আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিক্রমপুরের গর্ব : অতীশ দীপংকর

"বাঙালি অতীশ লঙ্ঘিল গিরি তুষারে ভয়ংকর, জ্বালিল জ্ঞানের দীপ তিব্বতে বাঙালি দীপংকর। " - সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত উপরোক্ত পঙক্তিগুলো শুনলেই বোঝা যায় দীপংকর শ্রীজ্ঞান অতীশকে নিয়ে আজও বাঙালি কতখানি গর্ববোধ করে। বৌদ্ধ আচা্র্য দীপংকর শ্রীজ্ঞান বঙ্গজননীর শ্রেষ্ঠ সুসন্তানদের মধ্যে অন্যতম। তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তাঁরই উদ্যমে। এই অতীশ ছিল বিক্রমপুরের মানুষ।

অতীতে বিক্রমপুর ছিল বৌদ্ধধর্মের একটি অন্যতম কেন্দ্র। বিক্রমপুরবাসী অতীশ সমগ্র বৌদ্ধজগতে একটি চিরস্মরণীয় নাম, যিনি বাঙালি বৌদ্ধ ধর্মাচার্যদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। তিব্বতের সাধারণ মানুষ তাঁকে দেবতাজ্ঞানে পূজা করত। অনেক ইতিহাসবিধ বলেছেন দীপংকর জন্মগ্রহণ করেছিলেন বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে। তাঁর পিতার নাম কল্যাণশ্রী আর মাতার নাম পদ্মপ্রভা।

তাঁদের তিন পুত্রের মধ্যে দ্বিতীয় দীপংকর, যাঁকে চন্দ্রগর্ভ নাম দেওয়া হয়। মহামহোপাধ্যায় সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণের লেখা একটি চিঠিতে পাওয়া যায় যে অতীশ বৌদ্ধপন্থার 'বজ্র' শাখার অন্তর্গত ছিলেন। এঁরা তান্ত্রিক সাধনা করেন। এই পথে মহাসিদ্ধির জন্য নারীর প্রয়োজন হয়, যাদের বলা হয় 'যোগিনী'। যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত বলেছেন, বজ্রযোগিনী গ্রামে অনেক তান্ত্রিক ও যোগিনী বাস করত এবং তাদের আরাধ্যা দেবীর নাম ছিল বজ্রযোগিনী।

সেই দেবীর নামানুসারেই এই গ্রামের নামকরণ হয়েছে। তন্ত্রসাধনার জগতে দেবী বজ্রযোগিনী অতি কঠোর ও শুদ্ধতার প্রতীক। বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নেয়ার পর তাঁর নাম হয় দীপংকর। তিব্বত থেকে সংগৃহিত একটি কাহিনি থেকে জানা যায়, একদিন রাতে স্বয়ং ভগবান বুদ্ধ স্বপ্নে অতীশকে দেখা দেন এবং এই স্বপ্নদর্শনই অতীশকে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। প্রথম যৌবনে তিনি আচার্য জেতারীর কাছে শিক্ষা গ্রহণ করে তারপর চলে যান নালন্দায়।

সেখানে কয়েকজন বিখ্যাত আচার্যের কাছে ধর্ম, দর্শন এবং আরও অন্যান্য বিষয়ে শিক্ষালাভ করে পরম পন্ডিত হয়ে ওঠেন। ওদন্তপুরীর আচার্য শীলরক্ষিতের কাছে তিনি লাভ করেন শ্রীজ্ঞান উপাধি। অতীশ নামের অর্থ মহত্তম বা বৃহত্তম। এই অতীশ নামেই তিনি মঙ্গোলিয়া ও তিব্বতে বেশি পরিচিত ছিলেন। ১০১২-এ দীপংকর গিয়েছিলেন সুবর্ণদ্বীপে (ইন্দোনেশিয়া)।

সেসেসেেেসেসেসসসসেস সেখানে ধর্মকৃতির কাছে মহাযান পন্থার ধর্মীয় দর্শন সম্পর্কে শিক্ষা নেন। ১২ বছর পর দীপংকর ফিরে এলেন ভার‌তবর্ষে। রাজা নয়পাল তাঁকে বিখ্যাত বিক্রমশীলা বিহারের প্রধান আচার্য পদে নিযুক্ত করলেন। তিব্বতরাজ ইয়ে-সেস-ওড্‌ বীর্যসিংহকে নিমন্তণপত্র সহ পাঠিয়েছিলেন ভারতে, দীপংকরকে তিব্বতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। একদল সঙ্গী এবং প্রচুর পরিমাণে স্বর্ণ সংগে নিয়ে এসেছিলেন বীর্যসিংহ।

তাঁরা বিক্রমশীলাবিহারে এসে দীপংকরকে সেই উপঢৌকন দিয়ে তিব্বতে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। কিন্তু দীপংকর সেই স্বর্ণ এবং নিমন্ত্রণ দুই প্রত্যাখ্যান করলেন। পরেরবার রাজা আরও বেশি স্বর্ণসহ আবার নিমন্ত্রণ পাঠালেন যাতে দীপংকর তিব্বতে আসতে সম্মত হয়। এই রকম সময়ে তুর্কিস্তানের গারলগ্‌ নামক স্থানের মুসলমান শাসক তিব্বতের বন্দি করে তার সমস্ত সোনা লুট করে নেন। সেই শাসক বললেন, হয় তিব্বতরাজকে বৌদ্ধধর্ম ত্যাগ করেতে হবে অথবা তাঁর দেহের ওজনের সমপরিমান স্বর্ণ দিতে হবে তবেই তিনি মুক্তিলাভ করতে পারবেন।

