আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অবশেষে মায়ের আদরের খোকা, মায়ের কোলেই ফিরে গেলো।

সবুজের বুকে লাল, সেতো উড়বেই চিরকাল মায়ের সবচেয়ে ছোট আর আদরের খোকা ছিল সে। পৃথিবীর কঠিন বাস্তবতায় শিশু থেকে কিশোর, কিশোর থেকে যুবককে সে পরিণত হয়েছিল কঠিন জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়েই। অন্যান্য সব শিশুর মতই শিশুকালে তার খেলার বাসনা ছিল। ছিল না খেলার সরঞ্জাম। তাই সেই ছোট্ট বয়স থেকেই বা পাওয়ার বেদনাকে নিত্যসঙ্গি করেছিলেন তিনি।

বাবা আমাকে খেলনা কিনে দাও, আমাকে আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাও, বাবা আমাকে কোলে নাও বলে আবদার করার মত পিতাও গত হয়েছিলেন একবারে শিশুকালে। জীবনের সব চাওয়া পাওয়া ইচ্ছা বাসনাকে জলাঞ্জলি দিয়েই সে পরিণত হয়েছিল দিনে দিনে। একটাই আশা ছিল তার। মায়ের মুখে হাসি ফোটানো। বিধাতা এই পরম পরিশ্রমি মানুষটিকে আশাভঙ্গ হতে দেননি।

নামাজ শেষে চির গম্ভির মানুষটিকে দেখতাম দোয়ায় বসে অঝোরে কাঁদছেন। আচ্ছা পরিণত মানুষটি কি তখন শিশুতে পরিণত হয়ে মা কে খুজতেন। মায়ের কথা মনে হওয়াতে এক বুক বেদনায় তিনি নীলাদ্র হতেন? বাবা কেমন হয় তিনি জানতেন না। দেখেননি কোনদিনও। এর পরেও আমার জন্মের পর রাজপুত্রের মর্যাদায় কানের পাশে ফুকে দিয়েছিলেন পবিত্র আযান ধবনি।

আমার মুখের আবদারের ধবনির সাথে সাথেই জিনিস উপস্থিত। হয়তো তিনি যে না পাওয়ার বেদনায় ভুগেছিলেন, তার আচও যেন আমার গায়ে আর না লাগে সেজন্যই এমন আশকারা। মা অনেক রাগ করতেন। শিশুকালে খেলনা পেলেই আমার কাজ ছিল কিছুক্ষন সেটা নিয়ে খেলা। এর পর ভেঙ্গে টুকরা টুকরা করা।

পরক্ষনেই নতুন আবদার করার জন্য বাবার অপেক্ষায় থাকতাম। বাস্তবতার নিষ্ঠুরতায় প্রকৃতির কাছ থেকেই বেশিরভাগ পাঠ নিয়েছিলেন তিনি। দেশ বিদেশ নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে প্রচুর জানতেন। শ্রমিক হিসাবে জীবন শুরু করার কারণে জানতেন, বুঝতেন শ্রমিকদের দুঃখ কস্ট। নিজের ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানে হোক কিংবা গৃহ নির্মানে হোক, শ্রমিকদের প্রতিদিনের পাওনা পাই পাই করে মিটিয়ে দিতেন।

ব্যাবসায় ব্যাস্ত থাকলেও তাই বামপন্থি শ্রমিক আন্দোলনের সাথে একসময় খুব প্রচন্ড ভাবেই জড়িত ছিলেন। একারণে আইয়ুব খানের অত্যাচার আর্মির হাতে প্রচন্ড অত্যাচারেও শিকার হয়েছিলেন। তার কমরেডদের অনেকেই ছিল সাংবাদিক। বামপন্থি পত্রিকা দুটির সাথে তাদের অনেকেই জড়িত ছিল। তবে কোন রাজনৈতিক উচ্চাভিলাস তার ছিল না।

