আমি সত্য জানতে চাই
(ঢাকার রাস্তায় তাজিয়া মিছিল)
আজ ১০ মোহররম, পবিত্র আশুরা। দিনটি পালনের জন্য পুরান ঢাকাসহ সকল শিয়া মুসলমানরা ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। শোকাবহ আশুরার মূল আনুষ্ঠানিকতায় নগরীতে বের হবে ঐতিহ্যবাহী তাজিয়া মিছিল। ‘হায় হোসেন, ‘হায় হোসেন’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হবে আকাশ। রীতি অনুযায়ী আশুরার তিনদিন আগে থেকেই পুরান ঢাকার চাঁনখারপুল এলাকায় অবস্থিত ‘হোসেনি দালান’-এ নানা আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে।
ইরাকের কারবালার প্রান্তরে নবী-দৌহিত্র হোসেন (রা.) সপরিবারে মূলত এদিন থেকেই অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। খাদ্য-পানীয় ইত্যাদির অবর্ণনীয় কষ্টে কেটেছে তাদের দিনগুলো। আর এ কারণে তার অনুসারীরা তিনদিন আগে থেকেই ত্যাগ ও মহিমায় ভাস্বর আশুরার আনুষ্ঠানিকতা পালন করে থাকেন।
(Battle of Karbala)
ইসলামী বর্ষ পরিক্রমার প্রথম মাস মহররমের ১০ তারিখকে প্রিয় নবী (সা.) আশুরা নামে অভিহিত করেছেন। এটি পবিত্র ও নিষিদ্ধ মাস।
এ মাসে যুদ্ধ নিষিদ্ধ। মুহাররম শব্দটি এসেছে আরবি ‘হারাম’ থেকে যার অর্থ মর্যাদাপূর্ণ, নিষিদ্ধ। এ মাসের ১০ তারিখকে বলা হয় আশুরা। আশুরা একটি আরবি শব্দ, যার সাহিত্যিক অর্থ ‘দশম’। ইসলামে বিশেষভাবে মুহাররমের দশম দিনকে আশুরা বলা হয় এবং এই দিনকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বিশেষ দিন বলা হয়।
ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে থেকেও অর্থাৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগে মুহাররম পালন করা হতো। ইসলামের পূর্বে আরবরা এই মাসে যুদ্ধ করাকে হারাম মনে করত। মুহাররম মাসে প্রথম ১০ দিন অন্যদিনগুলোর চেয়ে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ।
{Battling with the enemies)
বিশ্ব ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এই দিনে সংঘটিত হয়েছে। সেগুলো যুগে যুগে মুসলমানদের অস্তিত্বের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
মুসলমানরা বিশ্বাস করে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন মহররমের ১০ তারিখে। এ দিনেই তিনি তা ধ্বংস করবেন। এ দিনেই হজরত আদমের (আ.) সৃষ্টি, জান্নাতে প্রবেশ, পৃথিবীতে প্রেরণ ও আল্লাহতায়ালার দরবারে তার তওবা কবুল হয়। এ পবিত্র দিনে এইদিনে ইদ্রিস (আ.)-কে জীবিত অবস্থায় আকাশে তুলে নেয়া হয়, হজরত নূহের (আ.) তরী প্রবল তুফান ও প্রলয় থেকে রক্ষা পেয়ে তীরে ভিড়ে, দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে হজরত আইয়ুব (আ.) মুক্তিলাভ করেন। এ দিনে হজরত ইব্রাহিমের (আ.) নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে মুক্তিলাভ, মহান আল্লাহর সঙ্গে তুর পাহাড়ে হজরত মূসার (আ.) কথোপকথন, তাওরাত লাভ, সঙ্গী-সাথীসহ নীল দরিয়া পার এবং ফেরাউন ও তার বাহিনীর নীল দরিয়ায় সলিল সমাধির ঘটনা ঘটে।
হজরত ইউনূসের (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি, হজরত ঈসা (আ.) সশরীরে ঊর্ধ্বগমন ইত্যাদি বহু ধর্মীয় ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল আশুরাতেই। আশুরা অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণে মানবজাতির কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে।
