[যার জন্যে আজ আমরা ব্লগিং করতে পারছি সেই আল্যান ম্যাথিসন ট্যুরিং(১৯১২-১৯৫৪) এর জন্মশতবর্ষএ তাকে শ্রদ্থা জানিয়ে আমার প্রথম পোস্ট । ]
বিশ্ববিখ্যাত জার্মান গণিতজ্ঞ ডেভিড হিলবার্ট (যিনি বলেছিলেন "তিনি যদি এক হাজার বছর পরে ঘুম থেকে উঠেন তবে তার প্রথম প্রশ্নই হবে Riemann hypothesis কি প্রমানিত হয়েছে ?") , যিনি কিনা কঠিন অঙ্ক কষার চেয়ে গণিতের ভিত নিয়ে চিন্তিত ছিলেন, সেই সূত্রে ১৯২৮ সালে পণ্ডিতদের উদ্দেশে ছুড়ে দিয়েছিলেন একটা প্রশ্ন। গণিতে সবসময় দাবির ছড়াছড়ি। ২+২=৪ ঠিক এটা যেমন একটা দাবি, তেমনই ২+২=৫ ভুল এটাও একটা দাবি। সত্যি ই কি গণিতে এমন কোনও নিয়মনীতি বা কৌশল কি আছে, যা অনুসরণ করে এগিয়ে গেলে স্পষ্ট ধরা পড়বে, কোনও দাবি ঠিক না ভুল? তাঁর বিখ্যাত পেপারে অ্যালান ম্যাথিসন ট্যুরিং প্রমাণ করলেন, তেমন কোনও কৌশল থাকতে পারে না।
গণিতের ভিত চুরমার করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট এই আবিষ্কারটি। টুরিং এর এই আবিস্কার সন্মন্ধে গণিতজ্ঞ চাটিন বলেছেন "...The limits of mathematics discovered by turing sound more serious more dangerous than the ones Godel found".
নাহ্, শুধু ওটুকু বললে ওই আবিষ্কারের ঠিক মূল্যায়ন হয় না। শুধু গণিতের ভিত ভেঙে ক্ষান্ত হলে ট্যুরিং বিখ্যাত হতেন কেবল পণ্ডিত মহলে। সীমাবদ্ধ থাকতেন কেতাবে, সেমিনারে। সারা পৃথিবীর কিছু থাকত না তাঁকে নিয়ে মাতামাতির।
জার্নালে ৩৬ পৃষ্ঠা জুড়ে ছাপা পেপারে ট্যুরিং যা বললেন, তা মূল্যবান হলেও, তার চেয়ে ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল, তিনি কী ভাবে তা বললেন। নিজের সিদ্ধান্তে পৌঁছতে ট্যুরিং টেনে আনলেন মানুষের গণনা কৌশলের মূল নির্যাস। সংখ্যা তো আসলে কতকগুলো কালির দাগ বা চিহ্ন। যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ করতে বসে আমাদের মস্তিষ্ক ওই চিহ্নগুলিকেই নাড়াচাড়া করে। কী ভাবে করে? প্রত্যেকটা পদক্ষেপকে ভেঙে ভেঙে, তা দেখিয়ে দিলেন ট্যুরিং।
এ বার মানুষের বদলে এক মেশিন কল্পনা করলেন তিনি। এবং দেখিয়ে দিলেন ওই মেশিন হুবহু নকল করতে পারে মানুষের গণনা কৌশল। শুধু তা-ই নয়, যে মেশিন কষতে পারে অঙ্ক, সে আবার খেলতে পারে দাবা। এক যন্ত্রে অনেক কাজ। ১৯৩৭ সালে ট্যুরিং-এর মনগড়া মেশিনই আজকের কম্পিউটারের ব্লু-প্রিন্ট।
"ক্যান মেশিনস থিংক?" এই প্রশ্ন তুলে শোরগোল ফেলেছিলেন ১৯৫০ সালে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা বুদ্ধিমান যন্ত্র নিয়ে আজ যে এত মাতামাতি বিশ্বজুড়ে, তার গুরু তো তিনিই। বলেছিলেন, ‘এমন দিন আসবে, যখন মহিলারা তাদের ছোট্ট কম্পিউটার সোনাকে নিয়ে বিকেলে বসবে পার্কের বেঞ্চে। আর এ ওকে বলবে, শুনুন দিদি, আমার এই বিচ্ছুটা আজ সকালে কী মজার কথা বলেছে। ’মানুষের মাথা কেমন করে যন্ত্রের মতো কাজ করে,কিম্বা যন্ত্র কিভাবে মানুষের মতো কাজ করবে তার ব্লু-প্রিন্ট তিনি সেই ১৯৩৭ সালেই দিয়ে গিয়েছিলেন ।
