নেয়া যায় যে এর কাজই হচ্ছে কেবল বাগড়া (Resist) দেয়া; হাঁ, এমনই বাগড়া সে দেবে যে নিমেষের মধ্যে তৈরী হবে ইলেক্ট্রনের ট্রাফিক জ্যাম। যে কোন জ্যামেরই অনাকাংক্ষিত (এক্ষেত্রে অবশ্য কাংক্ষিত)পরিণতি – ধাক্কাধাক্কি আর গুঁতোগুঁতি। রোধকের অণুগুলো ধাক্কাধাক্কিতে গরম হয়ে উঠবে, আবার কখনো কখনো এতই উত্তেজিত হয়ে যাবে যে আলো ছড়াতে শুরু করবে ওরা; অনেকটা রেগেমেগে জ্বলে ওঠার মত আর কি! বৈদুতিক বাতির এভাবেই আবির্ভাব।
ত্রিশ-চল্লিশের দশকে, বিশেষ করে দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে রেডিও, টেলিফোন, আর টেলিভিশনের ভীষন জনপ্রীতির কারণ হিসেবে বলা যায় যেমন মানুষের অদম্য জ্ঞানস্পৃহা, পৃথিবীটাকে হাতের মুঠোয় পাবার অপূর্ণ কামনা; তেমনি, ভয়াবহ যুদ্ধের বিভীষিকাপ্রসূত নিরাপদ-নিশ্চয়তার উপায় হিসেবে এসব প্রযুক্তি ব্যবহারের মনস্তাত্ত্বিক দিকটাকেও একেবারে অগ্রাহ্য করা যায় না। প্রয়োজন আর মনোরঞ্জণ, এ দুই চালিকাশক্তি ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রাংশ গুলোকে এগিয়ে নিয়ে গেল ব্যাপকভাবে।
তবে একটা গাফিলতি ইঞ্জিনিয়ারদের বড়ই মনঃপীড়া দিতে শুরু করল, জিনিসগুলোর আকৃতি। দেখা গেল জটিল জটিল সব কাজ করাবার জন্য কিছু বানাতে গেলে সেগুলো বিশাল আকার ধারন করতে লাগলো, মূলতঃ যন্ত্রাংশ বা কম্পোনেন্টগুলোর বেঢপ সাইজের জন্যে। ১৯৩০-এ একটি রেডিওর আকার দেখলে এখনকার ছেলেমেয়েরা বোধহয় ভিরমি খাবে (ছবি-১)।
ছবি-১ ঃ গ্রেট ডিপ্রেসনের যুগে রেডিও শুনছে ছোট্ট মেয়ে
তড়িৎ ইঞ্জিনিয়ারদের বরাবরের মত তখনো চোখ-কান বেশ খোলা ছিল; পদার্থবিদ্যা, রসায়ণবিদ্যা, ধাতুবিদ্যা, গণিতশাস্ত্র, বস্তুবিজ্ঞান, জীববিদ্যা, পরমাণুবিদ্যা-জ্ঞানের এমন কোন শাখা নেই যেখান থেকে ওরা জ্ঞান ধার করে, সে থেকে ফলিত ফয়দা আদায় করার চেষ্টা না করত। একেক জন তড়িৎ প্রকৌশলী সে যুগে ছিলেন যেন একেক জন জ্ঞান পাইরেট; অবশ্য ভাল অর্থে বললাম কথাটা।
ওরা তাত্ত্বিক বিজ্ঞান আর নিরস গণিতশাস্ত্রের সাথে আপামর মানুষের জীবনের সেতুবন্ধন রচনা করতে সর্বক্ষন ব্যস্ত থাকতেন। সেরকমই একটা ঘটনা ঘটলো ১৯৫৮ সালে, জ্যাক কিল্বি ও রবার্ট নয়েস ছোট এক চিলতে অর্ধপরিবাহী (Semiconductor) পাতের উপরে তাপ-রাসায়নিক-যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রথমবারের মত একাধিক ইলেক্ট্রনিক কম্পনেন্ট বানাতে সক্ষম হলেন (ছবি-২)। এভাবেই জন্ম নিল “আইসি” (Integrated Circuits); সম্পূরিত ক্ষুদ্রযন্ত্র, অথবা মাইক্রোচিপ। জ্যাক কিল্বির আইসি-তে মাত্র পাচ-ছটির মত যন্ত্রাংশ (কিছু রোধক, ধারক এবং দুটো ট্রাঞ্জিস্টার) একই তলে সমন্বিত করা হয়েছিল। ছোট্ট এক গাণিতিক ফাঙ্কশনের (Sine Wave or Periodic Oscillation) ইলেক্ট্রনিক প্রদর্শনের মাধ্যমে উনি খুলে দিলেন মানব সভ্যতার অপরিসীম সম্ভাবনার দ্বার।
