আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্পবলা গেরিলা

মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়ার সাথে আমার প্রথম দেখা অফিসের লিফটে ! ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোন’ অনুষ্ঠানের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো ঠিকঠাক করতে এসেছেন । রাশভারী, বলিষ্ঠ, দাড়ি-গোঁফে ঢাকা মুখ । ভয়ে ভয়ে সালাম দিয়ে হাত বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্যার, আপনি ভাল আছেন ?’ হাসিমুখে উত্তর দিয়ে মাঝারি উচ্চতার মানুষটা নেমে গেলেন লিফট থেকে । পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিরক্ত মানুষটিকে বললাম, ইনিই বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়া, ‘বিজয়ী হয়ে ফিরব নইল ফিরবই না’, ‘জনযুদ্ধের গনযোদ্ধা’ এই বইগুলো তাঁরই অস্ত্রধরা হাত থেকে বেরিয়েছে ! ‘মুক্তিযুদ্ধের হাজারো গণযোদ্ধার একজন’ এভাবেই নিজেকে তিনি পরিচয় করিয়ে দেন ‘জনযুদ্ধের গনযোদ্ধা’বইয়ের শুরুতে । ইতিহাসে যে যোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দ থাকে একটি মাত্র বাক্য – ‘বাংলাদেশের ছাত্র কৃষক, জনতা, পেশাজীবী, শ্রেণীগোত্র নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন ।

’ এরপর ইতিহাস এর চরিত্র হিসেবে বেছে নেয় ‘অল্প কিছু রাজনৈতিক নেতা, কিছু সামরিক ব্যক্তিত্ব, কিছু বুদ্ধিজীবী’-কে । এই বই (এবং মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়ার প্রায় সব বইই) তাই সেসব উপেক্ষিত, অনাদৃত পার্শ্বচরিত্রের মহানায়ক হয়ে ওঠার দলিল। এই বইয়ের নায়ক চোরাকারবারি তাজুল, মিরাশের মা, বোকা হাবিলদার রমিজ, ‘নষ্টা’ মেয়ে সায়রা, ১৪ বছরের বাচ্চু, ৭২ বছরের অহেদ কেরানি, রাখাইন মেয়ে প্রিনছা ! এই বই বিদেশী বন্ধু ঔডারল্যান্ড, মেঘ সিং এর অসামান্য অবদানের সামান্য স্বীকৃতি । অভিজ্ঞ চোরাকারবারি তাজুল তার ‘পেশাগত’ দক্ষতায় নিপুণতার সাথে সম্পন্ন করে রেকি, যুদ্ধের আকস্মিক পরিস্থিতেও ঘাবড়ায় না, তার এক কথা পরিস্থিতি যাই হোক, ‘যুদ্ধ না করে যুদ্ধ শেষ করবে না’। শান্তিবাহিন চেয়ারম্যান বাবা নিজ হ উপঢৌকন হিসেবে ক্যাম্পে রেখে আসেন সায়রাকে ।

তাঁর দিন কাটতে থাকে পশুদের রাতের খাবার হিসেবে । কিন্তু এই গ্লানিও দমিয়ে রাখতে পারে না সায়রাকে, সুনিপুণ গুপ্তচরের মত ঠিকঠিক খবর বের করে শত্রু অবস্থানের খবর জানিয়ে দিয়ে আসে মুক্তি বাহিনীকে । নিজের সর্বস্ব বিকিয়ে দিয়েও একইভাবে জিতে যায় রাখাইন মেয়ে প্রিনছা ! কোলের ছেলেকে সাথে নিয়েই মুক্তিবাহিনীর সাথে আঠার মত লেগে থাকে মিরাশের মা, তার অবিশ্রান্ত গুলিতে হতাহত পাকসেনাদের রক্তে লাল হয়ে যায় মগরা নদী! এই প্রাণশক্তি, এই প্রেরণার উৎপত্তি কোথায় ? চা বাগানের কুলি হরি । সন্তানসম্ভবা কিশোরী বধূ ছাড়া আর কেউ নেই । তার উপর দায়িত্ব পড়েছে মুক্তিবাহিনীকে পথ দেখিয়ে শত্রুদলের কাছে নিয়ে যাওয়ার ।

