উপন্যাসের জগতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই
প্রশ্ন : প্রথম যখন শব্দের শক্তি সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠলেন, আপনার বয়স কত ছিল?
অরুন্ধতী রায় : মনে হয় বেশ বড়ই ছিলাম। হয়তো দুই বছর। আমার অদৃশ্য হয়ে যাওয়া বাবার কাছে শুনেছিলাম। আমার বয়স যখন চব্বিশ কি পঁচিশ, তখন প্রথমবারের মতো তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়। দেখা গেল, তিনি দারুণ আকর্ষণীয় এক ব্যক্তি—একই সঙ্গে বেকার, দেউলিয়া ও মাতাল।
(এতে প্রথম দিকে খানিকটা থতমত খেয়ে গেলেও পরে তিনি প্রবীণ আমলা বা গলফখেলুড়ে নির্বাহী না হওয়ায় বরং খুশিই হয়েছিলাম। আমি তাঁর বেশ ভক্ত হয়ে উঠি। ) প্রথম আমাকে তিনি যে কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন, তা হলো, ‘এখনো মুখখিস্তি করো নাকি?’ উনি কী বলছেন বুঝে উঠতে পারিনি, আমাকে শেষবার যখন তিনি দেখেন, তখন আমার বয়স ছিল দুই বছরের মতো। তিনি বললেন, আসামের যে চা-বাগানে তিনি কাজ করতেন, সেখানে দুর্ঘটনাক্রমে সিগারেটের আগুনে আমাকে পুড়িয়ে দিলে আমি চোখ রাঙিয়ে বলেছিলাম, ‘চুতিয়া’—নির্ঘাৎ চা-শ্রমিকদের বসতিতে শিখেছিলাম এই ভাষা। …পাঁচ বছর বয়সে প্রথম লিখি আমি…এখনো সেই নোটবইগুলো আছে।
এক ভয়ংকর অস্ট্রেলিয়ান মিশনারি মিস মিটেন ছিলেন আমার শিক্ষক। রোজই আমাকে বলতেন, আমার চোখে নাকি খোদ শয়তানকে দেখতে পান। আমার দুই ছত্রের রচনায় (পরে যেটাকে দ্য গড অব স্মল থিংস-এ রূপান্তরিত করা হয়েছে) আমি বলেছিলাম, ‘মিস মিটেনকে আমি ঘৃণা করি, তাঁকে দেখলেই আমার ছেঁড়া ন্যাকড়ার কথা মনে হয়। আমার মনে হয়, তাঁর অন্তর্বাসগুলো ছেঁড়া। ’ এখন আর তিনি বেঁচে নেই।
জানি না, আপনাকে যেসব গল্প বলছি, সেগুলো শব্দের শক্তি সম্পর্কে সজাগ হয়ে ওঠার সঙ্গে সম্পর্কিত কি না…।
প্রশ্ন : লেখালেখিতে আপনার কোনো আদর্শ আছে, কাউকে বিশেষভাবে অনুকরণ করেন?
অরুন্ধতী রায় : আমার আদর্শ আছেন কি না? আমি হয়তো এই শব্দটি ব্যবহার করব না। কারণ, এতে মনে হতে পারে এমন ব্যক্তিরা আছেন, যাঁদের আমি এতটাই শ্রদ্ধা করি যে তাঁদের মতো হতে চাইব…আমার কাছে কাউকে তেমন মনে হয় না। তবে আমি শ্রদ্ধা করি, এমন লেখক কারা জানতে চাইলে বলব, হ্যাঁ, অনেকে। শেকসিপয়ার, জেমস জয়েস, নবোকভ, নেরুদা, এদুয়ার্দো গালিয়ানো, জন বার্গার বাদে ঠিক এই মুহূর্তে উর্দু কবিদের রচনায় আমি মুগ্ধ—বলতে লজ্জা লাগছে, তাঁদের সম্পর্কে, তেমন কিছুই জানি না…তবে শিখছি, আমি হাফিজ পড়ছি।
দারুণ দারুণ সব লেখক আছেন, এই পথিবীতে জীবন যাপন করে যাওয়া আমার পূর্বসুরিদের মধ্যে। তবে লেখকেরাই যে শুধু আমাকে গল্প বলার বেলায় অনুপ্রাণিত করেন, তা নয়। কথাকলি নর্তকের দিকে তাকান, কী সহজে তিনি একটা গল্পের ভেতর গতি বদলান—কৌতুক থেকে এপিফ্যানি, বৈরী থেকে কোমলতায়, মহাকাব্য থেকে একান্তে—এই নৈপুণ্যকে আসলে শ্রদ্ধা করি আমি। আমার কাছে এই অনায়াস স্বচ্ছন্দ একধরনের অ্যাথলিটিজম, যেমন সুন্দর অনায়াস দৌড়বিদকে ক্ষিপ্র ছুটন্ত চিতার মতো প্রত্যক্ষ করা, এটাই গল্প কথকের ফিটনেসের প্রমাণ।
প্রশ্ন : এখন উপন্যাস লেখার ব্যাপারটা কেমন হবে আপনার কাছে?