২০০০-এ দেয়া নোবেল পুরস্কার ওঁর কাজের সামান্য সম্মানী ।
ছবি ২ঃ (ক)জ্যাক কিল্বির আইসি
ছবি ২ঃ (খ)আধুনিক মুঠোফোনের আইসি(ট্রিলিয়ন ট্রাঞ্জিস্টারের সমন্বয়)
যাইহোক এত বকবকের যে উদ্দেশ্য, সেই গর্ডন মূরের ভবিষ্যতবাণীতে ফেরত যাওয়া যেতে পারে বলে মনে হয়। আইসি আবিস্কারের মাত্র সাত বছরের মাথায় উনি একটি বৈজ্ঞানিক জার্নালে লিখলেন-“আইসির কার্যক্ষমতা (অথবা ওর ভিতরে মোট যন্ত্রাংশের সংখ্যা) প্রতি বছরে তার আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ হবে। এই দ্বিগুণিতক হার নিকট ভবিষ্যতে মোটামুটি বহাল থাকবে, হয়তোবা আরো বাড়তেও পারে। সুদূর ভবিষ্যতে কি হবে তা নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না, তবে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় বৃদ্ধির হার আগামী দশ বছর এরকমটাই আশা করা যায়।
“
এই হল ১৯৬৫-তে দেয়া মূরের ভবিষ্যতবাণীর মোটামুটি তর্জমা। চিন্তা করে দেখুন, একটি সদ্য আবিস্কৃত প্রযুক্তি নিয়ে এহেন বক্তব্য দেবার সাহস করা, খুব কম লোকের পক্ষেই সম্ভব। অনেকের কাছে, ওই সময়ে- ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৫, মাত্র দশ বছরের ব্যবধানে মাইক্রোচিপে যন্ত্রাংশের পরিমাণ ৫০০ গুণের বেশি হবে এ চিন্তাটা নেহায়েত গাঁজাখুরী গালগপ্প ছাড়া কিছু ছিল না। কিন্তু আজ আমরা জানি যে বুদ্ধিমান লোকটির কথায় শুধু সামান্য একটু ভুল ছিল- দশ বছর না বলে আরো অনেক লম্বা সময় বলা উচিত ছিল ওঁর (ছবি-৩)। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই ভবিষ্যতবাণী গত চার দশক জুড়ে ইলেক্ট্রনিক বা কম্পিউটার জগতে অমোঘ আইনে (Law) পরিণত হয়েছে।
হাঁ, আইসি বা মাইক্রোচিপকে পুঁজি করেই এসেছে বিংশশতাব্দীর সেরা বিস্ময়-“গণকযন্ত্র” বা কম্পউটার; একাধিক আইসি এবং মাইক্রোপ্রসেসরের সমন্বয়ে তৈরী যন্ত্রটি এখন আমাদের জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ। শুধু আইসির ক্ষেত্রেই নয়, যে কোন ধরনের ডিজিটাল উন্নতির গতিপ্রকৃতি এই আইন বা তত্ত্ব দিয়ে মোটামুটি নিখুঁতভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। তবে এটা বলে রাখা ভাল যে ডিজিটাল দ্বিগুণিতক সময়কাল নিয়ে সামান্য বিতর্ক আছে, ইদানিং এক বছরের জায়গায় “দেড় বছর” ধরা হয় এই ব্যাপ্তিকাল।
