ক্ষমতা দখল করে ফেলা মানেই কি "বিপ্লব"? আদর্শিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে অবশ্যই না। অক্সফোর্ড ডিকশনারী "বিপ্লব"কে সংগায়িত করেছে, "পুরাতন সরকার বা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ন পরাস্ত করে, নতুন একটি ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করা (revolution is a forcible overthrow of a government or social order, in favor of a new system)। " নতুন একটা ব্যবস্থা হঠাৎ করেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় না। এর জন্য প্রেক্ষাপট তৈরি হতে হয়। নতুন সেই ব্যবস্থাটিকে সমাজের অধিকাংশ মানুষের কাছে যথাযথভাবে বোধগম্য হতে হয়, তার জন্য সকলের মানসিক চেতনায় আবেদন তৈরি হতে হয়।
তাই একটি সফল "বিপ্লব" কখনই অস্থায়ী হয় না। তা বদলে দেয় মানুষের জীবনাচরণ। পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে সমাজের প্রতিটি স্তরে-স্তরে, রন্ধ্রে-রন্ধ্রে।
বিগত শতাব্দীর আলোচিত বিপ্লবসমূহ পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পারব যে, সবগুলো বিপ্লবই আদর্শিক বিপ্লব ছিল না। অর্থাৎ কোন নির্দিষ্ট আদর্শকে বাস্তবায়নের কর্মসূচীর অংশ হিসেবে কোন কোনটি সংঘটিত হয় নি।
অষ্টাদশ শতকের শেষভাগের সবচেয়ে আলোচিত বিপ্লব বোধকরি 'ফ্রেন্স রেভ্যলুশন" বা 'ফরাসী বিপ্লব"। এটি সংঘটিত হয়েছিল ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই। এই বিপ্লবের গতি ত্বরান্বিত হওয়ার পেছনে যে সকল কারণসমূহ সক্রিয় ছিল তার মধ্যে অর্থনৈতিক কারণটা বেশ প্রভাবশালী ছিল। সাধারণ জনগণের সাথে সংঘটিত অর্থনৈতিক বৈষম্যই তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। ১৪ জুলাই ২০১০, দৈনিক জনকন্ঠে ড. কামাল হোসেনের লিখিত প্রবন্ধটিতে সংক্ষেপে ফরাসী বিপ্লবের প্রেক্ষাপট উঠে এসেছে-
“পূর্ববর্তী রাজাদের যুদ্ধনীতি ও বিলাস ব্যসনের কারণে ষোড়শ লুই-এর আমলে দারুণ আর্থিক সঙ্কট দেখা দেয়।
কর বৃদ্ধি করা ছাড়া আর্থিক সংস্থানের কোন বিকল্প ছিল না। সমস্যা সমাধানের জন্য রাজা অর্থ সচিব নেকারের পরামর্শ চান। নেকার স্টেট জেনারেলের বৈঠক না ডেকে কর বৃদ্ধি করা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেন। অথচ ১৭৫ বছর ধরে স্টেট জেনারেলের অধিবেশন হয় না। নিরুপায় রাজা প্রস্তাবে সম্মত হন।
কিন্তু থার্ড স্টেট-এর নেতৃবৃন্দ সুযোগ বুঝে দাবি উত্থাপন করেন যে, নির্বাচনের আগে তাদের সদস্য সংখ্যা অভিজাত ও যাজক সম্প্রদায়ের মোট সংখ্যার (৩০০+৩০০=৬০০) সমান করতে হবে। রাজা ১৭৮৮-এর ডিসেম্বরে দাবি মেনে নেন। নির্বাচনের আগেই সিদ্ধান্ত হয় যে, ১৭৮৯ সালের ৫ মে নবনির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে স্টেট জেনারেলের অধিবেশন বসবে। এপ্রিল মাসের শেষ দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ফলাফলে দেখা যায়, যাজকদের জন্য নির্ধারিত ৩০০টি আসনের মধ্যে নির্বাচিত হন ২৯১ জন এবং অভিজাতদের ৩০০টি আসনে নির্বাচিত হন ২৭০ জন।