রেইডের মাঝেই খবর আসে একটা মৃত সন্তান জন্ম দিয়ে মারা গেছে হরির বউ ! সর্বহারা হরি চোখ মুছতে মুছতে ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তায় পালন করে তার শেষ কর্তব্য, তারপর হারিয়ে যায় ! খর্বাকৃতির জন্য মুক্তিবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দিতে পারেনা মহিউদ্দীন । নাছোড়বান্দা এই যোদ্ধা আড়াআড়ি শুয়ে পড়ে ক্যাপ্টেনের জিপের সামনে, বাহিনীতে ঢোকার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি বাতলে দেয় সে নিজেই, ‘স্যার, হাতে একটা গ্রেনেড দেন, শত্রুর বাঙ্কার দেখায় দেন । যে সাহস করে শত্রুর বাঙ্কার ধ্বংস করে ফিরে আসতে পারবে তাকেই ভর্তি করে নেন’ ! নির্বোধ? না তো কি? এই পরীক্ষার অবধারিত ফলালফল তো মৃত্যু ! বাধ্য হয়েই বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এই কিশোরকে । ১৪ই ডিসেম্বর ভোরে সব পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে পাস করে চিরদিনের জন্য ময়দান ত্যাগ করে এই যোদ্ধা ! Job accomplished! এই অসাধারণভাবে সাধারণ মানুষগুলো কিন্তু একেবারে অদৃশ্য নন । যুদ্ধের নাটকের শুরুতে তাদের নাম থাকে – ‘যুবক ১’, ‘যুবক ২’; সিনেমার credit line -এও ‘গ্রামবাসী’ বলে তাদের প্রাপ্য পাওনা তাদের বুঝিয়ে দেয়া হয় ।

তারপরও বারবার এই ‘তুচ্ছ’ ‘তুচ্ছ’গল্পগুলো আমাদের শোনান ২নং সেক্টরের যোদ্ধা কামরুল, ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের ইন্টার-পরীক্ষার্থী । তাঁকে দেখেই বুঝতে পারি তাঁর জীবনটা আটকে গেছে ওই ‘নয় মাসে’ । হাতে ধরে রাখা কলমটা মাঝে মাঝে খুব জোরে চেপে ধরেন, বুলেট বের হয় না যদিও ওটা থেকে ! তাঁর সহযোদ্ধা চোরাকারবারি তাজুল তার ‘পেশার’ প্রতি নিষ্ঠাবান থেকেছে শেষ পর্যন্ত – দেখেই বোঝা যায় খুব একটা ভাল নেই, মিরাশের-মা স্বামী, সন্তান সব হারিয়ে এখন মরমী ফকির, গ্রামছাড়া সায়রার নষ্ট হবার মত যৌবন ফুরিয়ে গেছে কবেই ! স্বীকৃতি পায়নি কিছুই, তবু মরে গিয়ে বেঁচে গেছে অহেদ কেরানি । যুদ্ধের প্রতিটি রাত ভাত বেড়ে বসে থাকতো যে গ্রাম্যবধূ তার অপেক্ষার পালা শেষ হল কিনা তা অবশ্য জানা নেই এই বইয়ের লেখকের ! যুদ্ধের পুরনো সত্য – ‘স্বাধীন দেশ জীবিত গেরিলা চায় না’ এটা জেনে গেছেন আজন্ম যোদ্ধা কামরুল ! তাঁর সামনে বসে থাকা যুবকের জ্বলজ্বলে চোখ তাঁকে স্পর্শ করে কি করেনা, কথা বলতে বলতে তিনি তখন চলে গেছেন মুকুন্দপুর, প্রিয় রণাঙ্গনে ! তবুও না চাইলেও তাঁকে আবার ফিরে আসতে হয় এই নষ্ট সময়ে । সহযোদ্ধা তৈয়ব আলীকে যে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তাঁকে যে বেঁচে থাকতেই হবে এই গল্পগুলো বলে যাবার জন্যে ! by Sheikh Nasir Uddin বইয়ের নামঃ ‘জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা’ লেখকঃ মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়া প্রকাশকঃ Centre for Bangladesh Liberation War Studies Click This Link ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.