আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইতিহাসখ্যাত শহরে জোর লড়াইয়ের আভাস

মিরাটের পরিচয় অনেক। পৌরাণিক পরিচয় যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে আধুনিক পরিচয়। রাবণের স্ত্রী মন্দোদরীর বাবা মায়াসুরের মায়ারাজ্যের রাজধানী ছিল এই তল্লাট। তখন অবশ্য নাম ভিন্ন ছিল। সিন্ধু সভ্যতার পূর্ব প্রান্তের বিস্তারও ঘটেছিল এই মিরাট পর্যন্ত।

শহরের আধুনিক পরিচয়টা শুরু ইংরেজদের আমলে। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের সূত্রপাত এখানেই। কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন, সেটাই ছিল ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামের সূচনা। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্যান্টনমেন্টও এই মিরাটে। দিল্লিতে শুনেছিলাম, সেই মিরাটকে ইদানীং কংগ্রেসিরা নাকি বেশ চনমনে করে তুলেছে।


মিরাটে কংগ্রেসের মরা গাঙে বান যদি ডেকেই থাকে, কী তার কারণ? খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, একমাত্র কারণ হলেন নাগমা। দক্ষিণ ভারতীয় এই সুন্দরীর কোন কোন সিনেমা হিট হয়েছে মনে করা কঠিন হলেও সবার প্রিয় ‘প্রিন্স অব ক্যালকাটা’ সৌরভের সঙ্গে যে একটা সময় তাঁর নাম জড়িয়ে গিয়েছিল, সে কথা কেউ ভোলেনি। ভোটে দাঁড়ানোর আগে সম্ভবত সেটাই ছিল তাঁর সেরা পরিচিতি। চল্লিশের আশপাশে বয়স হলেও এখনো সুশ্রী নাগমা। তাঁর আকর্ষণ এতটাই যে নাগমা মিরাটে আসা ইস্তক পুলিশকে বারতিনেক হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে।

কেন? কারণ, নাগমাকে দেখতে এতই হুটোপুটি যে শালীনতার মাত্রাজ্ঞানও কেউ কেউ হারিয়ে ফেলেছে। এদের মধ্যে স্থানীয় কংগ্রেসের কর্তাব্যক্তিরাও যে নেই তা নয়। একদিন তো বিরক্ত নাগমা দলীয় নেতার স্নেহের পরশ থেকে নিজেকে বাঁচাতে গণসংযোগ কর্মসূচি শিকেয় তুলে গাড়িতে উঠে পিঠটান পর্যন্ত দিয়েছিলেন। আগে তো সম্ভ্রম রক্ষা হোক, তারপর বাকি সব।
শহরে ঢুকলে প্রথমেই নজর কাড়ে নাগমার ছবি ও কংগ্রেস প্রতীক আঁকা গোটাকয় বিশাল বেলুন।

চৈত্রের হাওয়ায় আকাশে হেলেদুলে ভাসছে। নাগমার হাসিমুখের মোহিনী ছবি দিয়ে মোড়া সাইকেল ভ্যান শহরের এ-মুড়ো থেকে ও-মুড়ো ধীর লয়ে যাওয়া-আসা করছে। ভ্যান থেকে ভেসে আসছে নাগমার নামে ভোট-প্রার্থনার আরজি। কখন কোথায় নাগমার সভা, কিংবা পদযাত্রা, তার আগাম হদিসও দিচ্ছে ওই ভ্যান। একটু-আধটু ঘোষণা, তার সঙ্গে গান, বেশ একঘেয়ে ব্যাপার।


কংগ্রেস তা হলে এখানে বেশ ভালোমতো লড়াইয়ে আছে ভাবতে ভাবতে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় নাগমার নির্বাচনী অফিসে গিয়ে প্রথম ধাক্কা। চারদিকে উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা দু-আড়াই বিঘা জমি। তার একপাশে বাঁশ, কাপড়, ত্রিপল দিয়ে দুই হাজার ফুটের অস্থায়ী আস্তানা। তার মধ্যে বনবন করে ফ্যান ঘুরছে। কয়েকটা চেয়ারে পাঁচজন নেতাস্থানীয় মানুষ গুলতানি করছেন।

দেখে বোঝার উপায় নেই, আর কদিন পরেই ভোট এবং এই বিরাট জায়গাটা গুরুত্বপূর্ণ একজন প্রার্থীর কার্যালয়। বরং মনে হলো, বিয়ের অনুষ্ঠান চুকে যাওয়ার পর বর-কনে চলে গেলে দিন দুয়েক পরে বিয়েবাড়ি যেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে, অনেকটা তেমন। পাঁচজনের একজন কংগ্রেসের ছাত্রসংগঠন এনএসইউআইয়ের উত্তর প্রদেশ রাজ্য সভাপতি অবনীশ কাজলা। রাজ্যের জাতপাতের বিন্যাস ও এর প্রভাব সম্পর্কে তাঁর যে বেশ জ্ঞান রয়েছে, ঝকঝকে অবনীশের সঙ্গে কথা বললেই তা মালুম হয়। তাঁর পাশে বসা গিরীশ শর্মা, অজয়পাল রাস্তোগি কিংবা হ্যারি, কেউই এ কথা মানতে রাজি হলেন না যে তাঁদের মূল লড়াইটা প্রধানত বিজেপির সঙ্গে।

