বইমেলা ২০১৪’ থেকে কেনা বইগুলোর পাঠ প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্যে এই ধারাবাহিক। ইচ্ছে আছে পরের পর্বগুলো লেখার, পারবো নাকি জানি না।
অন্য এক গল্পকারের গল্প নিয়ে গল্প – শাহাদুজ্জামানএ সময়ের গল্পকারদের মধ্যে শাহাদুজ্জামানের প্রতি আমার পক্ষপাত আছে। তার ‘কয়েকটি বিহবল গল্প’ বা ‘পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ’ পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। প্রায় প্রতিটা গল্পেই শাহাদুজ্জামান সেখানে চেষ্টা করেছিলেন গল্প বলার প্রচলিত ছকগুলো লোগেসেটের মতো খুলে নিজের মতো করে জোড়া লাগাতে।
সেই সাথে জীবনানন্দের সাথে ভীষণ ভাবে সমাপতিত তার ভাষারীতিও দাগ কেটেছিলো মনে। মাওলা থেকে প্রকাশিত ‘অন্য এক গল্পকারের নিয়ে গল্প’ বইটি তাই কিনেছিলাম আগ্রহ নিয়েই।
জীবনানন্দের কথা বলছিলাম। কাকতাল হতে পারে, তবে দেখা গেলো বইয়ের দশটি ছোটগল্পের মাঝে প্রথমটিই জীবনানন্দের একটি অপ্রকাশিত গল্প নিয়ে। সংকলনের নামগল্পও এই প্রথম গল্পটি।
এভাবে অন্য এক গল্পকারের আলোচনা দিয়ে শুরু হওয়া বইটির প্রায় প্রতিটি গল্পেই গল্পকার চেষ্টা করেছেন নিজ সাক্ষর রাখতে। আমার ভুলও হতে পারে, তবে মনে হয়েছে সাক্ষর করতে গিয়ে লেখক যেন একটু বেশিই সচেতন ছিলেন এই বেলা- যে কারণে নতুন কোনো ভাবে আলোড়িত হতে পারেনি গল্পগুলো পড়ে। অর্থাৎ গল্পগুলো চমৎকার, কিন্তু ওরা জ্বলে ওঠে না নিজের আলোয়- বরং মনে হয় পুরোনো কোনো গল্পই যেন পড়ছি শাহাদুজ্জামানের।
এই আক্ষেপটুকু বাদ দিলে বইটা বেশ ভালো লেগেছে। ‘গোয়েন্দা ঘরানার গল্প’, ‘পৃথক পৃথিবী’, ‘অপুষ্পক’- এই গল্পত্রয়কে বিশেষ উল্লেখ্য মনে হয়েছে আমার।
আর অতি অবশ্যই, বলতেই হয় রমণীয় সব নামকরণে গল্পকারের পারঙ্গমতার কথা। সব কিছু ছাপিয়ে সংকলনটি থেকে এই দুর্দান্ত নামকরণগুলোই মনে পড়ে যায়। পাঠকের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ‘মান্না দে’ বা ‘সাইপ্রাস’ গল্পগুলো সাক্ষী দিয়ে যাবে এই প্রতিপাদ্যটির।
সান্ধ্যকালীন ট্রেনে গোপন যাতায়াত- মাহবুব ময়ূখ রিশাদবাংলা ব্লগমণ্ডলের নিয়মিত, সচেতন ভাবেই শব্দটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করি আবারো- নিয়মিত গল্পকারদের মাঝে মাহবুব ময়ূখ রিশাদ অন্যতম। ব্লগমন্ডল নিয়ত গতিশীল, সেখানে অবিরাম লেখা আসছে- পাঠক পড়ছেন, স্মরণীয় লেখাটি হয়তো বুকমার্ক করে রাখা হচ্ছে অনায়াসে, অপছন্দের লেখা হারিয়ে যাচ্ছে কালিক গর্তে।