ছবি ৩ঃ (ক) মূরের আইন (যান্ত্রিক গণনার মূল্য ও দ্রুততার হিসেবে দেখানো)
ছবি ৩ঃ (খ) তিনটি গাণিতিক ফাঙ্কশন, সবুজ রেখাটি আমাদের বহুল আলোচিত দ্বিগুণিতক বৃদ্ধি
লক্ষ্য করবেন, ছবি ৩-এ দেখানো দুটো চার্টের উল্লম্ব-অক্ষের (y-axis)সাংখ্যিক পরিবেশনা ভিন্ন। গণিতের ভাষায় (ক) –এর পরিবেশনাকে বলে “লগ-স্কেল” (প্রতি বড় ঘর একশগুণ), আর (খ)-এর “সরল-রৈখিক” স্কেল।
(খ)-এর পরিবেশনার একটা বড় গলদ হল যে দশ বছরের পর ফাঙ্কশনের ফল এতই বড় হয়ে যায় যে ওগুলো দেখাতে গেলে প্রথম ক’বছরের অবদান একদমই শূন্য মনে হয়। তাই (ক)-তে দেখানো “লগ-স্কেল”-এর পরিবেশনা এহেন ক্রমান্বয় প্রবৃদ্ধির তুলনামূলক বোধগম্য চিত্র একটু ভালভাবে তুলে ধরতে পারে লম্বা সময় ধরে, শুরুর দিকের বৃদ্ধিকে মোটেই সামান্য মনে হয় না এতে।
মূর সাহেবের তত্ত্ব নিয়ে যে যুগে যুগে ব্যাপক আলাপ আলোচনা হচ্ছে সে ব্যাপারে অনেকেরই জানা আছে। এ তত্ত্ব পদার্থবিজ্ঞানে পড়া তাপগতিবিদ্যার(Thermodynamics) তত্ত্ব অথবা নিউটনের সূত্র থেকে অনেকটাই ভিন্ন ধরনের। পদার্থবিজ্ঞানের এসব তত্ত্ব প্রকৃতির ধ্রুব সত্য; আমরা কি বললাম, কি করলাম- তাতে কিছুই যায় আসে না এগুলোর।
কিন্তু মূরের সূত্র কোন ধ্রুব সত্যের ব্যাখ্যা নয়, এটি গোটা ইলেক্ট্রনিক এবং কম্পিউটার শিল্পে কর্মরত যত প্রকৌশলী আর বিজ্ঞানী আছে তাদের কর্মদক্ষতার, সাফল্যের সুন্দর একটা চিত্ররূপ। মাঝে মাঝে ভাবতে ভাল লাগে, গত চৌদ্দ বছর যাবত আমিও এ দলের একজন সৈনিক। মূরের তত্ত্ব আমাদের সামনে এখন অনেকটা প্রতিবছরের শুরুতে নেয়া “নববর্ষের প্র্তিজ্ঞা”র মত, যেন লক্ষ্য বেঁধে দেয়া আছে আমাদের সমষ্টিগত জীবনে। মাঝে মাঝে আবার কালবোশেখী মেঘের মত মনের আকাশে উঁকি দেয় আঁধার করা শঙ্কা, “কদ্দিন টিকবে এই ইন্দ্রজাল? গুপ্ত-রাজদরবারের সেই ব্রাম্মণ পন্ডিতের মত মাথাটাই আবার না কাটা পরে। “ অবশ্য এই ভয় যে একেবারে ভিত্তিহীন, তা কিন্তু নয়।
অনেকদিন থেকেই বলা হচ্ছে মূরের বিপ্লব এই শেষ হল বলে, আর কতো, অনেক তো হল! পৃথিবীর আর কোন প্রযুক্তি বেলায় উন্নতির এমন নজির নেই। যেমন ধরুন গাড়ি শিল্পের কথা-এমন কোন সময়ের উদাহরন দেয়া সম্ভব নয় যে সে সময়ের মধ্যে গাড়ির সর্বোচ্চ গতিবেগ অথবা জ্বালানী কর্মক্ষমতা ফের বছর দ্বিগুণ হয়েছে এবং এর যের চলেছে পঞ্চাশ বছর ধরে, কিংবা উড়োজাহাজ দ্বিগুণ দূরত্ব অতিক্রম করেছে, অথবা রেলগাড়ির বগী ধারন ক্ষমতা দ্বিগুণ হয়েছে বছর বছর। তাহলে, ইলেক্ট্রনিক শিল্পকারখানার কি সত্যিই যাদু আছে?