ছিল না পদের কোন মোহ। তাই তারই কমরেডরা যখন ক্ষমতা আর প্রভাবের লোভে দন্দে জড়িয়ে পড়েছিল, তিনি নিরবে তখন রাজনীতি থেকে প্রস্থান করেছিলেন। জীবনের প্রথম দিকে প্রচন্ড অর্থনৈতিক কস্টে বড় হয়েছিলেন বলেই খরচে ছিলেন অনেক হিসাবি। তবে দুস্থ মানবতার সেবায় বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করতেন না। সে গরিব আত্মিয়স্বজন বলুন, কিংবা পাড়া প্রতিবেশি অথবা হাক ডাক করা ভিক্ষুক, সাধ্য মত সবার জন্য তার দান ছিল উন্মুক্ত।

তার অবদানে গড়া একটা স্কুল আছে, মাদ্রাসা আছে, দুটি মসজিদও আছে। অথচ এ নিয়ে গর্ব করা বা প্রচার করা ছিল তার স্বভাব বিরুদ্ধ। মা কে নিয়ে আমরা সবাই গর্ব করি। আমাদের কাব্য, আমাদের গল্প সবই তো মা কে নিয়েই। অথচ আমাদের বাবাকে নিয়ে তেমন উচ্ছাস কই, গর্ব কই? একটা শিশুকে পরম মমতায় আচলে আপন দুগ্ধে মা বড় করেন।

অথচ পরম ভালোবাসায় আর নির্ভরতায় সেই মা যার উপর নির্ভরশীল, সেই মানুষটি কি বাবা নন? ঘরের বাইরে, রোদে পুড়ে ঘামে ভিজে, শীতে কেপে যে পুরুষ মানুষটি বাস্তবতার সব গলি ঘুপচি ঘুরে , সব ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করে, তার ভালোবাসার স্ত্রী আর সন্তানদের সুখের জন্য নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ হাসিমুখে উৎসর্গ করেন, তিনিই তো বাবা। পরম পিতা। যদি ঘরের অপ থেকে মা সন্তানদের আড়াল করে রাখেন, তাহলে বাবা তার সকল সত্ত্বা দিয়ে বাইরের আরো কঠিন বাস্তবতা থেকে সন্তানকে আগলে রাখেন। মায়ের হাতে প্রচুর মার খেয়েছি আমি। কখনও পড়াশুনার জন্য, কখনও খাওয়া দাওয়ার অনিয়মের জন্য, কখনও দুস্টুমির জন্য।

কিন্তু বাবা কোনদিন মারেননি। মনে হয় মাত্র একবার, তাও কোরান পড়ায় অমনযোগি হওয়াতে গাছের ডাল ভেঙ্গে একটা হাল্কা বাড়ি হয়েছিলেন। ব্যাস ! ওই পর্যন্তই। ছোটবেলা থেকে আমরা ভাই বোনেরা সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কোরান শিক্ষাও পেয়েছি। এব্যাপারে আমার বাবা মা ছিলেন অভিন্ন অবস্থানে।

তাই গৃহ শিক্ষকের সাথে সাথে আমাদের জন্য কোরান শিক্ষকেরও ব্যাবস্থা ছিল। তিনি খেতে ভালোবাসতেন। খেতেও পারতেন প্রচুর। খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে তিনি ছিলেন উদার হস্ত। খাওয়াতেনও প্রচুর পরিমানে।

একবার আমার বন্ধুরা এসেছিল। খাওয়া দাওয়ার পরিমান দেখে তাদের ভির্মি খাবার যোগার ! প্রায়ই দেখা যেতো মা দুপুরের রান্না শেষ করলেও পড়ন্ত বিকেলে বাজার থেকে ভালো মাছ বা মাংস কিনে আনতেন। সেটা রান্না হলে সেই সন্ধ্যায় দুপুরের খাবার খেয়ে এর পর যেন তার স্বস্তি হতো। আমার মায়ের হাতের রান্নায় তিনি এতই অভ্যস্থ ছিলেন যে, সাধারণ দাওয়াতে তিনি অংশ নিতেন না। আমাদের নিয়ে মা যেতেন, কিন্তু বাবার জন্য রান্না করে রেখে যেতে হতো।

তিনি যে শুধু খেতে বা খাওয়াতে ভালোবাসতেন, তেমন শুধু না। মোগলাই খাওয়ার রান্নায় তিনি মা কেও ছাড়িয়ে যেতেন। তাই মুলত শীতের দিন আসলেই আমরা ভাই বোনেরা আমরা আবদার করতাম। সেই আবদার রক্ষায় সেদিন তার অফিস কামাই। বেশ সময় লাগিয়ে তিনি যে রান্নাটা করতেন, আমি হলফ করে বলতে পারি, দেশ বিদেশের অনেক খাবার ভীড়েও সেটিই আমার কাছে অনন্য ছিল।

