আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

“সরকারি ছুটি!!”

আজ ২৬শে মার্চ, মহান স্বাধীনতা দিবস। শ্রদ্ধা জানাচ্ছি সকল মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনা মায়েদের। একাত্তরে আমি ছিলামনা। বাংলার জন্মযুদ্ধ নিজ চোখে দেখা বা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সৌভাগ্য আমার হয়নি। কারণ, বিধাতা সেই গর্বের অংশীদার হওয়ার জন্য তখন পৃথিবীতে আমাকে পাঠাননি।

তাই আমার দেখা হয়নি কিছুই। কিন্তু, কল্পনার দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করি আমাদের গর্বের একাত্তর। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা থেকে শুরু করে বাংলা বিজয় পর্যন্ত। শহীদের রক্ত ও মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে হস্তগত হওয়া আমাদের স্বাধীনতা। ১৯৭১এর ২৬শে মার্চ আমাদের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরার দিন।

সূত্রপাত হয়েছিলো একটি সূর্য ছিনিয়ে আনবার। আজ স্বাধীনতার ৪৩বছর পরে আমরা সেই দিনটাকে স্মরণ করি। সেই সব গর্বিত বাঙ্গালীদের শ্রদ্ধা করি। কিন্তু আসলেই কী আমরা তা করি? হয়তো আপনার উত্তর হবে, “কেনো করবোনা! সবাইইতো করি”। আমি বলবো, আসলে সবাই করিনা।

গানের তাল, মাত্রা, এবং সুর ঠিক না থাকলে যেমন গান হয়না, তেমনি দিবস পালন করা বা শ্রদ্ধা জানানোর মতো না জানালে তা শ্রদ্ধা করা হয়না। এই কথায় অনেকেই দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো তা-ই সত্যি, যা আমার নিজ চোখে দেখা, নিজ কানে শুনা, নিজ অভিজ্ঞতায় জানা। এটা আমার মতো অনেকেই হয়তো জেনে থাকতে পারেন।

লাখো কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীতে অংশগ্রহণ করে এসে যখন অফিসে বসে আছি, ঠিক তখন কানে ভেসে আসছে “বসন্ত বাতাসে সইগো বসন্ত বাতাসে” গান!!” যেখানে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলী নিয়ে রচিত অসংখ্য গান রয়েছে, এবং আজকের দিনে যা গাওয়া প্রয়োজন, তা না গেয়ে এখানে গাওয়ানো হচ্ছে লোকসঙ্গীত!! শ্রদ্ধা জানানোর কয়েকপ্রকার ভাষা আছে।

হিন্দুরা গান গেয়ে ভগবানকে আরাধনা করে। মুসলিমরা নামাজ এবং ওয়াজের মাধ্যমে আল্লাহ্‌কে আরাধনা করে। প্রত্যেকের রয়েছে নিজ নিজ সূর এবং মাত্রা। এটা প্রত্যেক ধর্মেই নিজ নিজ ধর্ম হতে প্রাপ্ত। আর আমাদের স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ও মাতৃভাষা দিবস এর জন্য রয়েছে অসংখ্য গান ও অসংখ্য কবিতা।

কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে, এই বিশেষ দিনগুলোতেও আমাদের শুনতে হয় লোক, আধুনিক ও ব্যান্ডের গান। আমি যখন এই লেখাটা লিখছি, ঠিক তখনো আমার কানে ভেসে আসছে “মরার কোকিলে” গান!! কেনো! আমরা কী এই একটা মহা গুরুত্বপূর্ণ দিনেও শরীর দুলানো গান না গেয়ে পারিনা!!