চারজনই নানাভাবে বোঝালেন, কংগ্রেস প্লাস রাষ্ট্রীয় লোক দল প্লাস নাগমার ব্যক্তিগত ক্যারিশমা কংগ্রেসকে এই আসনটা হাসতে হাসতে তুলে দেবে। কংগ্রেসকে এবার মানুষ কেন ভোট দেবে, অবধারিত সেই প্রশ্নটা করায় চারজনই বললেন, ‘কেন ভোট দেবে? মোদি! মোদিকে ঠেকাতে! এটাই তো কেউ বুঝতে চাইছে না। ’
অবনীশ ও অন্যরা এভাবে বোঝালেন, ‘কংগ্রেসের নিজস্ব একটা ভোটব্যাংক আছে। এবার অজিত সিংয়ের রাষ্ট্রীয় লোক দলের সঙ্গে জোট করায় তাদের ভোটও যোগ হচ্ছে। এই কদিন আগে রাজ্যের জাঠদের অনগ্রসর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সরকারি সিদ্ধান্ত বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে।

তার ওপর নাগমাকে নিয়ে যে হুল্লোড় চলছে, তাতেও বেশ কিছু ভোট কংগ্রেসের ভাগে আসবে। ’
তা না হয় বোঝা গেল। কিন্তু এই যুক্তি মানলে এটাও মেনে নিতে হবে, নরেন্দ্র মোদি মিরাটে কোনো ফ্যাক্টরই নন। প্রশ্নটা শেষ হয়েছে কি হয়নি, অবনীশরা বলে উঠলেন, ‘ননই তো! উত্তর প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলে জাঠেরা যদি কংগ্রেস ও রাষ্ট্রীয় জনতা দলের জোটের সঙ্গে ঠিকমতো লেপ্টে থাকে, তা হলে মোদির নামে বাড়তি ভোট জুটবে কোথায়? তার ওপর মুসলমান ভোট তিন ভাগ হবে। কারও মৌরসি পাট্টা খাটবে না।


‘তিন ভাগ? মানে, সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজ পার্টি ও কংগ্রেস?’ অবনীশরা বিস্মিত না হয়ে বললেন, ‘মুসলমানদেরই জিজ্ঞেস করুন না। সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। ’
মিরাট ঐতিহাসিকভাবেই দাঙ্গার শহর বলে পরিচিত। ১৯৮২, ৮৪, ৮৭, ৯০, ৯২—দাঙ্গা না হওয়া বছরের হিসাব পাওয়াই প্রায় মুশকিল। পাশের জেলা মুজাফফরনগরে দাঙ্গার ঢেউও মিরাটের তীরে ঝাপটা মেরেছিল।

আর দাঙ্গা হলেই স্থানীয় প্রশাসন যে যে এলাকার ওপর বাড়তি নজর দেয়, কেসরগঞ্জ তাদের অন্যতম। শহরের অন্যতম ঘিঞ্জি এলাকা। সমাজবাদী পার্টির প্রার্থী শহিদ মনজুর অ্যাডভোকেটের নির্বাচনী অফিস এই কেসরগঞ্জেই। সেখানে এসেই কেন যেন কংগ্রেসের ‘নাগমা-জৌলুশ’ আরোপিত ও ফিকে মনে হলো। বুড়ো-বাচ্চায় জায়গাটা গমগম করছে।

সর্বত্র একটা ব্যস্ততার ছবি। সেই ব্যস্ততায় আস্থার ছাপ। শহিদ মনজুর নামের পাশে অ্যাডভোকেট লিখতে পছন্দ করেন। তিনি যে লেখাপড়া জানা একজন কেতাদুরস্ত মানুষ, নামেই তাঁর পরিচয় রাখাটা জরুরি মনে করেন। ফজলপুরে জনসভা করে কেসরগঞ্জ ফিরতে রাত হবে জানিয়ে অফিস ম্যানেজারকে ‘চা-পানির’ বন্দোবস্ত করতে বলে মমতাজ মোহাম্মদ চেয়ার টেনে মুখোমুখি বসলেন।

