আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

" ঈশ্বরের অস্তিত্ব "

ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রসঙ্গে কিছু কিছু প্রশ্ন বেশ পুরোনো। যেমন ধরুন: "ঈশ্বরকে কে সৃষ্টি করেছে?" অথবা বিখ্যাত আরেকটি প্রশ্ন "ঈশ্বর কি এমন কোনও পাথর সৃষ্টি করতে পারবেন যা তিনি নিজেই তুলতে পারেন না?" আপনি যদি থিওলজিকাল বা ঈশ্বর-তাত্ত্বীক প্রশ্নগুলোতে যথেষ্ট সচেতন না থাকেন তবে এরকম প্রশ্নগুলোতে আপনাকে কেউ কেউ চমকে দিতে পারেন যা আপনার বিশ্বাসকে টলিয়ে না দিলেও, মানসিক ভাবে বিব্রত বা পীড়িত করে তুলতে পারে।
একটা ব্যাপার আমরা অনেকেই বুঝি না যে ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রশ্নটি কেবল মানুষের ঈন্দ্রিয়গ্রাহ্য অস্তিত্বশীলতার একটি সহজ স্বাভাবিক ঔৎসুক্য নয়। এমন নয় যে "আমি তো ঈশ্বরকে দেখতে পাই না, তাহলে কীভাবে বুঝব যে তিনি আছেন!" ব্যাপারটি এত সরল। এভাবে যে চিন্তা করে সে চিন্তার দৌড়ে খুবই পিছিয়ে রয়েছে।

এখনকার অনেক মুসলিমকে (বা আস্তিককে) আমি এই ধরণের স্থূল প্রশ্নের কিছু স্থূল উত্তর তৈরি করতে দেখি। আমরা বুঝি না যে - যে প্রশ্ন করাই হয়েছে বোকার মতো তার উত্তর তৈরি করতে যাওয়াটাও বোকামো।
আমরা অনেকেই খেয়াল করি না যে ঐতিহাসিকভাবে - যে দার্শনিকেরা অস্তিত্বের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছেন তারা কেবল ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়েই সন্দেহপ্রবণ হননি, বরং তারা সবকিছুরই এমনকী নিজেদের অস্তিত্ব নিয়েও বিপাকে পড়েছেন। আমি কী আদৌ একটি অস্তিত্বশীল সত্তা নাকি কেবল একটি সফটওয়্যার প্রোগ্র্যাম তা নিয়ে দার্শনিকদের বহু মুখরোচক এবং বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।
কুরআনের অ্যাপ্রোচ এই বিষয়ে বেশ সোজাসাপটা।

ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহপ্রবণতাকে একটি ভ্যালিড জ্ঞানতাত্ত্বীক প্রশ্ন হিসেবে কুরআন একেবারেই গ্রহণ করেনি। নবীদের মুখ থেকে কুরআনে এসেছে "আফী-ল্লাহি শাক্ক্‌" - "আল্লাহ্‌র ব্যাপারে কী সন্দেহ চলে?" [ইবরাহীম ১০]। আরেক জায়গায় কুরআন মনে করিয়ে দিয়েছে "ধ্বংস হোক মানুষ, কী করে সে অবিশ্বাস করে! কী থেকে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে?" ['আবাসা ১৭]। আল্লাহ্‌ যেন দার্শনিকদের নাজেহাল অবস্থাকেই আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। আল্লাহ্‌র ব্যাপারে সন্দেহপ্রবণকে তার নিজের অস্তিত্বের খোঁজ নিতে বলা হচ্ছে।

কুরআনের ভাষ্যমতে আল্লাহ্‌র অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করা যেন প্রকারান্তরে এক বিরাট বেয়াদবি, সর্বোচ্চ নেমকহারামি।
কুরআনে ঈশ্বর-তাত্ত্বীক যে প্রশ্নগুলোকে যথেষ্ট পাত্তা দেয়া হয়েছে সেগুলো আল্লাহ্‌র অস্তিত্বের প্রশ্ন নয়। বরং অনেক ক্ষেত্রে আল্লাহ্‌র ব্যাপারে ভুল ধারণার অপনোদন। মানুষ আল্লাহ্‌র অস্তিত্ব নিয়ে আদতে সংকটে নেই, তার সমস্যা সে আল্লাহ্‌কে সম্যকরূপে বুঝতে ভুল করছে। যেমনটি কুরআনে বলা হয়েছে "তারা আল্লাহকে প্রকৃতরূপে যাচাই করেনি।

" [আল-হাজ্জ ৭৪] এধরণের প্রশ্নের মাঝে যেটি এক্সটেনসিভলি আলোচনা করা হয়েছে সেটি হোলো শেষ বিচার দিবসের সম্ভাব্যতা। মৃত্যুর পর পুনরূত্থান সম্ভব কীনা এ নিয়ে যুগে যুগে মানুষ সন্দেহ পোষণ করেছে। ব্যাপারটি আল্লাহ্‌র সামর্থ্যের ওপর সন্দেহের কারণে করা। এ নিয়ে কুরআন বিস্তারিত আলোচনা করেছে। কেননা, মানুষ আল্লাহ্‌কে বুঝতে ভুল করে।


