বিশ্বের সর্ব বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতের লোকসভা নির্বাচন শুরু হয়েছে গত ৭ই এপ্রিল থেকে । নয় দফায় অনুষ্ঠিত হবে এ নির্বাচন । চলবে আগামী ১২ই মে পর্যন্ত । নির্বাচনের প্রথম দিনে আসামের ৫টি এবং ত্রিপুরার তটি লোকসভায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে । ৫৪৩ আসনের লোকসভা নির্বাচনে একদিকে লড়ছে রাজীব গান্ধী ও সোনিয়া গান্ধী তনয় রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস এবং ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপীর) নেতৃত্ব দিচ্ছেন নরেন্দ্র মোদী ।
বিভিন্ন ইস্যুতে গত দুই আসরে ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে কংগ্রেসের ব্যর্থতায় বিগত দিনের রাজ্যসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের করুন দশা বলে দেয় ভারতে ক্ষমতার পরিবর্তন নিশ্চিত । ভারতে আগামীর ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদীর নাম অনেকেই জঁপতে শুরু করেছেন । ভারতে উগ্র হিন্দু জাতীয়তা বাদীদের কাছে নরেন্দ্র মোদী কংগ্রেসের তরুন রাহুল গান্ধীর চেয়ে অনেকটা জনপ্রিয় । এর পিছনে সুসংহত কয়েকটি কারনও আছে । অনেকগুলো কারনের মধ্যে সবচেয়ে বড় কারনটি হল উগ্র হিন্দুত্ব জাতীয়তাবাদের চেতনা ।
ভারতের ৮০ কোটি ভোটারের মধ্যে প্রায় ৬০ কোটি ভোটার হিন্দু । মুসলমান ভোটারের সংখ্যা ১৮ কোটি ছুঁই ছুঁই । ভারতের হিন্দুরা সাম্প্রদায়িক নীতিতে কট্টর । তারা চিরাচরিতভাবে মুসলমানদেরকে ভাল চোখে দেখে না । বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদীর উস্কানীতে এবং গান্ধী পরিবারের সন্তান হয়েও বিজেপীর সাধারণ সম্পাদক বরুন গান্ধীর (যিনি ইন্দিরা গান্ধীর নাতি এবং রাহুল গান্ধীর আপন চাচাত ভাই) মুসলিম বিরোধী ব্যক্তব্যে ২০০২ সালে গুজরাটে হিন্দু মুসলিমদের মধ্যে দাঙ্গা বাধিঁয়েছিল ।
যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা সংখ্যালগু মুসলমানদেরকে ব্যাপক হারে হত্যা করেছিল, আগুনে পুড়িয়ে মেরে ছিল এবং মুসলিম মা, বোনাদের প্রকাশ্যে ধর্ষণ করেছিল । ভারতের হিন্দুরা আবারও সে দৃশ্যের অবতারণা করার জন্য নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে ।
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী দেশ হওয়ায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে ভারত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনকে বেশি প্রভাবিত করে । ভারতের চলমান লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারক হবে বলে অনেকে মনে করছেন । অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে ভারতীয় কংগ্রেস পার্টি বাংলাদেশের ক্ষমতাশীন আওয়ামীলীগের সবচেয়ে কাছের বন্ধুর সম্পর্কে আছে ।
যা মাঝে মধ্যে ভারতীয় এবং বাংলাদেশী পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে জানানো হয় । বিএনপি দাবী গত ৫ই জানুয়ারীতে এক প্রহসনমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের সিংহভাগ জনসাধারণের জনমতকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগকে পুনরায় ক্ষমতায় বসানোর কলকাঠি নেড়েছে ভারতীয় কংগ্রেস পার্টি । বিএনপি জন্মলগ্ন এবং জাতীয়বাদী হিসেবে ভারত বিরোধী । যা বিএনপির সভানেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বা বিএনপির অন্যান্য নেতাদের বক্তব্যে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ পেয়েছে । তার কারনেই ভারতীয়া বাংলাদেশের ক্ষমতার আসনে বিএনপি ছাড়া অন্য কাউকে দেখতে চায় ।