তিনিই পার্টির স্থানীয় নেতা।
আলোচনাটা শুরুই হলো মুজাফফরনগরের দাঙ্গা নিয়ে। প্রথম বলটাই বাউন্সার এবং তা গায়ে লাগল মমতাজের। তবু সামলে নিয়ে বললেন, ‘এটা ঠিক যে মুজাফফরনগরের দাঙ্গা অখিলেশ প্রশাসন ঠিকঠাক সামলাতে পারেনি। মুসলমানদের জান-মান-সম্পত্তিরও খুব ক্ষতি হয়েছে।

কিন্তু এটাও ঠিক যে আশ্রয় শিবিরগুলো সরকার ঠিকমতো সামলেছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের আর্থিক সাহায্য দিয়েছে। ’ একটু আমতা আমতা করে মমতাজ এর পর যা বললেন, তার মোদ্দা কথা হলো, ‘সরকারটা তো আমাদেরই। ভুল একটু করেছে ঠিকই। কিন্তু তাই বলে নিজেদের সরকারকে ফেলে দেব? না।

মুসলমানেরা মুলায়ম সিংকে ছাড়তে পারবে না। ’
মুলায়ম সিং যাদবের সমাজবাদী পার্টিকে এসব অঞ্চলের লোকজন ‘সাইকেল পার্টি’ বলে ডাকে। গালভরা পোশাকি নামটা উচ্চারিতই প্রায় হয় না।
শহিদ মনজুরের নির্বাচনী অফিসের খানকয়েক দোকানের পরেই খলিল আহমেদের আস্তানা। আস্তানা বলতে মাছ ধরার নাইলনের জাল বোনা-সারাইয়ের দোকান।

কাঠের চৌকির ওপর বসে খলিল আহমেদ। তাঁকে ঘিরে তরুণদের জটলা। মমতাজ মোহাম্মদ ও সাইকেল পার্টির অন্যদের কথা পাড়তে খলিল আহমেদ ফোকলা দাঁত বের করে খানিক তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন। মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘এই পাড়ায় প্রায় সবাই এতকাল সাইকেলে ভোট দিয়ে এসেছে। এবার কিন্তু সবাই দেবে না।

আমরা এবার বহেনজির হাতিতে মোহর লাগাব। ’
বহেনজি অর্থাৎ কিনা মায়াবতীর দল বহুজন সমাজ পার্টির প্রতীক হাতি। এখানে হাতির প্রার্থী শহীদ আখলাক। গরু-মোষের মাংসের বড় এক্সপোর্টার। বছরে কোটি কোটি টাকার কারবারি হলেও গরিবদের জন্য তাঁর দরজা নাকি চব্বিশ ঘণ্টা হাট করে খোলা।

খলিল আহমেদ বললেন, ‘মুলায়ম ধরেই নিয়েছেন, তিনি যা খুশি তাই করলেও মুসলমান কিছু বলবে না। কিন্তু আমরা তো তাঁর কেনা গোলাম নই! তা ছাড়া বহেনজিও মুসলমানের জন্য কম করেননি। সবচেয়ে বড় কথা, একটাবারের জন্যও দাঙ্গা হতে দেননি। আমাদের জন্য বহেনজির হামদর্দ মোটেই কম নয়। ’ খলিল আহমেদের কথা শেষ হতে না দিয়েই দোকানঘর ঘিরে থাকা লোকজন বলে উঠল, ‘ইস বার হাতি।


গতবার মিরাট আসন যিনি জিতেছিলেন, সেই রাজেন্দ্র আগরওয়াল এবারেও বিজেপির প্রার্থী। তাঁর কার্যালয়ে কারও নিঃশ্বাস ফেলার ফুরসত নেই যেন। আসনের বিভিন্ন এলাকা থেকে অনবরত ফোন আসছে—এটা চাই ওটা চাই, এটা পাঠান ওটা পাঠান। অফিস সামলাচ্ছেন পবন মিত্তল। সংক্ষেপে সবাই তাঁকে ‘পি এম’ বলে ডাকে।

তাঁকে ঘিরে বসে যাঁরা সমর্থক-কর্মীদের নানা ধরনের আবদার সামলাচ্ছেন, তাঁদের একজন জনার্দন শর্মা বললেন, ‘আর কটা দিন মাত্র। তারপর আর পবনজিকে আমরা পি এম ডাকব না। পি এম তো তত দিনে একজনই। নরেন্দ্র মোদি। ’
কথাটা শুনে পবন মিত্তলও হেসে উঠলেন।

বললেন, ‘১৬ এপ্রিল আমরা দুটো জিনিস জানব। এক, বিজেপি সারা দেশে মোট কত আসন পেল; দুই, মিরাটে আমাদের মার্জিনটা কত হলো। ’ কথাটা বলে দলের একটা প্যাড টেনে কলম খুলতে খুলতে ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাজি ধরবেন? ধরলে কথাটা লিখে দিতে পারি। ’

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.