আজ ২৬শে মার্চ ২০১৪ খ্রিস্টাব্দ। আমাদের জাতীয় সঙ্গীত এক সাথে ৩ লক্ষ মানুষে গেয়ে বিশ্ব রেকর্ড হয়েছে। গিনেস বুকে নাম উঠেছে আমাদের, আমাদের দেশের। এ ঐতিহাসিক ঘটনা অবশ্যই আমাদের গর্বের।

কিন্তু ফেইস বুকে আমার এক বন্ধু লিখেছেন সেখানে বিশ্বরেকর্ড সৃষ্টি করার পরেই নাকি শুরু হয়েছে “আমার ঘুম ভাঙ্গাইয়া গেলো-রে মরার কোকিলে” গান!! বুঝুন অবস্থা!! তাইতো উপরে বলেছি, আমরা আসলেই সেই দিনগুলোকে প্রকৃতভাবে শ্রদ্ধা করতে পারিনা। এ আমাদের ব্যর্থতা। আমরা যে কতোটুকু হতভাগা তা আমাদের এই আচরণগুলোই প্রমাণ করে।

মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, বিশেষ করে এই তিনটি দিবসেই দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থাকে বন্ধ! এ আমাদের সরকারি ছুটি! শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আরামে ঘুমানো ও বেড়ানোর ছুটি! যে সুযোগ করে দেয় সরকার। আশ্চর্য হবার কারণ নেই।

এই দিনগুলোর জন্য শিক্ষকরা অপেক্ষা করে শ্বশুরবাড়ি বা আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে গিয়ে ফুর্তি করার। আমার আশেপাশে নিজের চোখে দেখাগুলো তা-ই বলে। আমার বোনজামাইও তার শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে আসে! কিন্তু, আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিশেষ তিনটি দিবসে স্কুল খোলা রেখে শিক্ষার্থীদের কেনো দিবসগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ করে দেয়া হয়না! কেনো এই দিনগুলোতে সরকারি ছুটি দিয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বিশেষ আরাম প্রদান করা হয়! যারা এই দেশের জন্য যারা নিজের জীবন দান করলো, যারা রক্ত দান করলো এবং অমূল্য ধন ইজ্জত দান করেছে, তারা-কী এই দিনে আরামে ঘুমিয়েছিলো!! হতাশার হলেও সত্য, প্রাণ দান করে যারা এই দেশটাকে দিয়ে গেছে, তাদের এই দিবসে আমরা আরামে ঘুমাবোনা কেনো। আমাদেরতো এখন আর যুদ্ধ করতে হচ্ছেনা! কিন্তু এ দায় কার?

আমার বাড়ির উঠান থেকে মাত্র ৭ ফুট দূরত্বে একটি সরকারী স্কুল। আমরা গ্রামের ছেলেরা মিলে রাষ্ট্রের বিশেষ দিবসগুলোতে টানা কয়েক বছর সেখানে অনুষ্ঠান করেছি ।

এবং অবশ্যই শিক্ষার্থীরা আমাদের সাথে অংশগ্রহণ করেছে বিপুল উদ্দীপনায়। কিন্তু শিক্ষকের বাড়িতে গিয়ে অনুরুধ করার পরেও তারা আসেননা! বলেন, “একটি দিনের ছুটি মাত্র”। বাড়িতে বসে দেয় লম্বা ঘুম, নয়তো শ্বশুরবাড়ি! আহা! এই দিনটা শ্বশুরবাড়ি যাবার জন্য আদর্শ দিন!

আপনি প্রশ্ন করবেন হয়তো, আমি শুধু স্কুলের কথা বলছি কেনো? কথায় আছে “যার সাতে হয়না, তার সাতাশেও হয়না”। শিক্ষকরা যদি স্কুলে থেকে শিক্ষার্থীদের নিয়ে দিবস উপযোগী অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন, তাহলে শিক্ষার্থীরা সেই দিবসের মহত্ত্ব সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের চেতনায় চৈতন্য আসতো। বিশেষ দিন ছাড়া বিশেষ কিছু শিক্ষা হয়না।

রাত যেমন ঘুমানোর জন্য, দিন তেমন কর্মের জন্য। তেমন শুক্রবারও ঘুমানোর জন্য। রবিবারে ঘুমাইলে চাকরী চলে যাবার ভয় থাকে। তাই কেউ ঘুমায়না। বিশেষ দিন বা ক্ষন ছাড়া পূজাপার্বণ, নামাজ রোজা কিছুই হয়না।