এতে অভিজাত ও যাজকদের মোট নির্বাচিত সদস্যের সংখ্যা হয় ৫৬১টি। অপরদিকে থার্ড স্টেট বা তৃতীয় সম্প্রদায় একাই লাভ করে ৫৭৮টি আসন। বিভিন্ন কারণে তিন ক্যাটাগরি থেকে সর্বমোট ৬১টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। নির্বাচনের মাধ্যমে তৃতীয় শ্রেণীর প্রাধান্য স্পষ্টভাবে নির্ধারিত হয়। কিন্তু রাজা তৃতীয় সম্প্রদায় ছাড়াই অধিবেশনে বসেন এবং কর প্রস্তাব দেন।
তৃতীয় শ্রেণীর সদস্যরা সভাকক্ষে ঢুকতে না পেরে অপমানিতবোধ করেন। ১৭ জুন তারা নিজেদেরকে সমগ্র জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি বলে ঘোষণা দেন।
২০ জুন তৃতীয় সমপ্রদায়ের প্রতিনিধিরা সভাস্থলের পাশে টেনিস কোর্টে মিলিত হন এবং এটিকে জাতীয় সভা হিসেবে ঘোষণা করেন। এমনিতেই তাদের সদস্য সংখ্যা অন্য দু' সম্প্রদায়ের সমষ্টির চেয়ে বেশি ছিল, তদুপরি পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে যাজক ও অভিজাত সমপ্রদায়ের অনেক নির্বাচিত সদস্য তৃতীয় শ্রেণীর এই বিকল্প সভায় যোগ দেন। টেনিস কোর্টে মিলিত হয়ে তারা সম্মিলিত শপথ করেন যে, যতদিন ফ্রান্সের জন্য তাঁরা একটি সংবিধান রচনা সম্পন্ন না করতে পারবেন ততদিন তাঁরা একত্রে থাকবেন।
এটি “টেনিস কোর্টের শপথ” নামে ইতিহাসে পরিচিত। ২৩ জুন রাজা ঘোষণা দেন, ৩ শ্রেণীর প্রতিনিধির মধ্যে বিদ্যমান পার্থক্য বজায় রাখতে তিনি বদ্ধপরিকর। তৃতীয় সম্প্রদায়ের গৃহীত সিদ্ধান্ত তিনি নাকচ করে দিলেন। সকলকে সভাকক্ষ ত্যাগ করার জন্য দূত প্রেরণ করেন। টেনিস কোর্টে্র সভাপতি বেইলি জবাবে দূতকে বলেন "আমার ধারণা, জাতীয় এ সভা কারও হুকুমের দাস নয়।
" তৃতীয় সম্প্রদায়ের আর এক নেতা মিরাবো তার বিখ্যাত উক্তিটি করেন "যাও তোমার প্রভুকে বল যে, আমরা এখানে রয়েছি জনগণের নির্দেশে এবং বেয়নেট দিয়ে না খুঁচিয়ে আমাদের নড়ানো যাবে না। " রাস্তায় রাস্তায় স্লোগান ওঠে 'থার্ড স্টেট জিন্দাবাদ'।
পরিস্থিতি সম্পূর্ণরূপে রাজার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। যেহেতু অর্থ সচিব নেকারের প্রস্তাব ও পরামর্শে রাজা এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন এবং সমগ্র বিষয় রাজতন্ত্রের জন্য বুমেরাং হয়ে দেখা দিয়েছে সেহেতু ক্ষুব্ধ রাজা নেকারকে ১২ জুলাই পদচ্যুত করেন। তিনি কর্তৃত্ব পুনর্প্রতিষ্ঠার জন্য তৎপর হন।
নেকারকে পদচ্যুত করায় প্যা্রিসে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। ইতোমধ্যে প্যারিসের পৌরসভা নির্বাচন হয় যাতে তৃতীয় শ্রেণীর প্রতিনিধি বেইলি পৌর মেয়র নির্বাচিত হন। একইভাবে বিপ্লবীদের গুরুত্বপূর্ণ আর এক নেতা লাফায়েত হন জাতীয় রক্ষী বাহিনীর প্রধান। পরিস্থিতি সম্পূর্ণরূপে তৃতীয় সম্প্রদায়ের অনুকূলে চলে আসে। নেকারের পদচ্যুতির ঘটনায় যে উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল তা আরও বেড়ে গেল যখন জনগণের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে পড়ল যে, রাজা বিদেশী শক্তির সহযোগিতায় প্যারিসের ওপর কর্তৃত্ব পুনস্থাপন করতে চলেছেন।
