আমার সঙ্গে প্রকৃতির শত্রুতা আছে বোধ হয়। গত ৪ নভেম্বর প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবর মঞ্চে আমরা সবাই সমবেত হয়েছি। শিল্পীরা এসেছেন, গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এসেছেন। আর এসেছেন শ্রোতৃমণ্ডলী। সেদিন সকাল থেকেই খুব বৃষ্টি হচ্ছিল।
বিকেলে আমাদের অনুষ্ঠান করতে পারব কি না, আমাদের মনে সারা দিন ধরেই সেই চিন্তা ছায়া ফেলে রেখেছিল। ইন্টারনেটে আবহাওয়ার সাইটগুলোয় গিয়ে দেখা গেল, বিকেলবেলা ঢাকায় বৃষ্টি থেমে যাবে। সত্যি সত্যি বিকেলের দিকে বৃষ্টি কমে আসতে লাগল, তারপর থেমে গেল, আমরা অনুষ্ঠান শুরু করলাম।
আমি একটা কৌতুক বললাম:
শীতের আগে আগে রেড ইন্ডিয়ানরা তাদের নেতাকে জিগ্যেস করল, ‘এবার শীত পড়বে কেমন?’
সাবধানের মার নেই—নেতা ভাবলেন। তিনি বললেন, ‘ভালোই শীত পড়বে।
তোমরা জ্বালানি কাঠ জোগাড় করে রাখো। ’
এক সপ্তাহ পরে রেড ইন্ডিয়ানরা আবার এল তাদের নেতার কাছে: ‘সর্দার, এবার শীত কেমন পড়বে?’
সর্দার ভাবলেন, অনুমানে কথা বলা ঠিক নয়। তিনি টেলিভিশন খুলে সিএনএন দেখতে লাগলেন। সিএনএনে আবহাওয়ার খবরে বলা হলো, এবার খুব শীত পড়বে।
সর্দার তাঁর লোকদের ডেকে বললেন, ‘এ অঞ্চলে এবার খুব শীত পড়বে।
তোমরা আরও বেশি করে জ্বালানি কাঠ জোগাড় করো। ’
সবাই ছুটল জ্বালানি কাঠ জোগাড় করতে।
এক সপ্তাহ পর নেতা আবার সিএনএন খুলে আবহাওয়ার খবরে দেখলেন, এবার তাদের এলাকায় ভয়াবহ শীত পড়বে। তাঁর মনে সন্দেহ হলো। তিনি সিএনএন অফিসে ফোন করলেন।
আবহাওয়া বিভাগের সাংবাদিকের কাছে জানতে চাইলেন, ‘আপনারা কি নিশ্চিত যে আমাদের এলাকায় এবার খুব শীত পড়বে?’
সিএনএনের সাংবাদিক বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমরা খুব নিশ্চিত। এবার অনেক শীত পড়বে। ’
‘আপনারা এতটা নিশ্চিত হলেন কী করে?’
সিএনএনের সাংবাদিক জবাব দিলেন, ‘আমরা পুরোপুরি নিশ্চিত। কারণ, ওই এলাকার রেড ইন্ডিয়ানরা পাগলের মতো জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করছে। এরপর আর কোনো সন্দেহই থাকে না যে এবার শীত পড়বে প্রচণ্ড।
’
এই কৌতুকটা সেদিন প্রথম আলোর অনুষ্ঠানে বলে নিয়ে আমি বললাম, আমরা নিশ্চিত যে আজকে বিকেলে বৃষ্টি হবে না। কারণ, আমরা এটা ইন্টারনেটে আবহাওয়া-বিষয়ক সাইট থেকে দেখে নিয়েছি।
দুটো গান, দুটো বক্তৃতা হলো। আমি প্রথম আলোর তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক সাংবাদিক পল্লব মোহাইমেনকে বললাম, ‘তোমার মোবাইল ফোনে ওয়েদার সাইটে গিয়ে দেখো তো, ঢাকায় বৃষ্টি পড়বে কখন। ’ পল্লব মোবাইলে ইন্টারনেটে ঢুকে আবহাওয়ার খবর দেখে বলল, রাত আটটার আগে বৃষ্টি হবে না।
আমি মাইক্রোফোনে বললাম, দর্শকমণ্ডলী, আপনাদের জন্য সুখবর আছে। ওয়েদার ডট কম জানাচ্ছে, আজ রাত আটটার আগে আর বৃষ্টি হবে না।
তখন বাজে পাঁচটা কি সাড়ে পাঁচটা।
আমার ঘোষণা শেষ হওয়ার আগেই প্রথমে টিপটিপ করে, তারপর ঝমঝম করে বৃষ্টি আরম্ভ হয়ে গেল। আমরা যে যেখানে পারলাম, মাথা বাঁচানোর ঠাঁই খুঁজতে লাগলাম।
অনুষ্ঠান অসমাপ্ত রেখেই সমাপ্তি এসে গেল।
তাই বলছিলাম, আমার সঙ্গে প্রকৃতির কোনো একটা শত্রুতা আছে।
