আর কতো রক্ত দেবে বাঙ্গালী ।
আত্মাভিমানী গল্পকার নীলু দাসকে যেভাবে জানলাম
নীলু দাস । যিনি ষাট দশকের গল্পকার নীলু দাস হিসেবেই পরিচিত । নীলু দাসকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি, জেনেছি, ও অভিভূত হয়েছি তাঁর সাধারণ জীবন যাপন এবং দর্শনে । কিন্তু গল্পকার নীলু দাসকে আমি এখনও পুরোপুরি জানতে পারিনি ।
এই যে জানতে না পারা এটা আমার অপারগতা ও মূর্খতা ।
সেই যেদিন প্রথম নীলু দাসের ‘হার’ গল্পটি পড়ি, সেদিন থেকেই নীলু দাসের গল্পের প্রেমে পড়ি । তখন কি জানতাম, আমার জন্মদাতা পিতা নীলু দাসই এই গল্পের লেখক । সত্যি তখন জানা ছিলনা, নিশ্চুপ এই মানুষটির ভেতরের এতসব গুণাবলী । সেদিন থেকেই গল্পকার নীলু দাসকে জানার এক অদম্য বাসনা আমাকে পেয়ে বসে ।
কিন্তু নীলু দাস ততোদিনে প্রায় সাহিত্য চর্চাই ছেড়ে দিয়েছেন । এভাবে দিনের পর দিন চলে যায় । আমার লালিত বাসনাকে পুষতে পুষতে আমি বেড়ে উঠি । দেখা হয় কবি আমিনুর রহমান সুলতান- এর সাথে । সুলতান ভাইয়ের কাছে আমি কৃতজ্ঞ ।
কারণ উনার কাছেই আমি গল্পকার নীলু দাসকে প্রথম জেনেছি । শুধু তাই নয়, আমিনুর রহমান সুলতান-এর জন্যই আত্মাভিমানী নীলু দাস আবার লেখালেখির জগতে ফিরে আসেন । কিন্তু নীলু দাস কেনো লেখালেখি থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন ? কেনো এই অভিমান ? লেখার প্রতি অনিহা নাকি নিজের জীবনের প্রতি এই অনিহা ? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শুরু করি । উত্তর পেয়ে যাই ঠিক এভাবে…
নীলু দাসের এক সাক্ষাৎকারে অমিত্রাক্ষর সম্পাদক আমিনুর রহমান সুলতান জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি তো দীর্ঘদিন ধরেই লিখছেন না, লিখছেন না কেনো, লেখার জন্য কি যন্ত্রণা-তাড়িত হন না ? উত্তরে নীলু দাস বলেছিলেন –“ দীর্ঘদিন ধরে না লেখার কারণটা বোধ হয় আমি নিজেও গুছিয়ে বলতে পারব না । একটা মানসিক বিপন্নতাবোধ আমার ভেতরে কাজ করে, যার জন্য এখন আর সহজে কলম ধরতে পারিনা ।
এ সম্পর্কে দুটি ঘটনার কথা আপনার কাছে উল্লেখ করতে চাই । সময়টা বোধ হয় ১৯৬৪ সাল । তৎকালীন পাকিস্তানে তখন আইয়ুব খানের শাসন চলছে । আমি তখন টংগী স্টেশনে কা্র্যরত । পাকি ভারত যুদ্ধের গ্লানি থেকে পূর্ববাংলার মানুষের দৃষ্টি অন্য কিছুতে আচ্ছন্ন করার মানসে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে আইয়ুবী সরকার একটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি করে ।
এই দাঙ্গা নারায়ণগঞ্জ হতে জয়দেবপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । দীর্ঘ নয় দিন পর্যন্ত এই নারকীয় হত্যা এবং অগ্নিসংযোগের তাণ্ডব চলে । শিল্পনগরী বলে টংগীর অবস্থা হয়েছিল অত্যন্ত ভয়াবহ । কয়েকজন হৃদয়বান মুসলমান বিশেষকরে ট্রলিম্যান নেকবর আলী ও তৎকালীন টংগী পৌরসভার চেয়ারম্যান জনাব আব্দুল মজিদ সরকারের সার্বিক সহায়তায় কোন রকমে আমি প্রাণে বেঁচে যাই । কিন্তু পুড়ে ভষ্ম হয়ে যায় আমার সাজানো প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত গল্প উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি ।