বস্তুত দেশী-বিদেশী মিলে প্যারিসে ২০ হাজার সশস্ত্র সৈন্য সমাবেশ ঘটানো হয়। জনগণ আরও জানতে পারল প্রচুর যুদ্ধাস্ত্র রাজকীয় অস্ত্রাগার হতে এনে জমা করে রাখা হয়েছে বাসত্মিল দুর্গে। দুর্গের ভেতর থেকে কামানের মুখ জনাকীর্ণ সেঁতাতোয়ান বসতির দিকে ঘুরিয়ে রাখা হয়েছে। ১৩ তারিখ পৌর ভবনের সামনে মানুষ সমবেত হয়। একটি নাগরিক রক্ষীবাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত হয় এই সমাবেশ হতে।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ১২ হাজার সদস্য রক্ষীবাহিনীতে যোগদান করে। তাই ১৪ জুলাই সকাল থেকে বাসত্মিলের দিকে শহর ও দূরবর্তী স্থান হতে আগত হাজার হাজার মানুষ এগিয়ে যেতে থাকে। জনতার পক্ষে নির্বাচিত নেতারা প্রাণহানি এড়ানোর জন্য বাসত্মিলের কর্মাধ্যক্ষ দ্য লোনের কাছে আলোচনার প্রস্তাব দেন। তিনি বাসত্মিলের প্রতিরক্ষার (৯০ ফুট উঁচু প্রাচীর, জলপূর্ণ ৭৫ ফিট পরিখা, প্রবেশ দরজা ভেতরের দিক থেকে উঁচিয়ে রাখা) বিষয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন বিধায় আলোচনায় রাজি হলেন। বাসত্মিলে প্রকৃতপক্ষে তখন মাত্র ৭ জন বন্দী ছিল।
অনেকে বলে থাকেন জনতা বাসত্মিল ভেঙ্গে রাজবন্দীদের মুক্ত করার জন্য গিয়েছিল। বিষয়টি আদৌ তা নয়। রাজবন্দীদের নির্যাতন আর বন্দী করে রাখার কারণে বাসত্মিলের প্রতি মানুষের ক্ষোভ ছিল ঠিকই, কিন্তু সেখানে জনতা গিয়েছিল কামানগুলো নিষ্ক্রিয় করা এবং রক্ষিত অস্ত্রশস্ত্র জনতার হাতে তুলে দেয়ার দাবি নিয়ে। বিকেলের দিকে জনতার উত্তাল ঢেউ বাসত্মিলের সামনে আছড়ে পড়ে। কীভাবে যেন দুর্গে প্রবেশের উঁচু করে রাখা সিঁড়িপথ নামিয়ে উত্তেজিত জনতা বাসত্মিলের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় কর্মাধ্যক্ষ দ্য লোন জনতার ওপর কামান দাগার হুকুম দেন। ফলে ৯৮ জন অবরোধকারী নিহত এবং ৭৫ জন আহত হয়। তখন জনতার ওপর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায়। এরপর চারিদিক থেকে উত্তেজিত ক্ষুব্ধ জনতা বাসত্মিলকে বিধ্বংস করে। পতন ঘটে সুরক্ষিত বাসত্মিলের।
পতন হলো স্বৈরাচারী বুঁরবো রাজাদের গর্ব। আর বিশ্ব ইতিহাসে রচিত হলো 'মানুষের দ্বারা সংঘটিত পবিত্রতম ঘটনা' ফরাসী বিপ্লবের কথা। পরবর্তীকালে এটি ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন মহাদেশে নির্যাতিত মানুষকে শোষণ ও বন্ধনমুক্তির সংগ্রামে অনুপ্রেরণা যোগায়"। স্বাধিকার আদায়ই ছিল এ বিপ্লবের মূল চালিকাশক্তি, নির্দিষ্ট কোন আদর্শকে বা আদর্শিক আন্দোলনকে বিজয়ী করার কোন প্রেরণা নয়।
এ পর্যায়ে আমরা দৃষ্টিপাত করব “অক্টোবর বিপ্লব” এর প্রতি।
“অক্টোবর বিপ্লব” রাশিয়ার ভাগ্যাকাশে এনে দিয়েছিল এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের ছোঁয়া। সমাজতান্ত্রিক এই বিপ্লব সংঘটিত হয় ১৯১৭ সালের ২৫ অক্টোবর (আধুনিক গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি অনুসারে ৭ই নভেম্বর, একারণে এই বিপ্লব ‘নভেম্বর বিপ্লব’ নামেও পরিচিত)। একই বছর ফেব্রুয়ারীতে ঘটে যাওয়া গণ অভ্যুত্থানে পতন হয় দীর্ঘ বছর যাবৎ চলে আসা “জার” শাসকদের; সেই সাথে রাশিয়ার ইতিহাসে পতন হয় রাজতন্ত্রেরও। এরপর একটি সাময়িক/অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয় উদারপন্থী ও সমাজতন্ত্রীদের সমন্বয়ে। পাশাপাশি এই অন্তর্বর্তীকালীন অস্থায়ী সরকারের সাথে “দ্বৈত শাসক” হিসেবে সমাজতন্ত্রীরা গড়ে তোলেন “পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েত” নামে শ্রমিক সংঘ।