দুটো কারণ- প্রথমতঃ, যদিও আইসির ভিতরে থাকা বিভিন্ন যন্ত্রাংশকে অবশ্যই একটু আগে উদাহরন দেয়া গাড়ি, উড়োজাহা্জ আর ট্রেনের মতই পদার্থবিজ্ঞানের আইন আর প্রকৃ্তির নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়, তবুও এদের বিচরণক্ষেত্র পারমাণবিক পর্যায়ে হবার জন্যে নিয়ম কানুনগুলো অনেকটাই শীথিল। অর্ধপরিবাহী বস্তুর (Silicon) অন্তঃপুরে খোদাই করা কতক ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র (১ মিটারের ১০০,০০০,০০০ ভাগের ১ ভাগ) নালার (Channel) ভিতর দিয়ে সেকেন্ডে কয়টি ইলেকট্রন বয়ে যাবে নদীর জলের মত অথবা ফাইবার অপটিক তারের ভিতর দিয়ে কত জোরে আলোক রশ্মি ছুঁড়ে দেয়া যাবে এসবই ডিজিটাল উন্নয়নের মাপকাঠি। এগুলোকেও যে কখনও সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হতে হবে না তা নয়, তবে দেরী আছে এখনো।
২০১৩ সালে ব্রডকম কর্পোরেশনের (এরা মুঠোফোনের আইসি বানায়) প্রধান প্রযুক্তি অফিসার, হেনরী স্যামুয়েলি ঘোষণা দিলেন, “মূরের আইনের আয়ু আর মাত্র ১৫ বছর। “
এবার দ্বিতীয় কারণটিতে আসা যাক। স্যামুয়েলি সাহেবের মত অনেকেই বিভিন্ন সময়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন, এরা প্রত্যেকেই বুদ্ধিমান, প্রত্যেকেই পদার্থবিদ্যায় পারদর্শী; কিন্তু এদের প্রত্যেকেরই একটা বড় ব্যর্থতা হল, কম্পিউটার শিল্পে কর্মরত ইঞ্জিনিয়ারদের বুদ্ধিমত্তা আর দক্ষতাকে চরম হেয় জ্ঞান করা। যখনই কোন বাঁধা সামনে এসে পড়েছে অস্বাভাবিক মেধাবী কারিগরি কৌশল আর উদ্ভাবনী ক্ষমতার (Brilliant Tinkering) জোরে প্রকৌশলীরা মূর-তত্ত্বের দ্বিগুণিতক গতি বজায় রেখেছে; আর নিন্দুকের মুখে ঢেলে দিয়েছে হাড়ি হাড়ি ছাই! ছোট্ট উদাহরনঃ একটা সময় এলো যখন একই তলে, সীমিত জায়গাতে বিলিয়ন বিলিয়ন ট্রাঞ্জিস্টার আর ঠাসা যাচ্ছিল না; তখন ওরা বানিয়ে ফেললো দোতলা মাইক্রোচিপ, জায়গার কোন অভাব রইল না আর (SOI: Systems On Chip)। ইন্টারনেট যোগাযোগে ব্যবহার করা ফাইবার অপ্টিক তারের কথা বলা যেতে পারে; যখনই তথ্যপ্রবাহে বড় ট্রাফিক জ্যামের সৃষ্টি হল, তখুনি প্রকৌশলীদের মাথা থেকে বেরোলো কিভাবে একাধিক তরঙ্গদৈর্ঘের আলোর উপর চাপিয়ে অসংখ্য তথ্যপ্রবাহকে একটিমাত্র পরিবাহীর ভিতর দিয়ে পাঠানো যায়; অনেকটা প্যারালাল ইউনিভার্সের মত একই জায়গায় একই বস্তুর অসংখ্য রূপের সহাবস্থান (WDM: Wavelength Division Multiplexing)।
সত্যি বলতে কি মূর-তত্ত্ব একটি-দুটি নয়, অসংখ্য অভিনব প্রযুক্তির সমন্বিত জয়গাঁথা, যেগুলোর লক্ষ্য তার ঠিক আগেরটির কোন সমস্যা সমাধান এবং যে সমাধানের জন্যে কাজ করে যাচ্ছে সমষ্টিগত ব্রিলিয়ান্ট মাথা (Recombinant Technology)। এতদিন যা ছিল কেবলই জৈবিক মাথা, আজকাল এক্ষেত্রে উঁকি দিচ্ছে কল্পকাহিনী থেকে তুলে আনা আরেকটি সম্ভাবনা –অজৈবিক, কৃত্রিম মাথার ব্যাবহার; অনেকটা মাছের তেলে মাছ ভাজার মত।
এই লেখার শুরুতে বলা গল্পটার কথা নিশ্চয় খেয়াল আছে, বত্রিশ নম্বর ঘরে এসে গুপ্তরাজা মহা সমস্যায় পড়ে গিয়েছিলেন চালের পরিমানের সংখ্যাটির অকল্পনীয় আকার দেখে, দাবার বোর্ডের দ্বিতীয়ার্ধে কি হবে তা তিনি আর ভাবতেই পারছিলেন না। তেমনটি ঘটছে মূরের চার্ট নিয়েও; অনেক গবেষকের ধারনা যে আমাদের বর্তমান প্রাযুক্তিক গণনক্ষমতা বা কার্যক্ষমতা (Computational Power) দাবার বোর্ডের দ্বিতীয়ার্ধে প্রবেশ করেছে। এদের অনেকেই মনে করেন ২০০৬ সাল এমনই এক সন্ধিক্ষণ।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (Artificial Intelligence) ব্যাপক এবং অভাবনীয় প্রসার ঘটেছে ২০০৬ সালের পরবর্তী সময়ে ডিজিটাল প্রযুক্তি আর ডিজিটাল তথ্যপ্রসারের হাত ধরে।