অরুন্ধতী রায় : এর মানে হবে সময় বের করা, কিছুটা নিরিবিলি পরিবেশ বের করা, বাঘের পিঠ থেকে নামা।
আশা করি, সেটা সম্ভব হবে। পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার মাত্র অল্প মাস আগে বেরিয়েছিল দ্য গড অব স্মল থিংস, নষ্ট জাতীয়তাবাদের এক নতুন, ভীতিকর ও চড়া ভাষার আবির্ভাব ঘটিয়েছিল তা। জবাবে আমি লিখেছিলাম, ‘দ্য এন্ড অব ইমাজিনেশন। ’ আমাকে তা রাজনীতির পথে নামিয়েছিল, যার কোনো ইচ্ছাই আমার ছিল না। এতগুলো বছর পরে বিশাল সব বাঁধ, প্রাইভেটাইজেশন, ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধ, পার্লামেন্টে আক্রমণ, কাশ্মীরে দখলদারি, মাওবাদী আর সবকিছুর করপোরেটাইজেশন নিয়ে লেখার পর—যেসব লেখা অসম্ভব বৈরী ও বিপজ্জনক।
আমার ধারণা, আমরা বেশ কঠিন সময়ের দিকে এগিয়ে চলেছি। এই দেশটি আরও সহিংস অঞ্চলে পরিণত হতে চলেছে। কিন্তু ব্যাপারটা যখন আমাদের হাতে, একজন লেখক হিসেবে আমাকে বেঁচে থাকার একটা উপায় বের করতে হবে, কী ঘটছে সেটা দেখার, জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ভারতীয় অভিজাতগোষ্ঠী মহাশূন্যে গেছে। কিন্তু যাদের মর্ত্যে ফেলে যাওয়া হয়েছে, তাদের বোঝার ক্ষমতা যেন হারিয়ে ফেলেছে তারা।
প্রশ্ন : ...নতুন একটি উপন্যাস লিখতে গেলে আপনাকে কী করতে হবে?
অরুন্ধতী রায় : জানি না, যে গল্পটি বলতে চাই, সেটি বলার জন্য একটা ভাষা খুঁজে বের করতে হবে। ভাষা দিয়ে আমি ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, মালয়ালাম বোঝাচ্ছি না অবশ্যই। বলতে চাইছি অন্য কিছু। বিভিন্ন জগৎকে একসঙ্গে করার একটা উপায়, যারা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। দেখা যাক।
প্রশ্ন : আপনার সাধারণ একটা দিন সম্পর্কে ধারণা দিতে পারেন? যেমন অন্যদের চেয়ে আপনার দিনগুলো কেমন ভিন্ন আর অনিয়মিত?
অরুন্ধতী রায় : আমার দিন-রাত? আসলে আমার নৈমিত্তিক কোনো দিন (বা রাত) নেই। অনেক বছর ধরেই এমন। এর সঙ্গে দেশদ্রোহিতার তামাশার কোনো সম্পর্ক নেই (হাসি)। এ নিয়ে আমার অনুভূতি সম্পর্কে আমি ঠিক নিশ্চিত নই। তবে ব্যাপারটা এমনই।
অনেক ঘুরি আমি। একই জায়গায় সব সময় ঘুমাই না। আমার জীবনটা বড়ই অস্থির, তবে অশান্ত নয়। কিন্তু অনেক সময় মনে হয়, যেন আমার শরীরে বুঝি ত্বক নামের পদার্থটি নেই—বসবাসের পৃথিবী থেকে আমাকে যা আলাদা করে। ত্বকের এই অনুপস্থিতি ভয়ংকর।
আপনার একান্ত জীবনে ঝামেলা বয়ে আনে; ব্যক্তিগতকে প্রকাশ্য আর প্রকাশ্যকে ব্যক্তিগত করে ফেলে। অনেক সময় যন্ত্রণাকর হয়ে উঠতে পারে। কেবল আমার নয়, বরং আমার কাছাকাছি যাঁরা আছেন, তাঁদের পক্ষেও।
...আসলে দুঃখের কথা উপন্যাসের জগতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই। এমনকি কে কোন বছরে বুকার পুরস্কার পেয়েছেন, তাও জানি না।
তবে যখন নেরুদার স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানি পড়বেন, আপনাকে সত্যিই বিশ্বাস করতে হবে যে অবস্থার পরিবর্তন হলেও তা আগের মতোই রয়ে যায়। ...নিঃসঙ্গ হলে ভিন্ন কিছু করতাম, কিন্তু আমি তা নই; আমি জনতার হৃদয় থেকে আমার লেখা ছড়িয়ে দিই। ...
________________
অরুন্ধতী রায়ের সাক্ষাৎকার
গুয়ের্নিকা পত্রিকা, ফেব্রয়ারি ২০১১
সাক্ষাৎকারগ্রাহক - অমিতাভ কুমার
-----------------------------------
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।