........................... ডাক্তার হয়ে জন্মেছি, তাই 'খেপ' মারতেই হয়। কনফিউজড করে দিচ্ছি? সবাই হয়তো ভাবছেন, খেপ তো মারে মাঝি আর ড্রাইভার রা, ডাক্তার কেন খেপ মারবে? একটু খোলাসা করি। আমরা যারা বিভিন্ন হাসপাতালে চাকুরি করি, বিশেষত সরকারি চাকুরি; সংসার চালিয়ে 'ডাক্তার' স্ট্যাটাস মেনটেন করতে তাদের বেশ বেগ পেতে হয়। অনেকে আছেন এর পাশাপাশি বিকেল বেলায় প্রাইভেট চেম্বার করেন, আর আমার মত কিছু অভাগা, যারা সেটাও জোগাতে পারে না, তাদের জন্য বরাদ্দ থাকে সপ্তাহের একটিমাত্র ছুটির দিন, শুক্রবার। দেশের স্বাস্থ্যসুবিধায় পিছিয়ে থাকা এলাকাগুলোয় প্রতি শুক্রবার আমরা ঢু মারি রোগীর আশায়, রোগির সেবার সাথে যেন কিছু বাড়তি রোজগার হয়, বউ যেন মাসের মাঝামাঝি 'ঘরে কিছু নেই' বলে খাবার-দাবার বন্ধ না করে দেয়।
সবাই যখন পরিবারের সাথে ছুটির আনন্দে মত্ত, তখন জীবিকার তাড়নায় এই ছুটে বেড়ানোর নামই 'খেপ'। এই খেপ যতটা না মন আর সেবার টানে, তার চেয়ে অনেক বেশি পেটের টানে, এটা বলাই বাহুল্য।
যা হোক, আমার খেপের স্থান রাজশাহী যাবার পথে। জ্যাম, এক্সিডেন্ট, এইসব চিন্তা করে বাসের চেয়ে ট্রেনটাই প্রেফার করি, অন্য অনেক বাঙ্গালির মতই। সেই ট্রেনের টিকেট কাটতে গিয়ে সম্মুখিন হতে হয় তুঘলকি কারবারের।
দুর্নীতির এক বিশাল সম্রাজ্য রেল স্টেশানের টিকেট কাউন্টার। উদাহারণ দিয়েই বলি।
যাত্রার পাঁচ দিন আগে গিয়েছি টিকেট কাটতে, আধ মাইল লম্বা লাইন। মেজাজ খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছি, সামনের দিকে হঠাত একজন লাইনে ঢুকে পরলো। আমি প্রতিবাদী মানুষ, চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘এই যে ভাই, মাঝখান দিয়ে ঢুকবেন না’।
আমার দেখাদেখি আরো দু-একজন বলে উঠলো, ‘ভাই বের হন, বের হন, আমরা কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি, আপনি মাঝখান থেকে ঢুকলেন কেন?!’ অবস্থা বেগতিক দেখে সেই লোক মানে মানে কেটে পড়লো। নিজের কাছে হিরো হয়ে গেলাম। একটু পরে দেখি এক চেংরা ছেলে ‘ফুস’ করে লাইনের মাঝে ঢুকে পড়লো। নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারলাম না, গটগট করে তার কাছে হেটে গিয়ে বললাম, 'ভাই, আপনার সমস্যা কি?' তার পেছনের গুন্ডা টাইপের বন্ধু ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠল, ‘আপনার কি সমস্যা? আমার ইচ্ছা আমি ওরে ঢুকাইসি, কি করবেন?’ সাহায্যের আশায় আশেপাশে তাকালাম। কিসের কি, যারা আগে সাপোর্ট করেছিল, তারা উলটো ঘুরে রইল।
একজন এক কাঠি বাড়া, আমার উদ্দেশ্যে উপদেশ ছুঁড়ে দিল, ‘ভাই, সব ব্যাপারে উত্তেজিত হওয়া ঠিক না। উনার হয়ত তাড়া আছে, কি আর এমন হবে…’ বেকুবের মত আমার জায়গায় ফেরত গেলাম, আমার পেছনের জন বললো, বের হয়েছেন তো হয়েছেন, এখন লাইনের শেষে দাঁড়ান। আমি কিছুক্ষন তার দিকে নির্বাক তাকিয়ে থেকে লাইনের শেষে এসে দাঁড়ালাম। ঘন্টাখানেক পর অবশেষে ‘মেরা নাম্বার আয়া’। আমি বিনীতভাবে কাউন্টারে বসে থাকা লোকটিকে ধুমকেতু এক্সপ্রেসের শুক্রবারের একটি এসি সিটের টিকেট দিতে বললাম।