রাজা বৌদ্ধধর্ম ত্যাগ করতে সম্মত না হওয়ায় কারাগারেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। জয়শীল নামে এক বৌদ্ধ ছাত্র ঐ সময় ভারতে শিক্ষালাভ করার জন্য বাস করছিলেন। তাকেও বলা হয়েছিল তিব্বতে দীপংকরকে আনার জন্য রাজি করাতে। তিব্বতরাজ মারা যাওয়ার পর জয়শীল এবং বীর্যসিংহ আবার দীপংকরের সাথে দেখা করে তিব্বতরাজের আত্মত্যাগের কথা জানালেন এবং তাঁকে তিব্বত রাজদরবারে আমন্ত্রণ জানালেন। এবার তিনি তিব্বতে যেতে সম্মত হলেন।

অনুমান করা হয়, ১০৪০-এ দীপংকর ভারত থেকে রওয়ানা হয়ে ১০৪১-এ নেপালে কাটিয়ে তারপর ১০৪২-এ তিব্বতে পৌঁছেছিলেন। তখন তাঁর বয়স ৫৯ বছর। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে দ্বিধা করেননি। অতীশের তিব্বত যাত্রা খুবই চিত্তাকর্ষক। অক্লান্ত উৎসাহে তিনি এগিয়ে চলেছেন দুর্গম পথ, কঠোর আবহাওয়া কোন কিছুই তাঁকে নিরুৎসাহিত করতে পারেনি।

অতীশ তিব্বতে প্রবেশ করে গু-জে নামক স্থানে পৌঁছলে একদল ঘোড়সওয়ার এসে তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন। সেই ঘোড়সওয়ারদের হাতের বর্শার আগায় উড়ছে শ্বেতপতাকা, বাদ্যযন্ত্রে বাজনা বাজছে আর তারই সংগে মন্ত্র উচ্চারিত হচ্ছে, " ওঁ মণিপদ্মে হুম"। এইখানেই অতীশ জীবনের প্রথম চা পান করেন। এই চা তিব্বতের বিশেষ নিয়েমে প্রস্তুত করা হয়েছিল। চায়ের প্রশংসা করে অতীশ একটি কবিতা রচনা করেছিলেন।

এই কবিতাটি তিব্বতে খুবই জনপ্রিয়। দীপংকরের চেষ্টায় তিব্বতের বিভিন্ন অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের পুনর্জাগরণ আরম্ভ হয়ে গেল। তাঁর রচিত 'বোধি পাঠ প্রদীপ' গ্রন্থখানি বৌদ্ধধর্ম প্রচারের কাজে খুবই সহায়ক হয়ে উঠল। মহাযান বৌদ্ধ পন্থার তত্ত্ব ও দর্শনের বাণী প্রচার করে সারা বিশ্বের মুক্তি ও মোক্ষলাভের পথপ্রদর্শক হলেন অতীশ দীপংকর। তিব্বতে, নেপালে এবং ভারতবর্ষে তিনি অনেক বৌদ্ধবিহার স্থাপন করেছিলেন এবং প্রায় শতাধিক বই রচনা এবং অনুবাদ করে গেছেন।

তিনি ব্যবহার করতেন একটি ত্রিভুজাকৃতি মস্তকাবরণ। পরে তিব্বতের সমস্ত লামারা ঔ রকম টুপি বা শিরোভুষণ ব্যবহার করতে আরম্ভ করলেন। ১৩ বছর তিব্বতে কাটিয়ে ১০৫৪-এ ৭৩ বছর বয়সে লাসার নিকটবর্তী নেথান নামক স্থানে তারাদেবীর মন্দিরে অতীশ দীপংকর দেহত্যাগ করেন। 'নাম' নামে একটি জায়গায় তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে একটি মন্দির নির্মিত হয়, এই মন্দিরের নাম দেওয়া হয় সগরো-মা(sgro-ma)। প্রথমদিকে দীপংকর স্থির করেছিলেন যে তিনি তিব্বতে তিন বছরের বেশি থাকবেন না, কিন্তু পরে কোনও না কোন কারণে তাঁর তিব্বত বাসের সময় কেবলই বেড়ে যেতে থাকে।

শেষপর্যন্ত তাঁর আর ভারত বা বিক্রমপুরে ফিরে আসা হয়নি। নিজের যুগে তিনি ছিলেন বৌদ্ধজগতের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাক্তিত্ব, রাজা মহারাজরাও ভক্তিভরে মাথা নত করতেন দীপংকরের চরণে। বাংলার পালসম্রাট নয়পালকে দীপংকর একটি পত্র লিখেছিলেন। তাতে তিনি লিখেছিলেন। "ঔদ্ধত এবং অহংকার পরিত্যাগ করো।

শূণ্যতার সাধনা কর। তোমার নিজের দোষ সবাইকে জানাও। অন্যের দোষ দেখো না। ...করূণা করো....বাসনা পরিত্যাগ করো। সন্তুষ্ট থাকো এবং সৎ পথে চলো।

" বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ড. নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন, চারিত্রিক দৃঢ়তা, বিদ্যাবেত্তা, মননশীলতা এবং আধ্যাতিক মহিমা সবকিছু নিয়ে দীপংকর শ্রীজ্ঞান সেই যুগের বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষের আকাশে ছিলেন উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। (সংগৃহীত) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।