কাজেই আওয়ামীলীগ ছাড়া বিকল্প নাই । তবুও রাজনৈতিক স্বার্থে বিএনপি ভারতের লোকসভা নির্বাচনের দিকে নিষ্পলক দৃষিতে তাকিয়ে আছে । বিএনপির জাতীয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করে হলেও দেশে রাজনৈতিক স্থিরতা আনয়নের জন্য কায়মনোবাক্যে তারা বিশেষ একটি দলের জয়ের খবরের জন্য অধীর আগ্রহে প্রহর গুনছে । শুধু বিএনপি নয় বাংলাদেশে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতেই ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল বাংলাদেশের পরবর্তী রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণের টনিক হিসেবে কাজ করবে ।
ভারত যেমন কঠোর হিন্দু জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী বাংলাদেশ ততোটা কট্টর মুসলিম জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী না হলেও সংখ্যাধিক্যের কারনে মুসলিম জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ।
ভারতের নির্বাচনে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ বিবেচনায় বাংলাদেশীদের কাছেও এ নির্বাচন ব্যাপক গুরুত্ব পাচ্ছে । লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দিনে বিজেপী ঘোষিত ‘নির্বাচনী ইশতেহারে’ বাংলাদেশের মানুষ দো’টানায় পড়ে গেছে । মোগল সম্রাট কৃর্তৃক নির্মিত অযোধ্যার ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদটিকে ভারতের হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো জোটবদ্ধ হয়ে পরিকল্পনা করে ১৯৯২সালের ৬ই ডিসেম্বর ভেঙ্গে ফেলে । তৎকালীন সময়ের বিজেপী সমর্থিত প্রধানমন্ত্রী নরসিমহা রাও ও বিজেপি নেতা কল্যান সিংহ এ পরিকল্পনার কথা জানতেন । তারা এর কোন প্রতিবাদ করেন নি ।
ভারতীয় হিন্দুরা বিশ্বাস করে, “যে জায়গাটিতে মোগল সম্রাটরা বাবরী মসজিদ নির্মান করেছিল সে স্থানে হিন্দুদের আরাধ্য ভগবান রামচন্দ্রের জন্মস্থান । সেই মন্দির ভেঙ্গেই মসজিদ নির্মান করা হয়েছিল” । বাবরী মসজিদ ভাঙ্গাপরবর্তী দাঙ্গায় সমগ্র ভারতজুড়ে পায় ২ হাজার মানুষ প্রাণ হারায় । ’৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার প্রভাব বাংলাদেশেও কম পড়েনি । বাবরী মসজিদ ভাঙ্গাকে নিয়ে হিন্দু মুসলিমদের মধ্যে রায়ট লেগেছিল ।
যাতে বেশ কয়েকজন নিহত হয় এবং আহত হয় সহস্রাধিক । সম্পত্তি যে কি পরিমান ধ্বংস করা হয়েছিল তার কোন হিসাব নাই । দীর্ঘ দিন ধরে ভারতের আদালতে বাবরী মসজিদ নিয়ে মামলা চলেছিল । অবশেষে মামলার রায়ে বাবরী মসজিদের একপাশে রাম মন্দির এবং অন্যপাশে মসজিদ থাকবে বলে সিদ্ধান্ত দেয়া হয় । সমগ্র ভারতবর্ষের মুসলমানগণ এবং বাংলাদেশের মুসলমানগণ এ রায় মানতে না পারলেও সাম্প্রদায়িকতার খাতিরে চুপ ছিল ।
হঠাৎ করেই সে বাবরী মসজিদের বেদনা বিদিত ইতিহাসকে আবারও টেনে এনেছে বিজেপী । লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দিনে বিজেপী ঘোষিত নির্বাচনী ইশতেহারে তারা বলেছে, বিজেপী নির্বাচিত হতে পারলে অযোধ্যার বাবরী মসজিদের স্থলে রাম মন্দির নির্মান করা হবে । তবে সেখানে সাংবিধানিক কাঠামোর বিবেচনা করা হবে ধর্মীয় দৃষ্টিকোনে নয় । এটা হবে সংস্কৃতির ব্যাপার । বিজেপীর এ ঘোষণার পরেই, ভারতের নির্বাচনী হাওয়ায় নতুন পাল লেগেছে ।
ভারতের বিভিন্ন মুসলিম সংগঠন এর তীব্র প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেছে । মুসলিমদের হৃদয়ে চেপে থাকা কঠিন ক্ষত আবারও জাগতে শুরু করেছে । ২৮ টি অঙ্গরাজ্য বিশিষ্ট ভারতের মোট ভোটারের মধ্যে প্রায় এক চতুর্থাংশ মুসলিম ভোটার । তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং সংস্কৃতি, সভ্যতার উপর আঘাত আসলে তারা সম্ভাব্য ফলাফলকে পাল্টিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখেন । যে সব অঞ্চলের মানুষকে ধর্মীয় বিধি পালন করতে সংগ্রাম করতে হয় স্বাভাবিকভাবেই সে সকল অঞ্চলের মানুষ ধর্মের প্রতি বেশি শ্রদ্ধাশীল থাকে ।
