আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অকুতোভয়, দেশপ্রেমিক বংগমাতার সুর্য সন্তান ---মেজর জলিল।বাংলাদেশের প্রথম রাজবন্ধী।

এই অকুতোভয়, দেশপ্রেমিক মানুষটির জীবন সম্পর্কে জানার কৌতূহল থাকাই স্বাভাবিক। ১৯৪২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বরিশাল জেলার উজিরপুরে মামার বাড়িতে মেজর জলিলের জন্ম। জন্মের তিন মাস আগেই পিতা মারা যান। জন্ম নেন এতিম হয়ে। জন্মের পর থেকেই তিনি জীবনের কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হন।

মায়ের স্নেহ-ভালোবাসাই ছিল তার জীবনে চলার পথের একমাত্র পাথেয়। ১৯৬০ সালে উজিরপুর ডব্লিউবি ইনস্টিটিউশন থেকে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক পাস করেন। স্কুলজীবনেই ‘পথের কাঙাল’ ও ‘রীতি’ নামে দু’টি উপন্যাস লেখেন। দুর্ভাগ্যজনক হলো, পরে পাণ্ডলিপি দু’টি হারিয়ে যায়। ১৯৬১ সালে জলিল ইয়াং ক্যাডেটে ভর্তি হন।

পাকিস্তানের মারিতে তিনি শিক্ষাগ্রহণ করেন। ১৯৬৩ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে কাকুলে সামরিক অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণ নেন। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি কমিশন লাভ করে সেনাবাহিনীতে অফিসার হিসেবে যোগ দেন। ওই ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে ১২ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার হিসেবে অংশ নেন। ১৯৬৬ সালে মেজর জলিল পাকিস্তান সামরিক অ্যাকাডেমি থেকে গ্র্যাজুয়েশন লাভ করেন।

পরে তিনি মুলতান থেকে ইতিহাসে এমএ ডিগ্রি নেন। পড়াশোনার প্রতি তার একটা বিশেষ আকর্ষণ ছিল। অসুস্থ মাকে দেখতে এক মাসের ছুটি নিয়ে ১৯৭১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি তিনি বাড়ি আসেন। ওই সময় জাতীয় রাজনীতিতে চলছিল কালো মেঘের আনাগোনা। ছুটির মেয়াদ শেষ হলে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে যাননি।

সচেতন এই মানুষটি রাজনীতির শেষ অবস্থা দেখার অপেক্ষায় থাকেন। ২৫ মার্চের কালরাতে ইতিহাসের চেহারা পাল্টে যায়। ২৬ মার্চই মেজর জলিল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত বরিশাল ও পটুয়াখালীকে মুক্ত অঞ্চল রাখতে সক্ষম হন। শুরু হলো মুক্তিযোদ্ধা জলিলের জীবন।

৭ এপ্রিল মেজর জলিল খুলনা রেডিও সেন্টার মুক্ত করতে অপারেশন চালিয়েছিলেন। ২১ এপ্রিল অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সুন্দরবনের পথ ধরে ভারতে যান। ফিরে এসে ৯ নম্বর সেক্টরের প্রধান হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়। ১৮ ডিসেম্বর বরিশালে মেজর জলিলকে সংবর্ধনা দেয়া হয়।

২১ ডিসেম্বর বরিশাল হেমায়েত উদ্দিন খেলার মাঠে এক বিশাল জনসভায় তিনি ভাষণ দেন। ওই দু’টি জনসভায় এত বেশি স্বতঃস্ফূর্ত জনতা উপস্থিত হয়েছিল, যা বরিশালবাসী আগে আর কখনো দেখেননি। স্বাধীনতার পরপর ভারত বাংলাদেশকে কার্যত একটি প্রদেশ হিসেবে আচরণ করার প্রয়াস পায়। ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশের সম্পদ ও পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্র লুট করে ভারতে নিয়ে যেতে থাকে। যশোরে লুটের মাল বয়ে নেয়া ভারতীয় সেনাবাহিনীর গাড়িবহরকে বাধা দেয়ায় ৩১ ডিসেম্বর বেলা ১১টায় মেজর জলিলকে বন্দী করা হয়।

যশোর সেনানিবাস অফিস কোয়ার্টারের একটি নির্জন বাড়িতে তাকে আটকে রাখা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজবন্দী। পাঁচ মাস ছয় দিন বন্দী থাকার পর ১৯৭২ সালের ৭ জুলাই মেজর জলিল মুক্তি লাভ করেন। সেক্টর কমান্ডারসহ কৃতী মুক্তিযোদ্ধার অনেককে নানা সম্মানসূচক উপাধি দেয়া হলেও তাকে বঞ্চিত করা হয়। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় আধিপত্যবাদী আগ্রাসন, যুদ্ধ-পরবর্তী লুণ্ঠন এবং তৎকালীন মুজিব সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধাচরণই ছিল প্রধান কারণ।

’৭২-এর ৩১ অক্টোবর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে তিনি রাজনীতিতে নামেন। ঘটনাটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ও আলোচিত ঘটনা। পরবর্তীকালে তিনি এই দেশের রাজনীতির পটপরিবর্তনে প্রভাবশালী ভূমিকা রাখেন। ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরিশালের বাকেরগঞ্জ, উজিরপুরসহ পাঁচটি আসনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচনে তার বিজয় ছিল নিশ্চিত।

কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাকে বিজয়ী হতে দেয়নি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত এই দলের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছিল মেজর জলিলের নেতৃত্বাধীন জাসদ। ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও কর্মসূচিতে পুলিশ গুলি করলে জাসদের বহু নেতাকর্মী হতাহত হন। মেজর জলিল নিজেও আহত হন। আওয়ামী লীগ সরকার তাকে গ্রেফতার করে।

১৯৭৫ সালের ৮ নভেম্বর তিনি মুক্তি লাভ করেন। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন সত্ত্বেও মেজর জলিল রেহাই পাননি। ১৯৭৫ সালের ২৩ নভেম্বর তাকে আবার গ্রেফতার করা হয়। সামরিক ট্রাইব্যুনালে কর্নেল তাহের ও মেজর জলিলের ফাঁসি হয়। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য মেজর জলিলের মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়।

তখন প্রায় সাড়ে চার বছর কারাভোগের পর ১৯৮০ সালের ২৬ মার্চ তিনি মুক্তি লাভ করেন। ১৯৮২ সালের আগস্ট মাসে তিনি টাঙ্গাইলের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের কন্যা সায়মা আকতারকে বিয়ে করেন। তাঁদের দুই কন্যা সারাহ জলিল ও ফারাহ জলিল। ক্রমান্বয়ে মেজর জলিলের চিন্তাচেতনায় পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। ১৯৮৪ সালের ৩ নভেম্বর তিনি জাসদ থেকে পদত্যাগ করেন।

এ প্রসঙ্গে তিনি ‘কৈফিয়ত ও কিছু কথা’ নামক একটি গ্রন্থে লিখেছেন। মেজর জলিল এমন কিছু গ্রন্থ লিখে গেছেন যা আমাদের জাতীয় জীবনের যেকোনো সন্ধিক্ষণে দিকনির্দেশনার কাজ করবে। তার একটি গ্রন্থ ‘অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা’ দেশপ্রেমের এক বলিষ্ঠ এবং উচ্চকিত স্লোগানে রূপান্তরিত হয়েছে। মেজর জলিলের লেখা আটটি গ্রন্থ হলোÑ ১. সীমাহীন সমর (মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ডায়েরি); ২. মার্কসবাদ (প্রবন্ধ); ৩. সূর্যোদয় (রাজনৈতিক উপন্যাস); ৪. কৈফিয়ত ও কিছু কথা (প্রবন্ধ); ৫. দাবি আন্দোলন দায়িত্ব (প্রবন্ধ); ৬. দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবন দর্শন (প্রবন্ধ); ৭. অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা (প্রবন্ধ) এবং ৮. A Search for Identity (Essays)। জাসদ থেকে পদত্যাগের পর মাত্র ১৬ দিন পর মেজর জলিল ১৯৮৪ সালের ২০ অক্টোবর ‘জাতীয় মুক্তি আন্দোলন’ নামে একটি দল গঠন করেন।

এ সময় তিনি মরহুম হাফেজ্জী হুজুরের নেতৃত্বে ‘সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনে সক্রিয় অংশ নেন। ১৯৮৫ সালে জানুয়ারি মাসে তাকে গৃহবন্দী করা হয়। তিনি এক মাস এ অবস্থায় থাকেন। স্বৈরাচারী এরশাদবিরোধী আন্দোলনে যোগদানের কারণে ১৯৮৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে ১৯৮৮ -এর মার্চ পর্যন্ত সরকার তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটকে রাখে। এর আগে তিনি লিবিয়া, লেবানন, ইরান, ব্রিটেন ও পাকিস্তানে কয়েকটি আন্তর্জাতিক ইসলামি সম্মেলনে যোগ দেন।

১৯৮৯ সালের ১১ নভেম্বর মেজর জলিল পাকিস্তান যান। ১৬ নভেম্বর রাজধানী ইসলামাবাদে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। সাথে সাথে তাকে কিনিকে ভর্তি করা হয়। ১৯ নভেম্বর রাত সাড়ে ১০টায় তিনি ইন্তেকাল করেন। ২২ নভেম্বর তার লাশ ঢাকায় আনা হয় এবং পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়।

উল্লেখ্য, মেজর (অব জলিলই সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি যার লাশ দাফনের মাধ্যমেই মিরপুরের বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন শুরু হয়েছে। মৃত্যুর সময় মেজর (অব এম এ জলিল মাতা, স্ত্রী ও দুই কন্যাসন্তান রেখে গেছেন। মেজর এম এ জলিল দেশের একজন সাহসী সন্তানের নাম। তিনি ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক যোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধ তাকে করেছিল লড়াকু এক সৈনিক।

দীর্ঘ এক যুগ জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের জন্য কাজ করেছেন তিনি। আমৃত্যু সংগ্রামী জীবন তাকে করেছিল প্রতিবাদী, জালিম-শোষক ও লুটেরা শাসনের বিরুদ্ধে আপসহীন। বিপ্লবী চিন্তার পরিবর্তন ও ইসলামের চেতনায় উজ্জীবন তার মধ্যে পূর্ণতা এনেছিল। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।