এই কারণে সব আত্মিয় স্বজনদের বিয়ে বা অনুষ্ঠানে খাদ্য বিষয়ক একমাত্র উপদেস্টাই ছিলেন আমার বাবা। আমার বা আমার পরিবারের বাকি সদস্যরা যে এত খেলা পাগল, তার মুল উৎসই ছিলেন বাবা। সেই পাকিস্থানি আমলে সেই সময়কার কলকাতা আই এফ শিল্ডে অংশ নেয়া ঢাকা ওয়ান্ডার্স ক্লাবের খেলা দেখতে তিনি কলকাতা পর্যন্ত গিয়েছিলেন। অবশ্য ব্যাবসায়িক কারণে কলকাতা তার কাছে কোন অজানা শহর ছিল না। আমি যেবার প্রথমবার কলকাতা যাই, তিনি সুন্দর করে ম্যাপ করে দিয়েছিলেন।

আমার বিন্দুমাত্র সমস্যা হয়নি। এমনই ছিল তার স্মরণশক্তি। শুধু তাই না। রেডিও তে যে এক সময় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বা কলকাতার মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গলের খেলার ধারা বিবরণি দেয়া হতো, বাবা খুব তন্ময় হয়ে সেগুলি শুনতেন। তখন কোনমতেই তাকে বিরক্ত করা যেতো না।

এর পর বাংলাদেশি ক্রিকেটের উত্থানে তার চোখ পড়ে থাকতো টিভিতে। বাংলাদেশের জয়ে চোখের জল আসতো, হারলে বেদনায় মুখ কালো হয়ে থাকতো। আর বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় রাত জাগা? সেতো অবশ্যাম্ভাবি। আমরা ভাইয়েরা বিকেলে ঘরে বসে থাকলে তিনি অসম্ভব রাগ করতেন। ধমক দিয়ে হলেও বাইরে পাঠাতেন খেলতে।

একারণে ফুটবল ক্রিকেট আর ব্যাডমিন্টনে আমাদের পারদর্শিতা বেশ ভালো ছিল। তিনি নিজে শুধু ব্যাডমিন্টন খেলতেন শীতের রাতগুলিতে। যেহেতু তিনি স্বচ্ছল ছিলেন, তাই ব্যাডমিন্টনের সাজ সরঞ্জামের কোন অভাব ছিল না। আপন বয়সি পাড়ার লোকজন তখন তার হাকডাকেই খেলা শুরু করেছিল। তারা এমন মজাই পেয়েছিল, যে অপেক্ষাকৃত নবীনদের খেলতে হতো, হয় তাদের খেলা শেষ হলে অথবা নতুন কোর্ট কেটে।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ঘাটতি থাকলেও, জীবন থেকে তিনি শিখেছিলেন প্রচুর। সেই আদ্যিকাল থেকেই পেপার পড়তেন। আমাদের ইংরেজি শিক্ষার সুবিধার জন্য বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি পত্রিকাও রাখা হতো। বই কেনার ব্যাপারেও তার কোন আপত্তি বা কার্পণ্য ছিল না। তাই মায়ের ভান্ডারে ছোটকাল থেকেই দেখতাম নিহারঞ্জন, শরৎচন্দ্র বংকিম, বনফুল, নিমাইদের বইয়ে ঠাসা।

পাশাপাশি সাপ্তাহিক-পাক্ষিক আর ঈদ বা পুজোসংখ্যার ছড়াছড়ি। প্রায় অবসরে যাবার পর বাবা অবশ্য কোরানের তফসির নিয়মিত পড়তেন। অনেক ছোটকাল থেকেই নিয়মিত নামাজ পড়তেন। তবে ঘুম পছন্দ বলে যবক বয়সে ফজরের নামাজটা কাযা হয়ে যেতো। পড়ে অবশ্য ৫ ওয়াক্তই মসজিদে আদায় করতেন তিনি।