যেহেতু ভারতের মুসলমানদেরকে তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করতে রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধ পালন এবং অনেক ত্যাগ ভোগ করতে হয় সেহেতু ধর্মের বিধি-নিষেধকেও তারা কঠোরভাবে পালন করে থাকে । ভারতবর্ষে ইসলামী প্রতিষ্ঠানের উপর আঘাত আসবে আর মুসলিমরা সেটা অনায়াসে মেনে নিবে এরকমটা ভাবাও বোকামী । অন্যকোনভাবে প্রতিবাদ করতে না পারুক অন্তত ব্যালটের মাধ্যমে তাদের প্রতিবাদ জানাবে, আক্রোশ মিটাবেই । ভারতীয় একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং একটি দলের মূখপত্র মীম আফজাল বলেন, “বাবরী মসজিদ, রাম মন্দিরেরর মত বিষয়কে নির্বাচনের আগে ওঠানোর অর্থই হল ওই ইস্যুগুলোকে আবার বাঁচিয়ে তোলা, পুরনো ক্ষত আবারও নতুন করে খুঁচিয়ে দেয়া । আর সেভাবেই ধর্মীয় মেরুকরনের চেষ্ট হচ্ছে নির্বাচনের আগে” ।
২০০৪ সালেও একবার বাবরী মসজিদের স্থানে মন্দির নির্মানের আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল ভারতের কট্টর হিন্দু গোষ্ঠীরা । তাদের জাগ্রত করার পেছনে বিজেপী প্রধান নরেন্দ্র মোদী মূখ্য ভূমিকা পালন করেছিল । মোদির দলের এক নেতা এমনকি মোদিও ভারতকে সম্পূর্ন হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবেন বলে অভিমত দিয়েছিলেন । তবে মুসলমানদের তীব্র প্রতিবাদের মূখের উগ্র হিন্দুরা এবং তাদের মদদ-দাতারা পিছু হটতে বাধ্য হয় ।
একদিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত অন্যদিকে ইসলাম ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত - কোনটিকে মানদন্ড রেখে বাংলাদেশী মুসলমানরা ভারতীয় লোকসভা নির্বাচনের পক্ষপাতিত্ব করবে ।
বাংলাদেশের শতকরা ৮০ শতাংশের উপরে মুসলমান থাকলেও মনে প্রাণে ইসলামকে ধারণ করে তা সঠিক হিসাব কারো কাছে না থাকলেও মুসলমানদের কার্যকলাপ দেখলেই কিছুটা ধারনা করা যায় । ইসলামের মৌলিক ইবাদতগুলোর মধ্যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ অন্যতম । অত্যন্ত দূঃখের হলেও সত্য যে, আশিভাগ মুসলান বসতিপূর্ণ বাংলাদেশের মাত্র পাঁচ শতাংশ মানুষও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ঠিকমত আদায় করে না । বর্তমানকে নিয়েই মানুষের সকল প্রতিযোগিতা । ইতিহাস কিংবা ভবিষ্যত অর্থ্যাৎ মৃত্যুর পরবর্তী জীবনকে সবাই যেন খুব সহজেই ভূলে থাকতে চায় ।
অথচ এটাকেই আকঁড়ে ধরে মানুষের জীবনের কার্যপদ্ধতি আবর্তিত হওয়া উচিত । ভারতের লোকসভা নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ তাদের যে স্বার্থে বিজেপি কিংবা কংগ্রেসের সাপোর্ট করুক না কেন, ধর্মীয় বিবেচনা অথবা রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ধারণে মত দেয়া হোক না কেন তা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার । ইসলাম কারো গোলামী বা কারো অন্যায় সিদ্ধান্তকে মাথা পেতে নেয়ার জন্য পৃথিবীতে আসে নি । বিজেপী তাদের নির্বাচনী ইশতেহাসরে মসজিদের জায়গায় মন্দির স্থাপনের ঘোষণা দিয়ে নির্বাচিত হয়ে তাদের ওয়াদা বাস্তবায়ন করবে আর মুসলমানরা এর বিরুদ্ধে নূন্যতম প্রতিবাদটুকুও করবে না এরকম দূর্বল অবস্থায় মুসলমানরা এখনো পৌঁছেছে কিনা সেটা ভেবে দেখার বিষয় । ধর্মীয় অনুভূতির যে স্থানেই ইসলামের শত্রুদের পক্ষ থেকে আঘাত এসেছে তার প্রতিটির কঠোর জবাব মুসলামনরা দিয়েছে ।
আশা নয় বিশ্বাস, বিজেপীর এমন স্পর্ধার বিরুদ্ধেও মুসলামনরা চুপ থাকবে না । হোক সে ভারতের কিংবা বাংলাদেশের মুসলমান । মুসলমানরা যে বর্ণের বা ভৌগলিকভাবে যে পরিচয়ের অধিকারী হোক না কেন এদের একটাই পরিচয় আমীর, ওমরা সকলেই ইসলামের নগণ্য খাদেম । রাজনীতির আগে ধর্ম । ধর্মকে তার অস্তিত্ব নিয়ে টিকিয়েই তারপরে রাজনীতি ।
বিজেপীর ঔধত্যপূর্ণ দুঃসাহসিকতার জবাব ভারতের সকল মুসলমানরা ব্যালটের মাধ্যমে এবং বাংলাদেশসহ বিশ্বের মুসলমানরা বিজেপীর প্রতি ঘৃণার মাধ্যমে শোধ দেবে ।
রাজু আহমেদ । কলাম লেখক ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।