অবশেষে অক্টোবর বিপ্লবে অস্থায়ী সরকারের হাত থেকে ‘বলশেভিক’দের (রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল বেশ আগে থেকেই; সংখ্যাগরিষ্ঠদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল ‘বলশেভিক’ বা ‘Majority’ এবং অপরটি ছিল ‘মেনশেভিক’ বা ‘Minority’) হাতে রাশিয়ার ক্ষমতার চাবি হস্তান্তরিত হয়। এই বিপ্লব নিয়ে, বিপ্লব সংঘটনের কর্মপন্থা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু সর্বোপরি সকল সাধারণ জনগণের মধ্যে শ্রেণীবৈষ্যমের বিরুদ্ধে সচেতনতা ও জনমত গড়ে উঠেছিল। আর তা সেই সকল বিপ্লবী আন্দোলনের অনুসারীদের তাদের আন্দোলনের যথাযথ শিক্ষা ও আদর্শ ব্যাপকভাবে প্রচারের মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছিল। সাধারণ জনগণের চোখে তা স্বপ্ন এঁকে দিয়েছিল এক শ্রেণীহীন সমাজের। মোটকথা, সাধারণের কাছে সেই আদর্শিক শিক্ষা যথেষ্ট মাত্রায় বোধগম্য ছিল।
সমাজতান্ত্রিক এই বিপ্লবের ছোঁয়া লেগেছিল বিশ্বব্যাপী।
গেল শতাব্দীর অপর উল্লেখযোগ্য বিপ্লবটি হল “ইরানের ইসলামিক বিপ্লব”। ইরানে ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে গণজাগরণের সূচনার মাধ্যমে বিপ্লবের যে পটভূমি তৈরি হয়েছিল, ডিসেম্বর ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান’ গঠিত হওয়ার মাধ্যমে সেই বিপ্লব পূর্ণতা অর্জন করেছিল। জনগণের মনমানসিকতা, চাহিদা ইত্যাদিকে উপেক্ষা করে নিজের স্বৈরাচারী রূপ উপস্থাপনের মাধ্যমে এবং সেসকল স্বৈরাচারী সিদ্ধান্তসমূহকে জনগণের উপর চাপিয়ে দিয়ে কোন শাসকই চিরদিন শাসন ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে না। ইরানের এই আদর্শিক বিপ্লবটি ত্বরান্বিত হবার পেছনে বেশ কিছু কারণ নিয়ামক হিসেবে ভূমিকা রেখেছিল।
জনগণের উপর শিয়া আলেমদের বেশ প্রভাব ছিল; প্রভাব ছিল মূলত তাঁদের ধার্মিকতা, নৈতিকতা, ঐতিহ্যের অনুসরণ এবং তৎকালীন শাসকদের পশ্চিমীকরণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার কারণে। এটা প্রমাণিত হয়, ১৮৯১ সালের “তামাক বিরোধী” বিদ্রোহের সময়ে তামাকের প্রতি আলেমদের নিষেধাজ্ঞা মেনে নিয়ে আন্দোলনে জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহনের মাধ্যমে। “শাহ” (সে সময়কার ইরানী শাসকদেরকে শাহ বলা হত)-এর ব্রিটিশ একটি কোম্পানীকে ইরানে তামাক ব্যবসার অনুমতি প্রদানের সিদ্ধান্তকে জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছিল। এই বিদ্রোহের এক দশক পরে “শাহ” বনাম “আলেম সমাজ” দ্বন্দ্ব তুংগে উঠে। এতে তৎকালীন শাসক রেজা শাহ ইসলামী আইন বাতিল করেন, ঐতিহ্যবাহী ইসলামী পোষাক, হিজাব ইত্যাদি নিষিদ্ধ করে তদস্থলে পাশ্চাত্য আইন ও নিয়ম-কানুন, সংস্কৃতি ইত্যাদি জারি করেন।
রেজা শাহ-এর পরে তার পুত্র মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভী ইরানের শাসক হিসেবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। তিনিও তার পিতার পদাংক অনুসরন অব্যাহত রাখেন। ধর্মীয় প্রভাবকে খর্ব করে স্বৈরতন্ত্র, পাশ্চাত্যকরণ, তথাকথিত আধুনিকীকরণ ইত্যাদি নীতি পূর্বের ন্যায় যথারীতি বহাল থাকে। তার এসকল নীতির বিরুদ্ধাচরণ করার কারণে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বামপন্থি, জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামী গোষ্ঠীগুলোর উপর “সাভাক বাহিনী” (গোপন পুলিশ বাহিনী) দিয়ে ‘শাহ’ তার রাজনৈতিক নিপীড়ণ চালাতে থাকে। সামাজিক অবিচার, জনগণের মতের বিরুদ্ধে অতিমাত্রায় পশ্চিমীকিকরণ, পশ্চিমাদের প্রতি অতিমাত্রার সম্পর্ক বজায় রাখার প্রবনতা, দুর্নীতিপরায়নতা, ইসলামী মূল্যবোধসমূহের প্রকাশ্য বিরুদ্ধাচরণ, অর্থনৈতিক নীতিতে ব্যর্থতা ইত্যাদি জনসাধারণের মাঝে “শাহ”এর প্রতি অনাস্থাই আনয়ন করেছিল।