বিদ্যালয় এ থাকতে ট্যুরিংর কাছে গণিত সবচেয়ে মজার, কারণ তার নির্যাস হল যুক্তি। স্কুলের আই ডি কার্ডে স্বাক্ষর নেই। তা দেখে শিক্ষকের ধমক। অ্যালানের যুক্তি, ‘বাহ্ রে, কার্ডে যে স্পষ্ট নির্দেশ: ডোন্ট রাইট এনিথিং অন ইট। ’
কম্পিউটার নামের যে যন্ত্রটা অ্যাটলাসের মতো ঘাড়ে নিয়ে বসে আছে একবিংশ শতাব্দীর উন্নত পৃথিবী, তার ইতিহাস এত পুরনো, তার পিছনে অবদান এত জনের, যে বিশেষ কোনও এক জনকে তার জনক আখ্যা দেওয়া মুর্খামি।
তবু, মুখের মিছিলে ট্যুরিং কোথায়? প্রশ্নটার উত্তর দিয়েছেন প্রযুক্তির ঐতিহাসিক জর্জ ডাইসন। বলেছেন, ‘ডিজিটাল কম্পিউটারের ইতিহাসকে ভাগ করা যায় দুই পর্বে। ওল্ড টেস্টামেন্ট আর নিউ টেস্টামেন্ট। ১৬৭০-এর দশকে গটফ্রিড উইলহেলম লিবনিৎজ-এর নেতৃত্বে ওল্ড টেস্টামেন্টের দেবদূতেরা উপহার দিয়েছিলেন যুক্তি। আর ১৯৪০-এর দশকে জন ফন নয়ম্যানের নেতৃত্বে নিউ টেস্টামেন্টের দেবদূতেরা বানিয়েছিলেন মেশিন।
দুই যুগের পয়গম্বরদের মাঝে যিনি বিরাট ভূমিকায় দাঁড়িয়ে, তিনি হলেন অ্যালান ট্যুরিং। ’
এত বড় সেতুবন্ধে যিনি স্থপতি, তাঁর অবদান কেন প্রায় অজানা? দোষী অনেকটাই ট্যুরিং নিজে। ‘পাবলিশ-অর-পেরিশ’ যুগ তখনও আসেনি। গবেষকরা পড়িমরি করে জার্নালে পেপার ছাপতে দৌড়ন না। আর নিজের কৃতিত্বের ঢাক পেটানো থেকে দূরে থাকতে চান ট্যুরিং।
হায়, জনারণ্যে ট্যুরিং অখ্যাত থাকার মূলে কারণ যে আছে আরও। এবং তা যে ব্যক্তিগত ঔদাসীন্যের চেয়েও বড়। জীবনে ট্যুরিং যে পেয়েছিলেন এক ভয়ঙ্কর শাস্তি। সমাজের কশাঘাত। যার ফলে তিনি হয়ে গিয়েছিলেন ব্রাত্য।
আইনের চোখে, এমনকী, ঘৃণ্যও। সে কাহিনি এক বিষাদসিন্ধু। তার ট্র্যাজিক হিরো অন্য এক ট্যুরিং। এ বার তাঁর গল্প বলা যাক।
অকালমৃত্যুর পরেও যাঁর আত্মাকে জাগিয়ে তোলার স্বপ্ন দেখতেন ট্যুরিং, সেই ক্রিস্টোফার মরকম-এর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল কী রকম? জীবনীকার অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতজ্ঞ অ্যান্ড্রু হজেস মনে করেন, ওটা ট্যুরিং-এর জীবনে ‘প্রথম প্রেম’।
হ্যাঁ, সমকামী ছিলেন তিনি। একের পর এক পুরুষ সঙ্গী এসেছিল তাঁর জীবনে। ১৯৪০ বা ’৫০-এর দশকের ব্রিটেনে যা ঘৃণ্য। এবং দণ্ডনীয় অপরাধ। শাস্তি সত্যিই শেষমেশ পেলেন ট্যুরিং।
তদন্তকারী গোয়েন্দারা ভেবেছিলেন, তথ্য ফাঁসে ট্যুরিং মরে যাবেন লজ্জায়। তারা বিস্মিত। ট্যুরিং কণামাত্র লজ্জিত নন। মনে করেন না, তাঁর আচরণ গণ্য হতে পারে অপরাধ। গোয়েন্দাদের বরং বললেন, সমকামিতা আইনসিদ্ধ করার উদ্যোগ নিতে।
বার বার সাক্ষাতে ওরা যেন তাঁর বন্ধু। দু’এক বার ওদের বাজিয়ে শোনালেন বেহালা।
তিন সপ্তাহ পরে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে বিচার। কাগজে রেডিয়োয় খবর। ছুটে এলেন দাদা জন ট্যুরিং।
তিনি শোকাহত। মর্মাহত ট্যুরিংয়ের কিছু সহকর্মীও। তারা জানতেন না ওঁর ব্যক্তিগত জীবন। সবার এক পরামর্শ। নিজেকে অপরাধী ঘোষণা করুন ট্যুরিং।