মুহূর্তের মহিমায় বহু গল্পকার মাতিয়েছেন ব্লগমণ্ডলকে, নানা ব্যস্ততায় বা শত অনিবার্য কারণে তারা হয়তো আর লিখছেন না। অন্য্যদিকে, একদল ব্লগার আছেন, যারা নীরবে অথবা সরবে নিয়মিত বিরতিতে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন তার উপস্থিতি। নিশ্চিতভাবেই আমাদের পারিপার্শ্বিকতায় একজন লেখককে লেখার সময় বের করে নিতে হয়। সেই কষ্ট আর ত্যাগটুকু স্বীকার করে যারা ব্লগের বাইরে ছাপার বইয়ের স্কোয়ারে পা ফেলছেন, ময়ূখ রিশাদ তাদের একজন। তাম্রলিপি থেকে প্রকাশিত তার ‘সান্ধ্যকালীন ট্রেনে গোপন যাতায়াত’ গল্প সংকলনটি এখানে আলোচ্য।
পনেরোটি গল্প ঠাঁই পেয়েছে সংকলনটিতে। ‘সান্ধ্যকালীন ট্রেনে গোপন যাতায়াত’ বইয়ের প্রথম গল্প। মজার ব্যাপার, পনেরোটি গল্পের দুইটির নামে এবং আরো দুইটির কাহিনী বর্ণনায় হুইসেল বাজিয়ে গেছে ট্রেন। বিষাদের প্যাকেটে মোড়া রিশাদের গল্পের উপমায় কু-ঝিকঝিকে চড়ে মার্জের হাত ধরে ভূতের গলির কে যেন ফিরে এসেছে বারবার। ‘মার্কেজের খোঁজে’, ‘শহরে গবেষক একদল তরুণ অথবা শুণ্যতার গল্প’- এই গল্পগুলোতে কিছুটা হয়তো সেই আঁচ পাওয়া যায়।
রিশাদ রঙ ছড়িয়েছেন ‘বন্ধু, বন্ধুত্ব ও ক্লাসমেটের গল্প’ কিংবা ‘কানাগলিতে বিভ্রান্ত যুবক’ উপাখ্যানে। তবে না বলে পারছি না, রিশাদ যে ভাবে গল্প বলেন- সেক্ষেত্রে আমি গল্প শুনতে চাইবো মশারীর ভেতরে বসে থাকা কথকের কাছ হতে। পাঠক আর কথকের মাঝের মশারীর আলোছায়া কাহিনীটিকে করে তুলবে দ্ব্যর্থ, পাঠককে রেখে দেবে অনিশ্চিত। আলোচ্য গল্পগুলোতে রিশাদ সেই মশারী সরিয়ে রেখেছেন, সজ্ঞানে কী না নিশ্চিত নই। আবরণটি উন্মুক্ত করবার শ্রম রিশাদ না দিলে – অন্য কারো কথা জানিনে- আমি অন্ততঃ খুশি হয়ে উঠতাম।
সংকলনের বাছাই কাজ বললে, ‘যন্ত্রমগ্ন’, ‘কাকতাড়ুয়া’ আর ‘মৃতপ্রায় কলোনিতে কয়েকজন বিষণ্ণ যুবক’ গল্পগুলোর কথা বলবো আমি। শেষ গল্পটি অপেক্ষাকৃত স্বল্প সময়ে লেখা বলে মনে হয়েছে, নইলে বহু বহুকাল মনে রাখার মতো একটি গল্পে পরিণত হবার বাকি মশলাগুলো ছিলোই লেখাটির পাত্রে। এই গল্পগুলো ইঙ্গিত দেয়, আমাদের আশাবাদী করে, ময়ূখ রিশাদের কলম অথবা কী বোর্ড, আমাদের মুগ্ধ করবে আরো অনেকদিন।
গল্পসমগ্র- মুর্তজা বশীরমুর্তজা বশীরের নাম জানি চিত্রকর হিসেবে। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘কাচের পাখির গান’ এর ভূমিকায় জহির রায়হান মুর্তজা বশীরকে উল্লেখ করেছিলেন নিঃসঙ্গ চিত্রকর ও নিঃসঙ্গ গল্পকার বলে।
অ্যাডর্ন প্রকাশিত গল্পসমগ্রে কাচের পাখির গান সংকলনের গল্পগুলোর বাইরে আরো সাতটি ছোটগল্প জায়গা করে নিয়েছে।
এই সংকলনের সবচেয়ে উল্লেখ্যযোগ্য বৈশিষ্ট্য মনে হয়েছে গল্পকারের হৃদয়ের তীব্র ঘৃণাকে, সে ঘৃণা আমাদের দৈনন্দিন যাপিত জীবনের ক্লেদসমষ্টির প্রতি। বইয়ের প্রতিটি গল্পেই জায়গা পেয়েছে হতাশা, ভেতরের দহন, অপারগতা-অক্ষমতার জারণ। ‘কাচের পাখির গান’, ‘ঘুণ’ বা ‘বিবমিষা’ গল্পগুলো পড়ে মনে হয়- যেন বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে প্রায়ই সাদাত হোসেন মান্টোর দ্বারস্থ হয়েছেন মুর্তজা বশীর। নিজে চিত্রকর বলেই কি না কে জানে, মুর্তজা বশীরের গল্পে বারবার কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে হানা দিয়েছে এমন সব মানুষ- যারা ছবি আঁকে, যারা ছবি এঁকে বিষাদ্গ্রস্ত থাকে, যারা ছবি আঁকতে চায়।