পঞ্চাশের দশক থেকে জোরেসোরে শুরু হওয়া বিজ্ঞান কল্পকাহিনীতে আর হলিউডি সিনেমাতে যে হারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার দেখানো হয়েছে, গত চার দশকে আমাদের বাস্তব জীবনে এর তেমন কোন ছায়া দেখতে পাইনি; বরং শুনেছি অনেক গবেষণার ব্যার্থতার কথা, পড়েছি অনেক বিদগ্ধ পন্ডিতের সন্দিগ্ধ উপসংহার- হাজার বছরের চেষ্টাতেও সম্ভব নয় মানুষের বুদ্ধিমত্তার তিল পরিমাণ অনুকরণ। কিন্তু কিছু আশাবাদী বিজ্ঞান লেখক বলছেন যে ২০০৬ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত দেখা বিভিন্ন আলামত প্রমান করে মানব সভ্যতায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাস্তব ব্যবহার আর কোন গালগল্প বা গবেষনাগারে সীমাবদ্ধ খেলনা নয়।
গুগুল কোম্পানীর বানানো চালকবিহীন গাড়ির ১০০,০০০ মাইল নির্বিঘ্ন ভ্রমন (ভীড়ভাট্টার মধ্য দিয়েও), অ্যাপেল আইফোনে সংযোযিত যান্ত্রিক সহযোগী “সিরি”র বুদ্ধিদীপ্ত কথোপকথনের ক্ষমতা, “ব্যাক্সটার” নামক এক কারখানা-রোবটের পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে যে কোন ধরনের ছোটখাট কাজ করবার ক্ষমতা (অবাকজনক হলেও সত্যি যে মানুষের উচ্চমানের যুক্তিবুদ্ধির অনুকরণের চাইতেও নিম্নমানের কাজকারবার অনুকরণের জন্যে অনেক বেশি গণনক্ষমতা দরকার), বস্টন ডিনামিক্সের বানানো “বিগডগ” নামে ভারবাহী এক রোবট-কুকুরের পাহাড়পর্বতে আমেরিকান যোদ্ধাদের সাথে নিখুঁত পদচারনা, আইবিএম-এর বানানো “ওয়াটসন” সুপার কম্পিউটারের “জেওপার্ডি” নামক দুরহ খেলায় মনুষ্য প্রতিদন্দ্বীকে হার মানানো, স্মার্টফোনের পক্ষে ব্যাবহারকারীর চেহারা দেখে মন বুঝে ফেলবার ক্ষমতা; অল্প কিছু উদাহরনের মাঝেই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে গত ক’বছরে অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে ওঠা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্ত্বার প্রসার; যাকে কিনা অনেকেই তুলনা করছেন দ্বিতীয় যন্ত্রযুগের আবির্ভাবের সাথে; যে যুগে শুধু শারীরিক বল দিয়ে নয়, অপরিসীম মানসিক বল যোগ করে এসব যন্ত্র মানব সভ্যতাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাবে মূর-চার্টের অকল্পনীয় দ্বিগুণিতক প্রবৃদ্ধির হারে।
নিকটাসন্ন অসম্ভব এই সম্ভাবনাময় যুগের কাছ থেকে অযৌক্তিক শঙ্কা নয় শুধু সুন্দরের প্রত্যাশাই করবো আমরা।
সামাজিক, রাজনৈতিক, ব্যাক্তিগত পৃষ্ঠপোষকতার অভাব যেন এই অগ্রযাত্রার পথে বাঁধা হয়ে না দাঁড়ায়। আর এ যুগের সার্থকতার দায়িত্ব অনেকটাই নবপ্রজন্মের পথিকৃ্তদের।
-অনিরুদ্ধ বাশার
References:
1. Erik Brynjolfsson, Andrew McAffe, The Second Machine Age (W.W. Norton & Company, 2013)
2. G.E. Moore, “Cramming More Components onto Integrated Circuits,” Electronics 38, no 8 (April 19, 1965): 114-17
3. Ray Kurzweil, The Age of Spiritual Machines: When Computers Exceed Human Intelligence (Penguin,2000)
4. U.S. Patent 3,138,743 Miniaturized Electronic Circuits, filed February 6, 1959, issued June, 1964
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।