আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নব্য উপনিবেশবাদ ও বাক স্বাধীনতা

স্বাধীনতা, সে তো আমার প্রিয় মানুষের এক সাগর রক্তের বিনিময়ে কেনা ছবিটি তুলেছেন ব্লগার অর্ক মুরাদ । একসময় বিশ্বের বেশিরভাগ দেশগুলি শাসিত হত রাজা বাদশাহ দ্বারা অর্থাৎ যুগ যুগ ধরে একটি পরিবার কোন দেশ শাসন করত আর সেই দেশ একটু দুর্বল হলেই তার পার্শ্ববর্তী বা দুরবর্তী কোন দেশ দ্বারা আক্রান্ত হত এবং মাসের পর মাস সেই দেশে চলত ভয়াবহ লুটপাট । চেঙ্গিস খান কর্তৃক চীন, হালাকু খান কর্তক বাগদাদ, সুলতান মাহমুদ ও নাদির শাহ কর্তৃক ভারত আক্রমন ছিল অন্যতম কিন্তু কালক্রমে সময়ের বিবর্তনে এই ধারনার পরিবর্তন হয়ে হয়েছে উপনিবেশবাদ ( যেমন ভারতীয় উপমহাদেশে দুই শত বছর ব্যাপি ইংরেজ শাসন) আর উপনিবেশবাদ থেকে হয়েছে নব্য উপনিবেশবাদ। নব্য উপনিবেশবাদ মতবাদে কোন পরাশক্তি কোন দেশ সহজেই দখল করে না বা করলেও সরাসরি নিজেরা শাসন না করে সেই দেশে পুতুল সরকার বসিয়ে পরোক্ষভাবে শাসন ও শোষন করতে থাকে । এই নব্য উপনিবেশবাদ মতবাদ অনুসারে বিশ্বের মাত্র হাতে গোনা কয়েটি দেশ স্বাধীন যেমন ইরান, নর্থ কোরিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার কিছু দেশ যেমন কিউবা,ভেনেজুয়েলা ও হালের বলিভিয়া ।

আর এই নব্য উপনিবেশবাদে আমাদের বাংলাদেশও বাইরে নয় যদিও আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি ১৯৭১ সালে কিন্তু শাসকের পরিবর্তনই শুধু হয়েছে শাসন যন্ত্রের কোন পরিবর্তন হইনি। ব্রিটিশরা আমাদের যেভাবে শাসন ও শোষন করে গেছে এবং পাকিস্থানীরাও ঠিক সেই ভাবে আমাদের শাসন ও শোষন করে গেছে আর আমাদের বাঙ্গালী শাসকগণও সেই ব্রিটিশ ও পাকিস্থানীদের অনুসরন করে যাচ্ছে। হাজার হোক উত্তরাধীকারী বলে কথা ! আজকে যখন পত্রিকার পাতায়, ফেসবুকে, খবরের ওয়েব পেজে দেখি এই প্রচন্ড শীতে মানুষের গায়ে দেওয়ার মত একটি বস্ত্রও নেই, তারা ঘুমায় গাছের তলে, প্লাস্টিকের চাদর (!) মাথায় দিয়ে তখন উপরোক্ত কথাগুলি স্মরণ না হয়ে পারে না । তারপরেও কথা থেকে যায়, ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় প্রকাশ ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের অর্থনীতি পশ্চিমা দেশগুলোকেও ছাড়িয়ে যাবে। খুবই আশার কথা এবং দেশপ্রেমিক মাত্রই উৎফুল্ল না হয়ে পারে না কিন্তু পশ্চিমাদের সবকথা বিশ্বাস করতে নেই ।