আর অনাস্থাই গণঅভ্যুত্থানের ইন্ধন হয়েছিল, আবির্ভূত হয়েছিল অনিবার্য বিপ্লব হয়ে। আর আদর্শিকভাবে ইরানীদের মাঝে জনপ্রিয় হয়েছিল জালাল আলী আহমাদের “গারবজাদেগী” (ফারসী শব্দ, যার অর্থ ছিল এই যে, ‘পাশ্চাত্য সংস্কৃতি প্লেগ বা বিষের মত যা পরিত্যাজ্য’)। আলী শরীয়তীর ‘ইসলাম’ সম্পর্কিত এই দৃষ্টিভংগী যে ‘এটাই কেবলমাত্র মুসলিমদের সকল সাম্রাজ্যবাদী, পুঁজিবাদী আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে পারে’। মুর্তাজা মোতাহহারির শিয়া ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের ব্যাপক শিক্ষা এবং সর্বোপরি আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনীর “বেলায়েত-এ-ফাকিহ”(অর্থাৎ আলেমদের অবিভাবকত্বের শাসন) দর্শনের জনপ্রিয়তা, মুসলিম হিসেবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রয়োজনীয়তা ও এর মাহাত্ম্য জনসাধারণকে ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল। যদিও শিয়া-সুন্নী মতভেদের কারণে এ বিপ্লবকে “ইসলামী বিপ্লব” আখ্যা দিতে অনেক বিশেষজ্ঞই সম্মত হন না, তথাপি আদর্শিক বিপ্লবের এ এক অনুপম উদাহরণ।
ভারতীয় উপমহাদেশে বিগত শতাব্দীগুলোতে (বিশেষত, উনবিংশ-বিংশ শতাব্দী) বিদ্রোহ, গণঅভ্যুত্থান, স্বাধীকার আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন, এমনকি বিপ্লবেরও অনেক উদাহরণ রয়েছে তথাপি পূর্নাংগ ‘আদর্শিক বিপ্লব’ এর উদাহরণ খুঁজে পাওয়া বেশ দুষ্কর। কিন্তু আদর্শিক বেশ কিছু আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে, এমনকি এখন অবধি চালু রয়েছে। বিচ্ছিন্ন কিছু অনস্বীকার্য সফলতা অবশ্যই এ সকল আদর্শিক আন্দোলনসমূহের রয়েছে। তারপরও একথা অকপটে বলতেই হবে যে, সার্বিক বিপ্লব আনতে এসকল আন্দোলনসমূহ এখনো পর্যন্ত সফলকাম হয়ে ওঠেনি। একথা ডান-বাম সব আদর্শবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
অসংখ্য কারণ থাকতে পারে এই সফলকাম না হয়ে ওঠার পেছনে, ভবিষ্যতে কখনো সফলকাম হবে না এমনটিও নয়- তবে আমার দৃষ্টিতে নিজেদের আদর্শের সঠিক শিক্ষার প্রসারের অভাবই সার্বিক বিপ্লব সংঘটিত না হবার পেছনে মূল কারণ। জনসাধারণের একটি বিরাট অংশ এসকল আদর্শিক আন্দোলন সম্পর্কে, আদর্শের শিক্ষা সম্পর্কে বলতে গেলে পরিষ্কার কোন ধারণাই রাখে না। শাসক শ্রেণীর অত্যাচার, অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক শোষন নিপীড়ন হয়ত সাধারণ মানুষকে ঘর ছেড়ে, কর্মস্থল ছেড়ে রাজপথে নামাবে কিন্তু সেই সকল জনসাধারণের মানসপটে যদি আদর্শিক বিপ্লবের শিক্ষার বীজ বোপিত না থাকে তাহলে বিপ্লব হয়ত হবে, কিন্তু সে বিপ্লব ফুলে ফলে সুশোভিত বৃক্ষের ন্যায় আদর্শিক বিপ্লব কখনই হবে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।