আল্লাহ্‌কে কে সৃষ্টি করেছে - এটি কেবল জাঁদরেল দার্শনিকদের প্রশ্ন নয়, মক্কার কুরাইশরাও নবীজীর (সা কাছে এই প্রশ্ন করেছে। ইমাম আত-তাবারী তার তাফসীর গ্রন্থে এই প্রশ্ন উল্লেখ করেছেন কুরাইশদের। আরেকটি প্রায় সমার্থক প্রশ্ন কুরাইশরা করেছিলো যাতে তারা আল্লাহ্‌র বংশপরিচয় জানতে চেয়েছিলো। এই দুটি প্রশ্নের আলোকেই সূরা ইখলাস অবতীর্ণ হয়। সূরাটি যে কেউ খোলা মনে পড়লে বুঝবেন এই প্রশ্নগুলোর এর চেয়ে সংক্ষিপ্ত এবং যথার্থ উত্তর আর হয় না।

অন্তত আমার তাই বিশ্বাস।
আমরা বহু সময় বলি যে আল্লাহ সব পারেন। এরই প্রেক্ষিতে প্রশ্ন এসেছে যে "আল্লাহ্‌ কি এমন কোনও পাথর তৈরি করতে পারবেন যা তিনি নিজেই তুলতে পারেন না। " দোধারী তলোয়ার। যেদিকেই যান দেখা যাচ্ছে আল্লাহ্‌ কিছু একটা পারেন না।

সমস্যা হচ্ছে এটি একটি ফ্যালাসি। আপনি এই ফ্যালাসিকে আরও অবভিয়াস করে তুলতে পারেন এধরণের প্রশ্ন করে: "আল্লাহ্‌ কি পারবেন মৃত্যুবরণ করতে?" এর কোনও জবাব হয়না। কারণ আপনি যদি সিমপ্লিফাই করেন পুরো ব্যাপারটিকে তাহলে এধরণের প্রশ্নের মর্ম হচ্ছে যে "আল্লাহ্‌ কী পারেন - না পারতে?" অথবা "আল্লাহ কী অক্ষম হতে পারেন?" বা আরও পরিষ্কার করে এ প্রশ্নটি করা যায় - "আল্লাহ্‌ কি এমন কিছু পারেন যা তিনি পারেন না?" অ্যাবসার্ড।
সমস্যাটা হচ্ছে এই যে আল্লাহকে আমরা যেভাবে বর্ণনা করি তাতে ত্রুটি থেকে যায়। আল্লাহ্‌ নিজেকে আল-কাদীর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, যার ইমপ্লিকেশান হচ্ছে অ্যাবসোলিউট ক্ষমতা বা শক্তির অধিকারী একজন।

কিন্তু যখনই আমরা ব্যাপারটিকে আমাদের সসীম ঈন্দ্রিয়, জ্ঞান বা অভিজ্ঞতার আলোকে বোঝার চেষ্টা করব তত বেশী ফ্যালাসি তৈরি হবে। "আল্লাহ্‌ সব পারেন" কথাটিও আমরা বুঝি আমাদের জ্ঞানগত অক্ষমতা দিয়ে। এই সীমাবদ্ধতা নিজেই একটা ফ্যালাসি তৈরি করে, এ থেকে উদ্ভুত প্রশ্নগুলোও ফ্যালাসি তৈরি করবে। আমরা আমাদের নিজেদের সীমাবদ্ধতার জালে জড়িয়ে যাব, যাচ্ছি। কেননা আল্লাহকে আমরা যোগ্য রূপে বুঝতে পারিনি বা পারি না।

সেই ক্ষমতাই আমাদের নেই।
এ কারণেই সূরা ইখলাসকে ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করা এবং এর মর্মকে অনুধাবন করা আমাদের জন্য খুবই - খুবই জরুরি। এটা প্রথমত জরুরি আমাদের নিজের ধারণা পরিষ্কার করার জন্য। দ্বিতীয়ত, এধরণের ফ্যালাসির মুখোমুখি হলে আমাদের উত্তর সূরা ইখলাসের ব্যাখ্যাতেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিৎ। এটি ব্যতীত যে কোনও তথাকথিত লজিকাল রেফরেন্স কেবল ফ্যালাসিকে রাবারের মতো টানতেই থাকবে।

কারণ এসব ফ্যালাসির উৎস আমরাই - বা আমাদের সীমাবদ্ধতা। আমাদের সীমাবদ্ধতার সাথে আমাদের সীমাবদ্ধতাকে বিতর্কে জড়িয়ে দিলে কোনও রেসাল্ট আসবে না - কেবল সেই ফ্যালাসিই আসবে ঘুরে ফিরে।

: আসল লিঙ্ক

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।