আল্লার অনেক রহমতে পবিত্র হজ্বব্রতও পালন করে এসেছিলেন তিনি। যেহেতু আরবি পড়তে পারতেন না, তাই হয় আমাদের বা মায়ের মুখে কোরান পড়া শুনতে চাইতেন। বেশ অল্প বয়স থেকেই ব্যাবসা করতেন। আর আপন মেধার বদৌলতে ব্যাবসার নাড়ি নক্ষত্র গতি প্রকৃতি সবই খুব ভালোভাবে আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন তিনি। একারণেই ভারতীয় মাড়োয়ারিরা যতই প্যাচ কষুক না কেন, তাকে ফাদে ফেলতে পারেনি কোনদিন।

তার কাছ থেকে হাতে কলমে ব্যাবসা শিখে আমার কয়েক মামা এখন বেশ অবস্থাপন্ন। তবে ব্যাংক লোনের ব্যাপারে তার প্রচন্ড রকমের আপত্তি ছিল। সেখানে ঘুষ লেনদেন বা সুদ আদান প্রদান ইসলাম বিরোধি বলে তিনি ব্যাবসা করুন বা সম্পত্তি নির্মান, সবকিছু গাটের পয়সা দিয়েই করেছেন। ব্যাংকে জমানোর টাকার সুদ তিনি কোনদিন ঘরে আনতেন না। দরিদ্রদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন।

একবার বাংলা একাডেমি থেকে তার কাছে ঢাকার ইতিহাসের ব্যাপারে জানতে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন। তিনি তার কাছে জমানো সব ইতিহাসই বর্ণনা করেছিলেন। ভদরলোক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, রেফারেন্স হিসাবে তার নাম অবশ্যই থাকবে। পড়ে ব্যাস্ততার কারনে আর খোজ নেয়া হয়নি সেই ইতিহাসভিত্তিক পুস্তকের ব্যাপারে। আমরা ভাই বোনেরা যখন মায়ের সাথে খুনসুটি করতাম, তখন মনে হয় তার নিজের মায়ের কথা মনে হতো।

সদা গম্ভির এবং অত্যন্ত কম কথা বলা মানুষটার দুই চোখে কেমন জানি একটা অসহায়ত্ব মিশ্রিত কস্ট দেখতে পেতাম। এতিম সেই ছেলেটার সারা পৃথিবিই ছিল মা কে ঘিরে। এমন কি সদ্য বিবাহিত হলেও ঘরে ফিরে সবচেয়ে আগে মা বলে ডাকতেন। প্রথমেই খোজ খবর করতেন মায়ের। প্রতিদিনই আমার দাদির পছন্দের কোনকিছু এনে মাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিতেন।

আমার বাবার প্রবল প্রতাপে আমার চাচি ফুফু বা মায়ের কোনদিন স্পর্ধা হয়নি আমার দাদির কথার উপর কথা বলার । অবশ্য আমার মা এর পক্ষ্যে তেমন কিছু করা কোনদিন সম্ভবও ছিল না। কেননা তার এমন স্বভাব ছিল না, আর শাশুড়ি যে ছিলেন তারই খালা। মা গত হয়েছিলেন অনেক আগেই। এতগুলি বছর মায়ের অনেক অনেক আদরের খোকাটি মা হারানোর বেদনা বুকে চেপেই কাটিয়ে দিয়েছিলেন।

তাই এতদিন পর আবারও মায়ের বুকেই ফিরে গেলেন। ঘুমিয়ে থাকো খোকা। জগতের সব চাওয়া না পাওয়ার কস্ট থেকে মুক্ত হয়ে, একান্ত নিভৃতে নিশ্চিন্ত মনে মায়ের বুকে ঘুমিয়ে থাকো। (গত সোমবার আমার শ্রদ্ধেয় বাবা ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নাহ লিল্লাহে ওয়া ইন্না লিল্লাহে রাজেউন।

পারিবাহিক ঐতিহ্য অনুসারেই তাকে আজিমপুর কবরাস্থানে দাফন করা হয়েছে। সামুর সব পাঠক লেখকদের প্রতি আমার বাবার আত্মার মাগফেরাত কামনা করে দোয়ার জন্য বিশেষ অনুরোধ করছি। সবাইকে ধন্যবাদ। )  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।