ক্রিকেট মানে কী? নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় সেই কবে বলে গেছেন, ক্রিকেট মানে হলো ঝিঁঝি পোকা। কিন্তু না, বাংলাদেশের প্রত্যেকটা মানুষের কাছে ক্রিকেটকে অভিধানের মানে দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা যাবে না। ক্রিকেট মানে আমাদের কাছে রান, উইকেটের খেলা নয়।
ক্রিকেট মানে আমাদের কাছে আবেগের রঙধনু, স্বপ্নের সীমানা, প্রত্যাশার ভেলা। ক্রিকেট মানে আমাদের কাছে বিজয়ের আনন্দে সপ্তম স্বর্গে পৌঁছানো।
ক্রিকেট মানে আমাদের কাছে হতাশার নুড়িপাথর। ক্রিকেট আমাদের কাছে কান্নার—কখনো আনন্দের অশ্রুজল, কখনো বেদনার।
ক্রিকেট নিয়ে মানুষের এই আবেগের তরঙ্গটা স্পষ্ট বোঝা যায় প্রথম আলোর পাঠকদের মন্তব্যগুলোতে। মাত্রই কয়েক মাস আগে নিউজিল্যান্ডকে বাংলাওয়াশ করার সময় পাঠকেরা আবেগে উদ্বেল হয়ে মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু কিছুদিন ধরে টানা ব্যর্থতার বৃত্তে থাকা বাংলাদেশ দলকে নিয়ে পাঠকদের করা মন্তব্যে মিশে থাকছে তীব্র হাহাকার।
কঠোর সমালোচনা। থাকছে বিভিন্ন দিকনির্দেশনাও।
ক্রিকেট দলের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক যে প্রেমিক-প্রেমিকার মতো, যাতে তীব্র ভালোবাসার সঙ্গে চোরাস্রোতে মিশে থাকে তীব্র অভিমান—সেটিও স্পষ্ট পাঠকদের মন্তব্যে। অনেক পাঠকই মন্তব্য করেছেন, ‘আর কখনো বাংলাদেশ দলের খেলাই দেখব না। ’ তবে এটাও নিশ্চিত, সেই সব পাঠকই বাংলাদেশ দলের পরের ম্যাচটায় সবার আগে টিভি খুলে বসবেন, টসটাও না দেখলে যে শান্তি নেই।
সেই সব পাঠকই চৈত্রের তীব্র দাবদাহকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে স্টেডিয়ামের লম্বা লাইন কিংবা উদোম সিটে গিয়ে আসন গাড়বেন। এঁরাই পথের ধুলো আর মশার কামড় অগ্রাহ্য করে গলাটাকে জিরাফের মতো বানানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে, পায়ের পাতায় ভর দিয়ে তাকিয়ে থাকবেন টিভি শোরুমগুলোর সামনে। শুধু একটাই আশা—সেদিন হয়নি, আজ যদি হয়!
