আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শেরশাহের সড়কে একজন শাহ সুজা

হুজুগে বাঙ্গালী বলে কথা-আমি নিজেও সেই হুজুগে বাঙ্গালীর ভ্যানগার্ডদের একজন বলে আমার ধারনা এবং বিশ্বাস। এবার কিংবা প্রত্যেকবার ঈদের আগে দলে এবং বলে বাঙ্গালিরা ছুটে চলে গ্রামের দিকে। এর আবার একটা সুন্দর নাম আছে- নাড়ীর টানে। ফিরে যাই নাড়ির টানে। আমিও যাই নাড়ীর টানে! আমার অবশ্য ব্যাপারটা কিছুটা ভিন্ন।

আমাকে যেতেই হয়। কারন মফস্বলের বাড়িতে আমার মা থাকেন এবং ঈদ-চাঁদ ছাড়াও আমি যাই। এক বিরক্তিকর যাত্রার শেষে অপেক্ষা করে আমার জন্য বিভিন্ন দেশ-মহাদেশ-শহর-উপশহর থেকে আসা বন্ধুদের সাথে আড্ডা। পাড়ার মোড়ের দোকানের চা আর বিড়ি খাওয়া। মুরুব্বীদের দেখলে ঠিক আগের মতো সিগারেট কিছুটা লুকিয়ে রাখা।

একবার মজার ঘটনা ঘটেছিলোঃ ব্রজ স্যার আসতেছেন আর শিমুলের হাতে সিগারেট। তখন আমরা অলরেডী ইউনিতে ভর্তি হয়ে গেছি। শিমুল সিগারেট চালান করে দিলো প্যান্টের পকেটে। তখন পরতাম কিছুটা টাইট প্যান্ট। পকেট পুড়িয়ে সেই সিগারেট শিমুলের শরীরের পুড়িয়ে মাটিতে গিয়ে পড়লো।

আর শিমুল কিভাবে সহ্য করেছিলো; ভাবতেও অবাক লাগে। ফোস্কা ফুটেছিলো শিমুলের পায়ের উপরি অংশে। সন্ধ্যে নামার মুখে রিক্সা নিয়ে শহরের দক্ষিনে ঘুরতে যাওয়া। শহরের দক্ষিনের খালের কচুরীপানা আচ্ছাদিত রোগা চেহারা দেখে হা হুতাশ করা আপনমনে। প্রতিবছর-প্রতিমাসে-প্রতিদিন-প্রতিপলে-প্রতিমুহুর্তে পরিবর্তন হতে থাকা আমার শৈশবের শহর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা।

রাস্তায় হঠাত দেখা হয়ে যায় স্কুলের নীচের ক্লাশ কিংবা উপর ক্লাশের বন্ধু-বড় ভাই-ছোটভাইদের সাথে। কেউ খুব ব্যস্ত! কারো কোনো কাজ নেই। কেউ মুখে ছাপ দাঁড়ি-কারো লম্বা চুল-কারো ফ্রেঞ্চ কাট-কারো চোখে প্লাস-মাইনাস চশমার খেলা। যথারীতি চাঁনরাতে ঘুরাফেরা করা শহরে। টুক টাক কেনা কাটা।

আমি সব সময় গ্রামে যাবার সময় গদাই এবং লস্করী চালে যাই। অগ্রীম টিকেট কিনিনা। এমনো হয়েছে বাড়ী যাবার জন্য ৮ নাম্বার গাবতলীর বাসে চেপে বসেছি। (প্রায়শঃ ঈদের সময় ঢাকা শহরের ‘টাউন সার্ভিসের বাস’ গুলো নিম্ন আয়ের মানুষদেরকে নিয়ে মফস্বলের দিকে যাত্রা করে ) অর্থাৎ মানসিকভাবেই আমি ছুটির আমেজ এবং ইমেজে থাকি। ছুটিতে টেনশন করতে ভালো লাগেনা।

টেনশন করে ছুটি কাটানোর কোনো মানে হয়না। এবারো যথারীতি চট্টগ্রামের বাসে টিকেট কেটে উঠে গেলাম। সেদিন ২৮ রমজান। আমি চট্টগ্রাম যাবোনা। পথিমধ্যে নেমে যাবো।

কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছাড়াই চলে গেলাম আমাদের মফস্বল শহরের বাইপাসে। ঢাকাতে যে বাহনটাকে ময়ুরী বলে আমাদের ওইদিকে বলে টম টম নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে যাত্রা আর যথারীতি অসংখ্য ষ্টপেজ। হাত তুলতে তুলতে যাওয়া। কোথাও দাঁড়ানো। সন্ধ্যেয় আবার দেখা হবে বলে বিদায় নেওয়া।

মনে মনে খুব নিরাপদবোধ করা। আহা নিজের শিকড়ে এসেছি। এবারো তেমন কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। যথারীতি ঈদের আগের রাতে শহর দেখতে বের হলাম। দেখা হলো আড্ডা হলো অনেকের সাথে।

রাজনীতি-সমাজনীতি-ইউনুস-যুদ্ধাপরাধীদের বিচার থেকে শুরু করে জুলিয়ান এসেঞ্জ! কেউ বাদ যায়নি। সন্ধ্যের ঠিক মুখেই রিক্সা নিয়ে শৈশবের শহরে বের হলাম। দক্ষিনের সেই খাল। ক্ষীনতোয়া-কছুরীপানা। মনে হলো আদিতে মনে হয় নদী কিংবা খালের পারেই শহর-নগর-গঞ্জের জন্ম হতো আর তার অবশ্যাম্ভাবী পরিণতি হলো সেই নদী কিংবা খালের মৃত্যূ।

অর্থাত শহর যতো বড় হবে আমরা নাগরিকরা খুন করে ফেলবো কিংবা ফেলি কিংবা ফেলছি সেই নদী কিংবা খাল। ঢাকা শহরে উন্নয়নের ধাক্কায় এখন কোনো খাল নেই। আমার শহরেও তাই হচ্ছে। শহরের দক্ষিনের সেই সুফলা নামের লেক আর নেই। উন্নয়ন হচ্ছে।

ভরাট করে হকার মার্কেট করা হবে। জায়গা খুব মুল্যবান। উন্নয়ন চলছে- ভয়াবহ এলোপাথাড়ি উন্নয়ন। আমার সেই শান্ত শহরে এখন ঘুরে বেড়ায় জাপানী জীপ-বিলাসবহুল গাড়ী-সি এন জি ট্যাক্সি কিংবা টম টম। হচ্ছে শপিংমল।

ওশেন ব্লু কালারের গ্লাসের মার্কেট। ঈদের আগের রাতে রাস্তার মোড়ে চরম আড্ডায় বসে চোখ গেলো-রাস্তার পাশে সেই দীর্ঘদেহী পাকুড় গাছ কিংবা ধতুরা গাছটা আর নেই। লম্বা অশ্বত্থ গাছটাও নেই। আমাদের পাড়ার মুখের রাস্তাটা হলো শেরশাহের সেই বিখ্যাত ট্রাঙ্ক রোড। প্রায় ভাবতাম-আহা এইসব গাছগুলোতে শেরশাহের ছোঁয়া আছে।

এই সড়ক ধরেই শাহ সুজা পালিয়ে গিয়েছিলেন আরাকানে। মনে হতো সেই সন্ধা-গভীররাত-দুপুর-সকাল কিংবা বিকেলে দুঃখী চিন্তিত পরাজিত শাহ সুজা পালাচ্ছেন। কেটে ফেলা হয়েছে অনেক পুরানো দিনের স্বাক্ষী সেই সব গাছ-আরো কাটা হবে। কারন আমাদের উন্নয়নের দরকার। বেদম এবং ব্যাপক উন্নয়ন।

আমরা খুন করবো প্রকৃতি-নদী-গাছ; হাজারো মানুষের শৈশব কিংবা কৈশোরের ডালপালা কেটে ফেলবো। নিজেকে পলায়নপর শাহ সুজা মনে হচ্ছে। হ্যাপি ব্লগিং। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.