পরে অবশ্যি প্রকাশিত লেখার কপিগুলো বিভিন্ন পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করেছিলাম । অপ্রকাশিত লেখাগুলো মন থেকে চিরতরে হারিয়ে গিয়েছিল ।
একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো ১৯৭১ সালে । আবারও আমার সকল পাণ্ডুলিপি রাজাকার বাহিনী কতৃক পুড়ে ছাই হয়ে গেল ।
আশাকরি আমার অক্ষমতার কথাটা আপনি বুঝতে পেরেছেন ।
তবে এ কথাটা স্বীকার করতেই হবে, আপনার মরমী মনের সাহচার্য আমাকে আবার লেখার জগতে ফিরে যাবার জন্য উদ্ভুদ্ধ করছে । ” [ সাক্ষাৎকার, ১২-০৯-২০০১, আঠারবাড়ি, ঈশ্বরগঞ্জ, ময়মনসিংহ ]
নীলু দাস মূলত গল্প লিখতেন । তবে তিনি বেশ কয়েকটি উপন্যাসও লিখেছেন । শুধু তাই নয়, নীলু দাস বেশ কিছু মঞ্চ নাটকেও অভিনয় করেছেন । দেবদাস নাটকের মূল চরিত্র দেবদাস ।
এই চরিত্রটি অভিনয় করে নীলু দাস বেশ সুনাম পেয়েছিলেন ।
গল্পকার নীলু দাস সম্পর্কে বিশেষ তথ্যটি পেয়েছি সাযযাদ কাদির-এর একটি লেখা থেকে । ধন্যবাদ সাযযাদ কাদিরকে । তিনি লিখেছেন – “ঈদ সংখ্যা ‘বেগম’ ছিল সাধারণ পাঠকসমাজে সবচেয়ে প্রিয়। এর বিশেষ আকর্ষণ ছিল প্রথম দিকে এক ফরমাব্যাপী লেখিকাদের পাসপোর্ট সাইজের ছবি।
ওই লেখিকারা ছিলেন বলতে গেলে অমরযৌবনা। একই বয়সের (প্রথম যৌবনের) একই ছবি তাঁদের ছাপা হতো বছরের পর বছর। বেশির ভাগ লেখিকা ছিলেন ভুয়া, নারী-নাম ব্যবহারকারী পুরুষ। এঁদের মধ্যে বিশেষ খ্যাতি পেয়েছিলেন নীলু দাস। পরে জানা গেছে, তাঁর এক বউদির ছবি ব্যবহার করতেন তিনি ।
”
অধ্যাপক যতীন সরকার নীলু দাসের বন্ধু । ঠিক বন্ধু নয়, বন্ধু স্থানীয় । কারণ বয়সের দিক দিয়ে নীলু দাস ছিল বড় । যতীন সরকার ; পাকিস্থানের জন্ম মৃত্যু ও দর্শণ-এর লেখকের কাছ থেকে গল্পকার নীলু দাসকে জেনেছি । জেনেছি কতো ভালো লিখতেন নীলু দাস।
অধ্যাপক যতীন সরকার – এর ভাষায় –‘ নীলু দাস । সাহিত্য, সংস্কৃতি বলতে গেলে মার্কশিষ্ট ছিলনা তবে ওই লাইনেই ছিল । আজকে নীলু দাস অনালোচিত । এর কারণ নীলু দাস তাঁর লেখাগুলোকে প্রকাশ করার কোনো তাগিদই ছিলনা । আমরা তাকে নিয়ে বহু জায়গায় গেছি ।
একবার ১৯৬৮ সালে, ২২ শে শ্রাবণ অনুষ্ঠান । তখন আইয়ুবী রাজত্ব । কোনো ভাবেই রবিন্দ্রনাথকে সহ্য করা যাবে না । কিন্তু আমরা রবিন্দ্রনাথ করবই । অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো ময়মনসিংহ প্রেস ক্লাবে ।
অনুষ্ঠানে আসার কথা ছিল কবির চৌধুরীর । কিন্তু যে কোন কারণে উনি আসেন নাই । খান সাহেব আব্দুল্লাহকে সভাপতি করা হলো । মঞ্চের ঠিক সামনে অনেকের সাথে আমিও বসলাম । অনুষ্ঠানের শুরুতে নীলু দাস বক্তব্য শুরু করলেন ।
নীলু দাস বললেন, আজকে রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে আমার কিছুই চলেনা । কারণ রবীন্দ্রনাথ……
কথা শেষ করার আগেই কয়েকজন উঠতি বয়সের ছেলে (যাদের মুখ দিয়ে তখনো মদের গন্ধ বের হচ্ছিল) উঠে দাঁড়িয়ে বলল, অব্জেকশান । থাকবেন পাকিস্থানে আর ইন্ডিয়ার কবির কথা কইবেন, এটা হবেনা । ইকবালের কথা কইবেন । এবং সাথে সাথে শ্লোগান দিল-রবীন্দ্র গোষ্ঠী ধ্বংস হোক, ইকবাল গোষ্ঠী জিন্দাবাদ ।
ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে দিল । মঞ্চের পাশে রাখা তবলাগুলো ভাঙ্গা হল এবং নীলু দাসের সামনে ছুঁড়ি ধরা হল । সেদিন নীলু দাসকে ওরা লাঞ্চিত করে । নীলু দাস প্রাণে বেঁচে যায় । আমরা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছি ইকবাল গোষ্ঠীর তাণ্ডব ।
কারো কিছু করার ছিলনা ।
ঠিক এই খানেই নীলু দাসের গল্পের সাথে তাঁর (নীলু দাসের)মিল খুঁজে পাওয়া যায় । কারণ, নীলু দাসের লেখার বিষয়বিন্দু মানুষ, মানুষের অসহায়তা ও অসংগতি । দলিত মানুষেরা বার বার তাঁর গল্পের প্রধান চরিত্র হয়েছে ।
দীর্ঘদিন পর নীলু দাসের ১২ টি গল্প ( চৈতার খাল, ফুলবানু, ভাটিয়াল গাঙ্গের নাইয়া, পদ্মা পাড়ের কাহিনী, জ্যোতিষী, রাজপুত্র আর রাজ কন্যার কাহিনী, বাউল, কবর, রাত্রির রঙ কালো, কাহিনী, নগর-নাগিনী এবং হার)সংগ্রহ করে আমিনুর রহমান সুলতানের সম্পাদনায় বাংলা বাজার বই পাড়ার টুম্পা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘নীলু দাসের গল্প’ গ্রন্থ একুশের বই মেলা ২০০২ সালে ।
প্রত্যেক লেখকেরই একটি অনবদ্য সৃষ্টি থাকে । যা ওই লেখককে আলাদা কিছু এনে দেয় । নীলু দাসের এমনি একটি অনবদ্য সৃষ্টি ‘চৈতার খাল’ ।
‘নীলু দাসের গল্প’ গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর পরই ষাট দশকের অনালোচিত গল্পকার নীলু দাসকে নিয়ে শুরু হয় আলোচনা । ৮ মার্চ ২০০২ যুগান্তর সাময়িকীতে আবু কায়সার লিখেছেন – ষাট দশকের গল্পকার নীলু দাস চাকুরি করতেন রেলওয়েতে ।
টাঙ্গাইলে আয়োজিত এক সাহিত্য সম্মেলনে তিনি এসেছিলেন ময়মনসিংহ থেকে । পরনে পাজামা, গায়ে পাঞ্জাবি, পায়ে চপ্পল । ঝক ঝকে এক তরুণ । ‘সমকাল’ , ‘মাহে নও’ থেকে শুরু করে দেশের বড়ো বড়ো সব কাগজেই তাঁর লেখা বেরুচ্ছে তখন । সেই সম্মেলনের পর কত বছর যে চলে গেছে আমি যখন লেখালেখি শুরু করি তখন আরও ক’জনের মতো তিনিও চলে গেছেন নেপথ্যে ।
এবারের বই মেলায় সেই নীলু দাসের গল্প গ্রন্থ এসেছে পত্রিকায়- এ খবর পড়ে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলাম । জানা গেল, এই নির্ভেজাল মানুষটির ওপর দিয়ে বহু ঝড় ঝাপ্টা গেছে । সাম্প্রদায়িক নিপীড়নে বার বার বিপর্যস্ত হয়ে মানুষটা সাহিত্য চর্চাই ছেড়ে দিয়েছেন । চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করে নীলু দাস নাকি এখন একটি আশ্রমে কর্মরত । আমার প্রিয় লেখক আবু সাঈদ জুবেরীর মুখে ওই লেখক সর্ম্পকে অনেক কথাই জানা গেল ।
জুবেরী নীলু দাসকে নিয়ে কি যেন একটা লিখছেন । তিনি তো বললেন-গল্প । গল্প-প্রবন্ধ যাই হোক-লেখাটি পাঠ করার প্রতীক্ষায় থাকলাম ।
অমিত্রাক্ষর সম্পাদক কবি আমিনুর রহমান সুলতান-এর তাগাদার পর তাগাদায় সত্যি দীর্ঘ বছর পর নীলু দাস আবার লেখা শুরু করেন । প্রথমে ‘ইবলিশ’ পরে ‘উচ্ছ্বেদ’ ।
দুটি গল্পই অমিত্রাক্ষরে প্রকাশিত হয় । লেখালেখির জগতে নীলু দাসের এই ফিরে আসা সাহিত্যানুরাগী ব্যক্তিবর্গ অনেকটা আশস্থ হন । কিন্তু ততোদিনে নীলু দাসের দেহে বাসা বাঁধে ক্যান্সার নামের এক মরণব্যাধি । ২০০৩ সালের ১০ ডিসেম্বর এই গল্পকারের জীবনাবসান ঘটে ।
যাদের কাছে কৃতজ্ঞ ঃ
1. অমিত্রাক্ষর সম্পাদক কবি আমিনুর রহমান সুলতান
2. অধ্যাপক যতীন সরকার
3. সাযযাদ কাদির
4. আবু কায়সার
উজ্জল দাস
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।