প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যা বের হলো ২৩, ২৪ আর ২৫ নভেম্বর। কী সুন্দর হয়েছিল সংখ্যাগুলো! কত আশার কথা লিখেছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। সবচেয়ে বড় কথা, দেশের নানা জায়গায় যাঁরা সুন্দর সুন্দর কাজ করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, পলান সরকার বা কার্তিক পরামানিকের মতো লোকেরা লিখেছেন।
আর লিখেছেন অনেক বিদেশি গণ্যমান্য ব্যক্তি: বিল গেটসের বাবা উইলিয়াম গেটস, স্পেনের রানি সোফিয়া কিংবা সৌরভ গাঙ্গুলী। সেই সব সংখ্যা দেখে, পড়ে আমার মনটা খুব উদ্বেল হয়ে পড়ল, আমি একটা কলাম লিখলাম, ‘কী যে ভালো আমার লাগল’।
ওই লেখা যেদিন প্রকাশিত হলো, সেদিনের প্রধান খবর হয়ে উঠল তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন, শতাধিক শ্রমিকের নিষ্ঠুর করুণ মৃত্যু, আর চট্টগ্রামে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভার মাথার ওপর ভেঙে পড়ে পথচারীদের মৃত্যু।
আমি মনে মনে ভাবলাম, এ জন্য আমিই দায়ী, আমি কেন লিখতে গেলাম, কী যে ভালো আমার লাগল। আমি যা বলি, ঘটনা ঘটে তার উল্টো।
আমি তো দায়ী বটেই। ডেইলি স্টার-এ একটা লেখা পড়লাম ২৪ ডিসেম্বর ২০১২, শিরোনাম, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড। দোষী কয়েকজন, দায়ী অনেকেই। এ ফিউ আর গিল্টি, মেনি আর রেসপনসিব্ল।
গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া হয় না, অথচ কাজটা খুব কঠিন কিছু নয়।
তাজরীন গার্মেন্টসের ভবনটা দেখতে ছিল একটা করপোরেট অফিসের মতো। পয়সা সেখানে কম খরচ করা হয়নি, কিন্তু ওই ভবনটা একটা শ্রমঘন কারখানা হতেই পারে না। তবে সামান্য কিছু সতর্কতা, কিছু পদক্ষেপ, কিছু পরিবর্তন ভবনটাকে নিরাপদ করতে পারত, আর সময়মতো শ্রমিকদের কেন বের হতে দেওয়া হয় না, কী চুরি করবে শ্রমিকেরা, আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর কোন সম্পদটা বাঁচালেন কর্মকর্তারা? এই যে প্রশ্নগুলো, এসব তো আমরা আগেও তুলতে পারতাম। আমি লিখতে পারতাম, সরকারি পরিদর্শকেরা কারখানা পরিদর্শন করতে যেতে পারতেন, গার্মেন্টস মালিকেরা আগেই ব্যবস্থা নিতে পারতেন। আমরা কেউই আমাদের দায়িত্ব পালন করিনি।
এই যে চট্টগ্রামে পথচারীদের মাথার ওপর ফ্লাইওভার ধসে পড়ল, কয়েকজন দোষী ব্যক্তিকে ধরা হয়েছে, বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছে। বিচার করা না হলে দুর্ঘটনার নামে এই গণহত্যা চলতেই থাকবে। আর এই অব্যবস্থা চলতে দেওয়ার জন্য আমরা সবাই দায়ী, আপনি, আমি, আমরা—সবাই।
আমি ভালো কথা বললেই খারাপ কিছু ঘটে। প্রকৃতি আমার কথার বিপরীতে আশ্রয় নেয়।
আজ তাই নেতিবাচক কথাই বললাম। আজ যেন ইতিবাচক কিছু ঘটে, কোথাও কোনো সুসংবাদের জন্ম হয়।
দেশের অগ্রগতির কথা সরকার যখন বলে, তখন সাংবাদিকেরা পাত্তা দেন না। কিন্তু বিদেশের কেউ যদি বাংলাদেশের উন্নতির প্রশংসা করে, সাংবাদিকেরা গদগদ হয়ে যান। এই কারণে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তাঁর অবসর সময়ে সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ দিতে চেয়েছেন।
আমি ঠিক করেছি, মুহিত সাহেবের পাঠশালায় আমি সবার আগে ভর্তি হব।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
দৃষ্টি আকর্ষণ: বিভিন্ন সময়ে আনিসুল হকের প্রকাশিত অসংখ্য কলামের বিশাল এক আর্কাইভ দেখতে এখানে ক্লিক করতে পারেন ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।