মূল কথা সময়ে করতে হবে সময়ের কাজ। তাই ২৬শে মার্চ সারাবছর হবেনা। সারাবছর মঞ্চ বানিয়ে ২৬ তারিখের অনুভূতি আসবেনা। তাই এই দিনে স্কুল সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের উপস্থিত থেকে শিক্ষার্থীদের চেনানো জানানো উচিৎ যে, আজকের দিনে সেই সময় কী ঘটেছিলো। মানলাম সারাবছরই শেখান যায়।

কিন্তু সারাবছরই শহীদমিনারে শ্রদ্ধা জানাইনা আমরা। বিশেষ প্রয়োজনও নেই। কেননা, তার জন্য রয়েছে বিশেষ দিন। তাই সরকার অজ্ঞ্যানের মতো ছুটি দিয়ে দিলেও শিক্ষক শিক্ষিকাদের প্রয়োজন ছিলো সেই ছুটি প্রত্যাখ্যান করা। আজ যারা শিক্ষক-শিক্ষিকা অতীতে তারাই শিক্ষার্থী ছিলো।

এবং আজ যারা শিক্ষার্থী ভবিষ্যতে তারাই হবে শিক্ষক-শিক্ষিকা। তাই এই শিক্ষাটা স্কুল থেকেই নেয়া উচিৎ ছিলো। বর্তমানের শিক্ষক শিক্ষিকারা তাদের ছাত্রজীবনে শিক্ষা পায়নি বলেই তারা তাদের ছাত্রছাত্রীদের সেই শিক্ষা দিতে পারছেনা। তাই গড়ে উঠছেনা এমন শিক্ষক শিক্ষিকা।

সরকারের মন্ত্রী, এমপি, ও অন্যান্য কর্মকর্তারা থাকেন এই বিশেষ দিবসে মঞ্চে বক্তৃতার মাধ্যমে কীভাবে টেলিভিশনের পর্দায় চেহারা দেখাবেন! তাদের এসব ভাববার সময় নেই।

নতুন প্রজন্ম কীভাবে দেশের মুক্তি মুক্তিযুদ্ধাদের সম্মান জানাবে তার কোনো কর্মপরিকল্পনা নেই। তাই শিক্ষক-শিক্ষিকারা দিনপঞ্জি দেখে খুঁজেন আর কতোদিন পর ২৬শে মার্চ আসছে। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা শিক্ষক শিক্ষিকারা যে এমন তা-ও নয়। অবশ্যই ব্যতিক্রমও রয়েছে। কিন্তু সরকার রাষ্ট্রীয় এই বিশেষ দিনগুলোতে সরকারি ছুটি দিয়ে তাদের এই দিনগুলোতে নাক ডাকিয়ে ঘুমাবার বা শ্বশুরবাড়ি বেড়াবার সুযোগ করে দিয়েছে।

যার কারনে আজ স্বাধীনতা দিবসেও কানে ভেসে আসছে “মরার কোকিলে বা বসন্ত বাতাসে” গান। কারন, সৎ শিক্ষার অভাব। সরকারের উচিৎ ছিলো এই বিশেষ রাষ্ট্রীয় দিবসগুলোতে ছুটি না দিয়ে স্কুল খোলা রাখার। তাতে করে আগামীদিনে এই বিশেষ দিবসগুলোর মর্মার্থ, মহত্ত সবাই আরও বেশি করে উপলদ্ধি করতে পারবে। যদিও বিশ্বরেকর্ড করার জন্য শুধুমাত্র ২৬শে মার্চ ২০১৪ ইং সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা দেখতে পেয়েছি।

তা অবশ্য ব্যতিক্রম। সরকার শুধু মুখে বলে আমরা স্বাধীনতার স্বপক্ষের। কিন্তু সরকার এই বিষয়ে উদাসীন।


২৬শে মার্চ ২০১৪ খ্রিস্টাব্দ। ।

সোর্স: http://prothom-aloblog.com

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।