‘সাদা হাতী’, ‘অনাময়’ কিংবা ‘ফাটল’ গল্পেরা এই প্রেক্ষিতে আলোচনার দাবিদার।
‘শকুন’, ‘হাতঘড়ি’, ‘কয়েকটি রজনীগন্ধা’- গল্পগুলোকে বইয়ের মাঝে সবচেয়ে মনে ধরেছে আমার। অন্য গল্পগুলোর মতোই অক্ষমতা আর অপ্রাপ্তির বাটখারা এসব গল্পের দাঁড়িপাল্লাকে মাটিমুখী ঝুলিয়ে রাখলেও হয়তো অন্যপাশে সামান্য আশা আর জেতার সম্ভাবনা থেকে গিয়েছে বলেই আমার এই পক্ষপাতিত্ব। তবে সংকলনটির মুদ্রণ প্রমাদের সংখ্যা পীড়াদায়ক। একই বানানরীতিও সব জায়গায় অনুসৃত হয়নি।
কোনো গল্পের নামে হয়তো শোভা পাচ্ছে ডায়েরি- পরের গল্পের শিরোনামে সেটা হয়ে যাচ্ছে ডাইরি। সংকলনের স্বাদ কিছু হলেও লঘু হয় এইসব ত্রুটির কারণে।
...এবং
জহির রায়হানের উপন্যাস সমগ্রকিনবো কিনবো করেও কেনো জানি কেনা হয়ে ওঠেনি এই বইটা কখনো। আর সবকিছু বাদ দিলেও আমি মনে করি জহির রায়হানকে শুধু তার ছোটোগল্পের জন্যেই মনে রাখা যায়। পাঠকের কাছে খুব সরলভাবে উপস্থাপিত হতে পারাটা একজন গল্পকারের জন্যে বিশাল সাফল্য- সেই দিক বিচারে আমার ধারণা হুমায়ূন আহমেদ আর জহির রায়হান একই গোত্রের।
যতবারই আমি জহির রায়হানের গল্পসমগ্র পাঠ করি, ভেবে অবাক হই-যুগের চাইতে কতটা এগিয়ে ছিলেন তিনি। মাধ্যমিকে শিলপগুণ ভুলে গিয়ে পড়তে হয়েছে ‘হাজার বছর ধরে’, পরে যখন আবার তা পড়া হয়েছে কেবল স্বাদ নিতে- মুগ্ধ না হয়ে পারিনি।
উপন্যাসের মাঝেও খুঁজে পাওয়া গেলো সেই পরিচিত লেখককেই। শেষ বিকেলের মেয়ে, তৃষ্ণা, আরেক ফাল্গুন, কয়েকটি মৃত্যু, একুশে ফেব্রুয়ারি। জহির রায়হানের লেখকী নিয়ে তো আর বলবার কিছু নেই।
সেই ছোটো ছোটো বাক্য, ঘন ঘন দাঁড়ির ব্যবহার। পাঠক মনোযোগ দিতে বাধ্য হয়েই আবিষ্কার করবে গল্প ঘটে গেছে কোনো চূড়ান্ত মোচড়।
জহির রায়হান যতদিন বেঁচে ছিলেন, সেই সময়ে বাঙালির চেতনার সবচাইতে শক্তিশালী অনুষঙ্গটা ছিলো একুশে ফেব্রুয়ারি। সেই একুশ তাই বারবার এসেছে তার উপন্যাসের বিষয় হয়ে। কখনো বহু মানুষের চোখে দিনটির একুশ হয়ে ওঠা, কখনো আসছে ফাল্গুনে দ্বিগুণ হবার আশাবাদ।
একুশ ছাড়া বারবার মানুষের জীবন এসেছে তার উপন্যাসে। সেই সব মানুষ- যাদের স্বপ্ন সীমিত, যাদের আশা আটকানো থাকে মানিব্যাগের মাঝে, যারা মাথা কুটতে থাকে দৈবের দরবারে, যারা উড়তে চেয়ে লাফ দেয় উঁচুতে- তবু মাটিতে পড়ে থাকা কয়েন তুলে নিতে নিচু হতে নারাজ।
কেনো যেন আশা দেখানো মানুষগুলোই কেবল ক্ষণজন্মা হয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।