বাস্তববাদী পাঠকেরা অবশ্য বলছেন, এটাই বাংলাদেশের সামর্থ্য। সুপার টেন-এ বাংলাদেশ যে চারটি প্রতিপক্ষ পেয়েছে, এর প্রতিটিই শক্তি-সামর্থ্যে-যোগ্যতায় বাংলাদেশের চেয়ে অনেক মাইল এগিয়ে আছে। এই চার দলের সঙ্গে বাংলাদেশ না জিতলে অঘটন নয়।
জিতলেই বরং সেটি অঘটন। মোহাম্মদ সিরাজুম মুনির নামে একজনের মন্তব্য, ‘যেটা স্বাভাবিক, সেটাই হয়েছে। বাংলাদেশ গ্রুপের আর চারটি দলের সঙ্গে জেতা সম্ভব নয়। খুব বেশি হলে একটা ম্যাচ জিততে পারে এবং সেটা হবে অঘটন। বাংলাদেশের মতো দলের পক্ষে সেমিফাইনালে যাওয়ার জন্য কমপক্ষে দু-তিনটি ম্যাচ জেতা তো সম্ভব নয়।
তাই বাংলাদেশ দল খুব খারাপ খেলেছে, এটা বলা ভুল। বাংলাদেশ ভারত, পাকিস্তানের সঙ্গে পর পর ম্যাচ জিতবে, এটা আশা করা বোকামি; বরং দুই-তিন বছর পর পর বাংলাদেশ টেস্ট খেলুড়ে দেশের সঙ্গে একটি ম্যাচ জেতে সেটাই স্বাভাবিক। আমরা আমাদের ছেলেদের সামর্থ্য চিন্তা না করে অহেতুক আকাশে উঠিয়ে দিই। বরং সামর্থ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ যা খেলতে পারে, সেটাই আশা করা উচিত। ’
সুজন নামের এক পাঠক মন্তব্য করেছেন, ‘টাইগারদের চেষ্টা অব্যাহত ছিল।
তারা ইচ্ছে করে হারে না। তবুও তাদের উচিত আমাদের আবেগের মূল্য দেওয়া। ’ এই মন্তব্যের রিপ্লাই দিয়ে আব্দুস সালাম লিখেছেন, ‘আমি আপনার সঙ্গে ১০০% সহমত। বাংলাদেশ হয়তো আমাদের প্রত্যাশামতো খেলতে পারছে না। কিন্তু যা খেলছে, সেটাও তো অস্বাভাবিক নয়।
সর্বোচ্চ আর একটু লড়াই করে হারতে পারত এই যা। ’ বাংলার বাঘ নিক ব্যবহারকারী একজন মন্তব্য করেছেন, ‘কোনো শর্ত ছাড়াই তোমাদের সঙ্গে আছি। সব সময় মানুষের এক রকম যায় না। উত্থান-পতন থাকবেই। ভবিষ্যতের শুভকামনা রইল।
’ ফারুক খান এই মন্তব্যের জবাবে লিখেছেন, ‘উত্থান-পতন থাকবেই। তবে আমাদের শুধুই পতন আর সবার উত্থান, এটাই আর কি। ’
এই কয়েকটি মন্তব্য টানা তুলে নেওয়ার উদ্দেশ্য একটাই—এর মধ্যে বাংলাদেশ দলের কাছে সমর্থকদের প্রত্যাশার চিত্রটা খুব ভালোভাবে ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশ দলের কাছে সমর্থকেরা প্রত্যাশা করেন ভালো খেলা। ধারাবাহিক উন্নতির একটা ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফ।
পরাজয় হলেও সেটি যেন অসহায় আত্মসমর্পণ না হয়। বুক চিতিয়ে লড়াইটার ছাপ যেন থাকে।
কিন্তু কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আর দাঁতে দাঁত চেপে লড়াইয়ের সেই ছাপটা বাংলাদেশ দলের খেলায় দেখা যাচ্ছে না বলেই মনে করেন অনেকে। বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়দের শরীরী ভাষায় কেমন যেন একটা অসহায়ত্ব। কাওসার জামান নামের একজনের মন্তব্য, ‘খেলা দেখতে গিয়েছিলাম মাঠে।
আশা তো ছিল অনেক। তার ওপর যদি প্রতিপক্ষ হয় পাকিস্তান! কিন্তু বাংলাদেশ টিমের অবস্থা যা দেখলাম! নেই কোনো বডি ল্যাংগুয়েজ, আর নেই কোনো চার্ম। মনে হয় ম্যাচ শুরু হওয়ার আগেই তারা হেরে বসে আছে। ’
কিন্তু কেন এই অবস্থা? বাংলাদেশ দল তো সুযোগ-সুবিধা খুব কমও পায় না। খেলোয়াড়দের আর্থিক অবস্থা বা জীবনমান বাংলাদেশের আর যেকোনো পেশার তুলনায় বহুগুণ ভালো।
