সংযুক্ত আরব আমিরাতের কারাগারে এখন রয়েছেন ৯৪৭ জন বাংলাদেশি। মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে চুরি, ডাকাতি ও খুন পর্যন্ত নানা অপরাধের অভিযোগ তাঁদের বিরুদ্ধে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে বিদেশিদের মধ্যে অপরাধীর সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশিদের অবস্থান তালিকার প্রথম দিকেই।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অপরাধপ্রবণতা গুরুত্বপূর্ণ শ্রমবাজার আমিরাতে জনশক্তি রপ্তানি বন্ধের একটি বড় কারণ। সৌদি আরব, কুয়েতসহ আরও কিছুসংখ্যক দেশেও বাংলাদেশিদের অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে।
এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সার্বিক শ্রমবাজারে।
আমিরাতে কারাবন্দী ৯৪৭ বাংলাদেশির মধ্যে ১৯ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। ১০৪ জনের যাবজ্জীবন দণ্ড হয়েছে। এ ছাড়া কয়েক শ বাংলাদেশি সাজা ভোগ শেষে দেশে ফেরার অপেক্ষায় আছেন।
সম্প্রতি আমিরাতি এক বৃদ্ধাকে হত্যার দায়ে ফেনীর জয়নাল আবেদিন নামের এক যুবকের বিচার চলছে শারজার শরিয়াহ আদালতে।
প্রবাসী কর্মী হয়ে সে দেশেরই একজন নাগরিককে হত্যার এ ঘটনায় আমিরাতে বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনা হয়। বাংলাদেশিরা নিজেদের মধ্যেও প্রাণঘাতী মারামারিসহ নানা ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছেন।
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে বিদেশের কারাগারগুলোতে থাকা বাংলাদেশিদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সে অনুযায়ী, ২৩টি দেশে বর্তমানে চার হাজার ৫৪৬ জন বাংলাদেশি কারাবন্দী। তবে জনশক্তি রপ্তানিকারক, গবেষকসহ অন্যান্য সূত্রের দাবি, বাস্তবে এই সংখ্যা আরও বেশি।
মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, খুনের মতো অপরাধে জড়িত থাকায় বিভিন্ন দেশে আমিরাতের ১৯ জনসহ ৫০ জন বাংলাদেশির মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়েছে। অন্য মৃত্যুদণ্ড পাওয়াদের মধ্যে রয়েছেন সৌদি আরবে ১৩ জন, কুয়েতে ১০ জন এবং বাহরাইন, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে তিনজন। এ ছাড়া নানা ধরনের অপরাধের কারণে যাঁরা বিদেশের কারাগারে আছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সৌদি আরবে এক হাজার ২৫৫, মালয়েশিয়ায় ৫৫৬ (ক্যাম্পে ৫৩৪ জন), ওমানে ১৪৩, ইরাকে ৮৮, হংকংয়ে ৩৮, সিঙ্গাপুরে ৯০, মালদ্বীপে ৫২, ইতালিতে ৩৫, গ্রিসে ৩৫, কাতারে ২৩, তুরস্কে পাঁচ, ব্রুনাইতে চার, আজারবাইজানে দুই ও জর্জিয়ায় দুজন। তাঁদের বিরুদ্ধে চুরি, সংঘবদ্ধ ডাকাতি, মাদক পাচারসহ নানা ধরনের অপরাধের অভিযোগ রয়েছে।
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিদেশে যাওয়ার আগে প্রত্যেক কর্মীকে সংশ্লিষ্ট দেশের আইনকানুন সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা (ব্রিফিং) দেওয়ার কথা।
কিন্তু বেশির ভাগ বিদেশগামীকেই তা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৬ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৮৭ লাখ বাংলাদেশি বিদেশে গেলেও মাত্র ১১ লাখকে ব্রিফিং দেওয়া হয়েছে। ফলে একটি বড় অংশই কিছু না জেনে বিদেশে গেছেন। অপরাধপ্রবণতার পেছনে এরও একটি ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হয়। তাই সম্প্রতি বিভিন্ন দূতাবাস থেকে ব্রিফিংয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, সংখ্যার বিচারে গুটি কয়েক বাংলাদেশির এই অপরাধপ্রবণতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পুরো দেশ। সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব (শ্রম) এ কে এম মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ভিসা বন্ধের অন্যতম কারণ এই অপরাধপ্রবণতা। সরকারি হিসাবে আমিরাতে নয় লাখ ৮৫ হাজার বাংলাদেশি আছেন। আর জেলখানায় আছেন ৯৪৭ জন। সে হিসাবে আমিরাতে হাজারে একজন বাংলাদেশি অপরাধ করেন।
কিন্তু সমস্যা হলো, একজনও অপরাধ করলেও তাঁর পাসপোর্ট যেহেতু বাংলাদেশের, তাই পুরো দেশেরই বদনাম হয়।
কুয়েতেও জনশক্তি রপ্তানি বন্ধের একটি বড় কারণ বাংলাদেশিদের অপরাধপ্রবণতা। সৌদি আরবেও কিছুসংখ্যক বাংলাদেশির অপরাধের কারণে সেখানে নেতিবাচক অবস্থান তৈরি হয়েছে। তবে সৌদিপ্রবাসীরা বলে থাকেন, সে দেশে কথিত বাংলাদেশি অপরাধীদের একটি বড় অংশই আসলে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, বিদেশে অপরাধের কারণে শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
অনেক শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ এই অপরাধপ্রবণতা। তবে অনেক সময় এশিয়ার অন্যান্য দেশের অপরাধের দায় বাংলাদেশের ওপর এসে পড়ে। এসব ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে।
খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বিদেশে একেকজন বাংলাদেশি দেশের একেকজন প্রতিনিধি। তাই তাঁদের কাছে অনুরোধ, তাঁরা যেন এমন কিছু না করেন, যাতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়।
বিদেশে কোনো বাংলাদেশি কারাবন্দী হলে কিংবা আদালতে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হলে সম্ভাব্য ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ দিয়ে তাঁদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড। এ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক (কল্যাণ ও অর্থ) মু. মোহসিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো কর্মী বিদেশে যাওয়ার আগে আমরা তাঁকে বারবার বলে দিই, তিনি যেন কোনো অপরাধে জড়িয়ে না পড়েন। কারণ, একজন বাংলাদেশির অপরাধের কারণে বাকিদেরও নানা সংকটে পড়তে হয়। কাজেই প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে অনুরোধ, তাঁরা যেন কেউ অপরাধে জড়িয়ে না পড়েন। ’
জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা বলছেন, কোনো দেশে বাংলাদেশিরা বড় ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়লে সেই দেশটি আর এ দেশের কর্মীদের বিশ্বাস করতে চায় না।
এর ফলে শ্রমবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর বড় উদাহরণ কুয়েত। সম্প্রতি কয়েকটি দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে বিষয়টি উল্লেখ করে ঢাকায় সতর্কবার্তাও পাঠানো হয়েছে।
জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘গুটি কয়েক বাংলাদেশি মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে নেতিবাচক ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন। কিন্তু এর কুফল ভোগ করতে হচ্ছে সবাইকে।
তাই আমরা প্রবাসী বাংলাদেশিদের অনুরোধ করছি, তাঁরা যেন কোনো অপরাধে না জড়ান। ’
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।