প্রার্থনা করুন ক্ষমা। এ বারে ট্যুরিং মর্মাহত। কে বলল তিনি অপরাধী? অনুতপ্ত? এক বন্ধুকে চিঠিতে লিখলেন, ‘এমন এক সমস্যায় পড়েছি, যার সম্ভাবনা আমি চিরকাল ভেবেছি। যদিও মনে হত, তা সত্যি হওয়ার সুযোগ দশের মধ্যে এক। এক যুবকের সঙ্গে যৌন সম্পর্কের অভিযোগ আমি আদালতে স্বীকার করতে চলেছি।
কী ভাবে এটা জানাজানি হল, তা এক দীর্ঘ ও আকর্ষণীয় কাহিনি। যা নিয়ে এক দিন একটা ছোটগল্প লিখব, এখন তোমাকে বলার সময় নেই। এ সব থেকে নিঃসন্দেহে আমি বেরিয়ে আসব ভিন্ন এক মানুষ হিসেবে। কেমন মানুষ, তা অবশ্য বলতে পারছি না। ’
ম্যাজিস্ট্রেট ঘোষণা করলেন রায়।
শাস্তি হতে পারত জেল। তার বদলে তিনি দিলেন দাওয়াই। সমকামিতার ব্যাধি(!) সারাতে ট্যুরিংকে নিয়মিত নিতে হবে হরমোন ইনজেকশন। শুরু হল মর্মান্তিক প্রক্রিয়া। এবং প্রতিক্রিয়া।
সুঠামদেহী মানুষটা এ বার রীতিমত রোগা। দেহে নারীসুলভ অঙ্গের উঁকি। এ ছাড়াও মানসিক নির্যাতন। তাঁর পিছনে সর্বক্ষণ সাদা পোশাকে পুলিশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রুশ-মার্কিন ঠান্ডা লড়াই তুঙ্গে।
স্টেট সিক্রেট জানেন, এমন সমকামী মানুষেরা সর্বত্র সন্দেহের শিকার। কারণ, ফাঁদে ফেলে বিদেশি গুপ্তচরেরা নাকি ওদের থেকে সহজে হাতিয়ে নেয় তথ্য। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বুঝি ক্রমশ হয়ে উঠল সহ্যাতীত। এক দিন সকালে পরিচারিকা এসে দেখলেন, বিছানায় পড়ে আছে ট্যুরিংয়ের মৃতদেহ। পাশে রয়েছে কামড়ে-খাওয়া একটা আপেল।
যাতে মেশানো হয়েছিল পটাশিয়াম সায়নাইড। ৪১ বছর বয়সে মৃত্যু।
৮ জুন ১৯৫৪।
অ্যাপল কোম্পানির লোগো নিয়েও প্রশ্ন অনেকের। আপেলের ছবিটি কি ট্যুরিংকে কুর্নিশ জানাতে? কম্পিউটার-নির্মাতা সংস্থা অবশ্য উড়িয়ে দেয় সন্দেহ।
বলে, ওটা আইজাক নিউটন স্মরণে। তা হলে ওই আপেল একটু কামড়ে খাওয়া কেন? কীসের স্মরণে? ট্যুরিং? নাকি জ্ঞানবৃক্ষের ফল?
লন্ডন অলিম্পিক এর সময় হয়ত অনেকের তার কথা মনে পরেছিল । নিয়মিত দৌড়োতেন তিনি। অংশ নিতেন ম্যারাথন রেস-এ। অসুস্থ না হলে ১৯৪৮ সালের লন্ডন অলিম্পিক্সে ম্যারাথন দৌড়ে অবশ্যই ইংল্যান্ডের প্রতিনিধি হতেন ট্যুরিং।
তখন তাঁর ব্যক্তিগত রেকর্ড ২ ঘণ্টা ৪৬ মিনিট। সে বারে সোনাজয়ীর চেয়ে ১১ মিনিট পিছনে।
১৯৬৭ সালের পর থেকে ব্রিটেনে সমকামিতা আর অপরাধ নয়। ২০০৯ সালে দেশজুড়ে দাবি উঠেছিল, ১৯৫২ সালের রায়ের জন্য ব্রিটিশ সরকার ক্ষমা চাক। তা মেনেছিলেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন।
বলেছিলেন, ‘ওঁর প্রতি ঘোর অন্যায় আচরণ করেছিলাম আমরা। যা ঘটেছিল, তার জন্য আমি এবং আমরা যে গভীর দুঃখিত, তা বলার সুযোগ পেয়ে আমি খুশি। ’
[১৯৬৬ সালে তার নামে একটি পুরস্কার চালু হয় ,যা টুরিং অ্যাওয়ার্ড নাম বিখ্যাত । এটি কম্পিউটার সাইন্স এর জগতে নোবেল পুরস্কার এর সমতুল্য । এখন দুজন ভারতীয় উপমহাদেশীয় বিজ্ঞানী তা পেয়েছেন |মূল লেখাটি পথিক গুহ এর লেখা ,আমি শুধু কিছু তথ্য যোগ করে লেখাটিকে rearrange করেছি ] ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।