তারা উদ্দেশ্য ও ষড়যন্ত্রবিহীন কোন কথা বলে না । এটা সর্বজন বিদিত যে বাংলার মাটি হচ্ছে বিশ্বের বুকে সবচেয়ে উর্বর মাটি। ভৌগলিক দিক দিয়েও বাংলাদেশ তথা বাংলা বিশ্বের পরাশক্তিদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ন হয়ে উঠতেছে কারন একদিকে উদীয়মান একক পরাশক্তি চীন আর অন্যদিকে উদীয়মান পরাশক্তি ভারত এর সঙ্গে যুক্ত যুক্তরাস্ট্র । তাই তো কয়েক মাস আগে মার্কিন পররাস্ট্রমান্ত্রী হিলারীর বাংলাদেশ হয়ে কোলকতা টু দিল্লি সফর এই আশংকাই তুলে ধরে। তারপরেও বাংলাদেশের যে প্রবৃদ্ধি এবং বাংলাদেশের যে অগ্রগতি এটাও বা কম কিসের যদিও এই অগ্রগতিতে আমাদের শাসকের অবদান শূন্যের কোঠায়।

প্রবাসী, গার্মেন্টশিল্পের শ্রমিকসহ অন্যন্য ক্ষেত্রের শ্রমিক ও সাধারন জনগণের অবদানই মুখ্য। দু’দল আমাদের শাসন করতেছে পর্যায়ক্রমে কিন্তু তাদের মধ্যে সাপে নেউলে সম্পর্ক আবার এই দু’দলই দেখা যায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদের তোষামোদ করতে সবসময় এক। সেখানে নেই তাদের কোন বিভাজন। এর মূল কারন হল আমাদের গণতন্ত্র জনগণের মঙ্গলের জন্য নয় । এই গণতন্ত্র হল আমাদের রাজনৈতিক নেতা নেত্রীর পর্যায়ক্রমে ক্ষমতা আহরনের গণতন্ত্র।

তারা যতটা না জনগণকে বিশ্বাস করে তারচেয়ে হাজারগুণে বিশ্বাস করে তাদের প্রভূ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদের। সবচেয়ে ধ্রুব সত্য হল আমাদের দেশের মত দেশের রাজনৈতিক নেতাগণ কখনো ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহন করেন না । বেন আলী, মোবারকদের সময় শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে পশ্চিমাবিশ্ব। এমনকি ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফ্রান্সও জায়গা দেয়নি বেন আলীকে। পশ্চিমাবিশ্বের স্বার্থ ফুরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা হত্যা করেছে সাদ্দামকে, গাদ্দাফিকে, হত্যা করেছে মোবারকের ডান হাত ওমর সুলাইম্যানকে।

আমাদের শাসক গোষ্ঠী শিক্ষা নেয়নি ৯০ এর গণঅভ্যূত্থান থেকেও। বাংলাদেশ একটি জাতিরাস্ট্র এবং আমাদের মধ্যে নেই কোন জাতিভেদ এবং নেই কোন ধর্মীয়ভেদ যা আছে আরব বিশ্বে শিয়া, সুন্নি, কুর্দিসহ ও অন্যান্য পর্বতপ্রমান সমস্যা যেমন আছে মালয়শিয়ায়,ভারতে, যুক্তরাস্ট্রে, ব্রিটেনে বিভিন্ন জাতির বসবাস কিন্তু তারপরেও আমরা বিশ্ব থেকে এত পিছিয়ে কেন ? ভিয়েতনাম আমাদের পরে স্বাধীন হওয়ার পরেও আমাদের থেকে তারা আজ অনেক এগিয়ে অর্থনীতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে। হ্যাঁ, বিশ্বের অনেক উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের চেয়ে আমরা অন্তত একটি ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে বাক স্বাধীনতা ও সংবাদ পত্রের স্বাধীনতায় দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া। চীন, ইরান, কিউবা, পাকিস্থান, নর্থ কোরিয়া, ভেনেজুয়েলা এই দেশগুলি আমাদের চেয়ে অনেক অনেক এগিয়ে থাকলেও বাক স্বাধীনতা ও সংবাদ পত্রের স্বাধীনতায় আমরাই শীর্ষে। আমাদের গণতন্ত্রের এটাই সবচেয়ে বড় অর্জন হোক না সেটা তথাকথিত গণতন্ত্র।