তিনি তাচ্ছিল্যভরে বললেন, ‘টিকেট নাই’। এবং আমাকে সামনের কম্পিউটারের দিকে তাকাতে বললেন। দেখি সেখানে বড় বড় করে লেখা, ‘সিট খালি নাই’। আমি পুরাপুরি হতাশ হয়ে ফীরে আসব, এমন সময় এক ভদ্রলোক লাইনের তোয়াক্কা না করে কাউন্টারের সামনে এসে বললেন, ‘আরে রফিক ভাই, কেমন আছেন! আমাকে দুইটা টিকেট দেন, শুক্রবারের। কাউন্টারম্যান হাসতে হাসতে টিকেট দিয়ে দিল।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই কোথায় যাচ্ছেন?’ তিনি বললেন, ‘রাজশাহী’। আমি আবারো কিছুক্ষনের জন্য নির্বাক হয়ে গেলাম। তারপর কাউন্টারম্যান কে বললাম, ‘টিকেট নাই বললেন, কিন্তু উনাকে তো ঠিকই দিলেন?!’ তিনি নির্বিকারভাবে বললেন, ‘উনি আগে বুক দিয়ে গেছেন’। আমার সুক্ষ সন্দেহ হল। বললাম, ‘কিভাবে বুক দিব বলেন, আমি পরের সপ্তাহের জন্য বুক দিব।
’ তিনি বললেন, ‘পরিচিত না হলে বুক নেই না। ’
এর মধ্যে পেছনের লোকজন অস্থির হয়ে গেছে, আমাকে বারবার বলছে, ‘ভাই টিকেট না থাকলে কোথা থেকে দিবে? এখন সরেন, আমাদের নিতে দেন। ’ জীবনে আরো অনেকবারের মত নিজেকে বড় বেকুব মনে হল। চুপচাপ বেরিয়ে চলে এলাম। তবে আমার ঘাড়ের কয়েকটা রগ জন্মগতভাবে সোজা নয়, তাই এক কলিগ কে ধরে (তার আত্মীয় রেলওয়ে তে চাকরী করেন) সেই সপ্তাহের টিকেট বের করে নিলাম।
বলা বাহুল্য, কিছু বাড়তি খরচ হল, কিন্তু টিকেট পাওয়ার পর ‘কলিজা’ ঠান্ডা হল। মনে হল বিশাল এক প্রতিশোধ নিলাম।
যাত্রার দিন ট্রেনে উঠলাম, তারপর এসি কামরায় নির্দিষ্ট সীটে বসলাম। ট্রেন যখন ছাড়ল, দেখি ৩/৪ ভাগ সীট খালি। ভাবলাম পরের স্টেশান থেকে উঠবে, কিসের কি, পরের তিন স্টেশান থেকে উঠল দুইজন, টাঙ্গাইল স্টেশানে নেমে গেল ৫-৬ জন।
অবশেষে টিকেট চেকার এলে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই, ব্যাপার টা কি? লোকজন কই?’ সে এমন ভাবে আমার দিকে তাকালো, যেন এমন আহাম্মক জীবনে দেখেনাই। বলল, ‘আমি তো আল্লাহ না, আমি সামান্য টিকেট চেকার, লোক নাই কেন আমি কিভাবে বলবো?’ পাশে দাঁড়ানো তার চামচা বত্রিশ দাঁত বের করে হেসে দিল, যেন এত মজার কৌতুক আর শোনে নাই’। মনে মনে একটা গালি দিলাম, তারপর মৃদু হেসে বললাম, ‘কাউন্টারে তো টিকেট পাওয়া যায় না’। টিকেট চেকার বিরাট বিরক্ত হওয়ার ভান করল, যেন আমি তার বিশাল মূল্যবান সময় নষ্ট করছি, তারপর বলল, ‘স্টেশানে কম্পলেন করার জায়গা আছে, কম্পলেন জানিয়েন’, যেন আমি জানি না স্টেশানে কম্পলেন করার জায়গা থাকতে পারে। মনে মনে আরেকটা কুতসিত গালি দিয়ে সীটে বসে পড়লাম।
আমার গন্তব্যে পৌছানো পর্যন্ত বেশিরভাগ সীট খালী পড়ে রইল।
এই হলো আমাদের রেলগাড়ীর অবস্থা। এর সাথে জড়িত সবাই যেন শপথ করেছে যে রেলওয়ে কে কখনো লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিনত হতে দেবে না। টাকা না ঢাললে কোন কথা নেই। আরেক সপ্তাহের কথা, সীটে বসে আছি, আমার পাশের ভদ্রলোক তার পরিচিত কাউকে ফোন করে বলছে, ‘সালাম ভাই, সীট পাইসি, চিন্তা কইরেন না।
দাম ৫০ টাকা বেশী নিসে, তবে ভাল সীট দিসে, একদম জানলার পাশে’। আমি তাকে কিছু বলতে গিয়ে চুপ করে রইলাম। কাকে কি বলব? ৫০ টাকার জন্য যে কাউন্টারম্যান অজস্র যাত্রীকে ভোগায়, তারই বা বিবেক কেমন, আর যিনি ঘুষ দিয়ে টিকেট নিয়ে এই ভেবে খুশি যে তার জানালার পাশে সীট পড়েছে, তারই বা বিবেচনাবোধ কেমন…! সত্যি সেলুকাস, বিচিত্র এই দেশ, বিচিত্র এই দেশের মানুষ…।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।