সমস্যা কি দলের ভেতরে? ঐক্যের সুর কি কেটে গেছে? নাকি একাদশে জায়গার অনিশ্চয়তায় এখন কেউ কেউ নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থটাই বড় করে দেখছেন দলীয় স্বার্থের চেয়ে? সমস্যা কি অধিনায়কত্বে? এই প্রশ্নগুলোও ঘুরেফিরে এসেছে পাঠকদের মন্তব্যে।
কিছু সমঝদার পাঠক তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের আসল সমস্যাটি। গোড়াতেই আছে গলদ। যে দেশের ঘরোয়া ক্রিকেট হয় দায়সারাভাবে, সেই দেশের ক্রিকেটে উন্নতি করাই তো বিস্ময়কর। ঘরোয়া ক্রিকেটকে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করা, নতুন প্রতিভা খুঁজে আনা, সেই প্রতিভার পরিচর্যায় বিসিবির উদ্যোগের কমতি দেখছেন অনেকেই।
আরাফাত আলম নামের একজনের মন্তব্য, ‘আসলে ভাই, কোচ ও প্লেয়ারদের দোষারোপ করার আগে বিসিবির কর্মকর্তাদের দোষ দিতে হবে সবার আগে। ’ পুলক এলাহি মন্তব্য করেছেন, ‘আমার ধারণা, বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের সমস্যাটা মনস্তাত্ত্বিক। ক্রিকেটীয় কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমেই কেবল এ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। ক্রিকেট খেলাটা কেবল ব্যাট আর বলের নয়, মাথারও খেলা। ’
টি চৌধুরী নামের এক পাঠকও বেশ কিছু গঠনমূলক পরামর্শ দিয়েছেন।
দলের জন্য একজন হাইপ্রোফাইল কোচ, ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিংয়ের জন্য আলাদা সহকারী কোচ নিয়োগ দেওয়া। ফিটনেস বাড়ানো। জবাবদিহি চালু করা। মিডিয়ার পেশাদার ভূমিকা। তিন ফরম্যাটের জন্য আলাদা তিন অধিনায়ক।
আরও কিছু পরামর্শ আছে পাঠকদের। ক্রিকেটটাকে ঢাকাকেন্দ্রিক করে না ফেলা। ঢাকার বাইরে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা। বয়সভিত্তিক দলগুলোতেই বেসিকের ওপর জোর দেওয়া। ঘরোয়া ক্রিকেটে মরা উইকেটের বদলে স্পোর্টিং উইকেট বানানো।
কিছু কিছু পাঠকের মন্তব্যে আছে অসাধারণ রসবোধ। স্যাটায়ারও। রুহান চৌধুরী নামের একজন লিখেছেন, ‘লর্ডসে সেঞ্চুরির পর নিজের ছেলের নাম রেখেছিলাম তামিম ইকবাল। এখন সবাই আমার ছেলেকে ভুয়া ভুয়া বলে নাজেহাল করে। কী যে কষ্ট!’ ফাহিম মোহাম্মদ শোয়েব লিখেছেন, ‘সুখবর! সুখবর! সুখবর! বাংলাদেশ ৫০ রানে হেরেছে পাকিস্তানের কাছে, অস্ট্রেলিয়াও ৭৩ রানে হেরেছে ভারতের কাছে, বাংলাদেশ ১০০ রানের নিচে ভারতের কাছে অল আউট হয়েছিল, অস্ট্রেলিয়াও ১০০ রানের মধ্যেই ভারতের কাছে বুকড হলো, অস্ট্রেলিয়া এবারের টি-টোয়েন্টি ওয়ার্ল্ড কাপে ভারত, পাকিস্তান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হেরেছে, বাংলাদেশও এই টুর্নামেন্টে ভারত, পাকিস্তান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছেই হেরেছে, অস্ট্রেলিয়া সুপার টেনে কোনো ম্যাচ জেতেনি, বাংলাদেশও সুপার টেনে কোনো ম্যাচ জেতেনি।
সুতরাং এই মর্মে এটা প্রমাণিত যে বাংলাদেশ আর অস্ট্রেলিয়া সমমানের টিম। ’
সব ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছে মুজাহিদের অতিসাধারণ এই মন্তব্যটাই, ‘মুশফিক, তোমাদের মনে রাখতে হবে, ক্রিকেট আমাদের জন্য এখন শুধু খেলাই নয়, এটা আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। ’
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।