আজকের বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতার যুগে কোন রাস্ট্রই আর তার জনগণকে তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার থেকে বঞ্চিত করতে পারবে না সেটা আজ হোক আর কাল হোক। বাক স্বাধীনতা ও সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা অব্যহত থাকলে যেমন জন্ম হয় না ভিন্নমতাবলম্বীর ( Dissident) তেমনি জন্ম নিতে পারে না উগ্রবাদের। সবার এটা মনে রাখা উচিৎ রাস্ট্রযন্ত্র ( রেজিম) ও রাস্ট্র দুটোই আলাদা প্রতিষ্ঠান । রাস্ট্রের সমালোচনা করা অবশ্যই দেশদ্রোহীতা কিন্তু রাস্ট্রযন্ত্রের আলোচনা ও সমালোচনা করা প্রত্যোকটি নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু মানুষের মৌলিক চাহিদা পুরন না হলে কি করবে সে বাক স্বাধীনতা দিয়ে ? যাদের সারাদিনের একবেলা ভাত জোগাড় করতে হিমশীম খেতে হয় যারা শীতের রাতে বস্ত্র ছাড়াই প্লাস্টিকের চাদর দিয়ে রাত্রীযাপন করে তাদের কাছে সংবাদপ্রত্রের স্বাধীনতা আর বাক স্বাধীনতার মূল্য কতটুকু ? কিইবা বুঝে তারা এর অর্থ ? বুজলাম যারা ফেসবুক, পত্রিকায় ও ব্লগে লেখালেখি করেন তাদের তো ব্যাসিক চাহিদার পুরন হওয়ার কারনেই এখন তাদের নজর সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার দিকে কিন্তু আমরা এখন সেটা পুরোমাত্রায় ভোগ করার পরে ক’জন ভাবি দেশের ১৬ কোটি মানুষের যার অধিকাংশেই দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে তাদের নিয়ে ? ভাবলে কি দেশে দেশে নব্য উপনিবেশবাদীরা আমাদের শাসন ও শোষন করতে পারত ? এখানেই নব্য উপনিবেশবাদের মূল ভিত্তি।

বাক স্বাধীনতা এখন একটা অস্ত্রে পরিণত হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদের। ইরাকী জনগণকে তথাকথিত মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়ে তারা ধ্বংসস্তুপে পরিণত করল ইরাককে আবার অন্যদিকে সৌদি ও স্বৈরাচারী রাজা বাদশাহদের প্রতক্ষ্য ও পরোক্ষভাবে সমর্থন করে যাচ্ছে পশ্চিমাবিশ্ব যদিও সেইসব দেশে বাক স্বাধীনতার নূন্যতম লেশমাত্র নেই। উপরের যে দেশগুলির কথা বললাম মানে চীন, ইরান, কিউবা, পাকিস্থান, নর্থ কোরিয়া, ভেনেজুয়েলা তারা আমাদের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও বাক স্বাধীনতায় আমাদের চেয়ে পিছিয়ে কিন্তু সেইসব দেশেও এখন বাক স্বাধীনতা ও সংবাদ পত্রের স্বাধীনতার জন্য থেমে থেমে হলেও আন্দোলন চলছে। হয়তো তারা অচিরেই একদিন সফলকাম হবে এবং সেদিন তারা আমাদের চেয়ে আরো এগিয়ে যাবে কয়েকগুণে বা কয়েকশত গুণে। তাই খাদ্য, বস্ত্র,বাস স্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা যেমন মানুষের মৌলিক অধিকার তেমনি বাক স্বাধীনতাও মানুষের মৌলিক অধিকার অবশ্য মানুষের বাক স্বাধীনতা থাকবে সামাজিক ভাবে মার্জিত গ্রহন যোগ্য ভাষায়।

। এই অধিকারগুলো পুরন না হলে কোনদেশকেই সভ্যদেশ বলা যায় না। বিশ্বের শাসকগণ এটা যত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবে আমাদের জন্য ও তাদের জন্য তত তাড়াতড়ি মঙ্গল বয়ে আনবে।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।