(Imam Hussain (A) at battle)
হিজরি ৬১ সালের এই দিনে হুসাইন (রা.) মহানবী (সা.)-এর দৌহিত্র কারবালার প্রান্তরে তার পরিবার, সন্তান ও সৈন্যসামন্তসহ মুয়াবিয়ার পুত্র ইয়াযিদেও সেনাবাহিনীর হাতে শাহাদাৎ বরণ করেন। এ দিনে ফোরাত নদীর তীরে ঐতিহাসিক কারবালা প্রান্তরে যে হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে, তা গোটা মুসলিম জাহানকে শোকে-বেদনায় স্তব্ধ করে দিয়েছিল।
(Zul-Janah [The Winged] returning without his master)
কারবালা প্রান্তরে নৃশংস ঘটনা যখন ঘটে, তখন মুসলিম জাহানে চরম অরাজকতা চলছিল।
ইসলামের চার খলিফার স্বর্ণযুগ তখন অতীত। মুয়াবিয়াপুত্র ইয়াজিদ তখন রাজতন্ত্র ও পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর। প্রিয় নবীর (সা.) দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) এ অন্যায় মেনে নিতে পারেননি। ন্যায় ও সত্যের পতাকা সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে সুদৃঢ় শপথ নিতে তিনি ইয়াজিদের বিরুদ্ধে এক অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। সে যুদ্ধ ছিল অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার।
ইয়াজিদ যুদ্ধের সব রীতিনীতি ভেঙে হত্যা উৎসবে মেতে ওঠে। কারবালা প্রান্তরে পরিবার-পরিজন ও সহযোদ্ধাদের সঙ্গে নির্মমভাবে শহীদ হন রাসূল দৌহিত্র। সত্যের পথে অসীম সাহসী বীর হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) এবং তার স্বজন ও সহযোদ্ধারা মৃত্যু অবধারিত জেনেও আপসহীন যুদ্ধ করে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। ইয়াজিদ বাহিনী ফোরাতের তীর অবরুদ্ধ করে দিনের পর দিন একবিন্দু পানিও পান করতে না দিয়ে ইমাম হোসাইন (রা.) ও তার সহযোদ্ধাদের নিদারুণ কষ্ট দিয়েছে। পিপাসায় কাতর হয়ে অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন।
কিন্তু ইসলামের মহান শিক্ষা ও ঈমানের পথ থেকে তারা মুহূর্তের জন্য বিচ্যুত হননি। আশুরার এ দিনটি মূলত মুসলমানদের কাছে কারবালার সে দুঃসহ স্মৃতিই বহন করে আনে। তাই আশুরা দিনটি শোকের তাৎপর্যে মহিমান্বি হয়ে আছে। মহররম মাস এলেই কারবালার সেই বেদনামথিত স্মৃতিতে প্রতিটি মুসলমানের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। বিশ্বের সকল মুসলিম এই দিনে হুসাইল (রা.)-এর ত্যাগের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।
(কারবালায় মহররমের শোক মিছিল)
ইসলামের প্রাথমিক যুগে মহানবী (সা.) যখন ইসলাম প্রচার করতেন তখন নবী ও তার অনুসারীদের ওপর অমানবিক নির্যাতন করা হতো। মক্কার লোকজনদের অত্যাচারের মাত্রা এত বেড়ে গেল যে, আল্লাহর নির্দেশে মুসলিমরা মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করে তাদের ধর্মীয় উদ্দেশ্য সফল করতেন। এর থেকে হিজরি মাস শুরু হয় এবং হিজরি প্রথম মাস মুহাররম। তাই মুসলমানরা এই মাসটিকে খুব সম্মান করে। তারা আল্লাহর নির্দেশিত মাসকে প্রতিবছর সম্মানের সাথে পালন করে।
আমাদের প্রিয়নবী হযরত (সা.) আশুরা সম্পর্কে বলেছেন "আশুরার দিন আকাশ, পৃথিবী ও কলম সৃষ্টি হয়। এ দিনে সাতটি বেহেশত সৃষ্টি হয়। এই দিনে আল্লাহ লাওহি মাহফুজ সৃষ্টি করেন। হাশর বসবে মুহাররম মাসেই। এ মাসে কিয়ামত হবে।
রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পূর্বে রোজা ওয়াজিব হয় এ মাসে। এ মাসে কাবা শরীফকে সাজানো হয়। এ মাসে প্রথম আকাশ থেকে বৃষ্টি পড়ে। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন-‘আশুরার দিন কাবা শরীফকে সাজানো হয়’ (মুসলিম, আবু দাউদ) পবিত্র আশুরার দিন শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্যই নয়, এটি আরো দুটো ধর্মের অনুসারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যেমন- ইহুদী ও খৃস্টান।
যেমন-হযরত মুসা (আ.)-কে ফেরাউনের অত্যাচান থেকে আল্লাহপাক রক্ষা করেছেন। তাই এ দিনের প্রতি সম্মান দেখাতে ইহুদীরা রোজা রাখে।
(ঢাকায় মহররমের শোক মিছিল)
আরব সমাজে হযরত আদম (আ.)-এর সময় থেকে আশুরা পালিত হয়। রমজান মাসে রোজা ফরয হওয়ার পূর্বে এ মাসে রোজা ওয়াজিব হয়। আমাদের প্রিয় নবী (সা.) আশুরায় রোজা রাখার বিষয়টি অনেক গুরুত্ব দেন।
তিনি নিজে রোজা রাখতেন এবং অন্যদেরকেও রোজা রাখতে বলতেন। যখন রমজান মাসে রোজার বিধান আল্লাহর তরফ থেকে আসল তখন তিনি এ মাসে রোজা রাখা ছেড়ে দিলেন এবং আশুরার রোজা রাখা তখন ঐচ্ছিক ব্যাপার হয়ে গেল।
ইসলামে আশুরার দিন রোজা রাখা ফরজ নয়। এটি আমাদের নবীজীর সুন্নাহ। তবে ইহুদীরা যেভাবে করতেন সেভাবে নয়।
ইহুদীরা শুধুমাত্র আশুরার দিন রোজা রাখতেন অর্থাৎ ১০ই মুহাররম, কিন্তু ইসলাম দুই অথবা তিনদিন রোজা রাখতেন বলে। এটা হতে পারে ৯ ও ১০ই মুহাররম অথবা ১০ ও ১১ই মুহাররম।
(শিয়া সম্প্রদায়ের মহররমের মাতম)
আশুরা আমাদেরকে ত্যাগের আদর্শ শেখায়। হুসাইন (রা.) পূর্ণ ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য পরিবারসহ জীবন উৎসর্গ করার মধ্যে দিয়ে আমাদের কাছে ত্যাগের আদর্শ রেখে গেছেন। এই আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে পারলে সুসমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
এ মাসে যুদ্ধ নির্ষিদ্ধ অর্থাৎ সব রকমের হানাহানি, হিংসা, বিদ্বেষ সবকিছু থেকে সমাজকে রক্ষা করতে হবে। এবং সমাজে ইসলামের আলো পৌঁছিয়ে দিতে হবে।
(শিয়া সম্প্রদায়ের মহররমের মাতম)
শোকাবহ এই দিনকে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে পালনের নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। মাতমের নামে বিশৃংখলা সৃষ্টি কিংবা উৎসবমুখর মিছিল কারবালার সেই আত্মত্যাগ ও আদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ন্যায় প্রতিষ্ঠার কঠিন সংগ্রামে অসীম সাহসের সঙ্গে আপসহীন লড়াই করে কিভাবে প্রয়োজনে আত্মবিসর্জন দিতে হয়, সে শিক্ষা আমরা লাভ করতে পারি কারবালার মর্মন্তুদ ঘটনা থেকে।
আজ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মানুষ লোভ ও হিংসার আগুনে জ্বলছে। মানবতা বিপন্ন। মুষ্টিমেয় মানুষের লোভের কাছে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর শান্তিতে বেঁচে থাকার আকাঙ্খা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে।
(ইসরাইলের বোমা হামলায় নিহত বোনের লাশ ধরে ডেকে চলেছে এই অবুঝ শিশু)
ইসরাইলীদের বর্বরোচিত বোমা হামলায় ঝলসে যাচ্ছে ফিলিস্তানী নিস্পাপ শিশুর শরীর। এ সময় কারবালার মহান আদর্শে আমরা উজ্জীবিত হতে পারি।
ন্যায়ের প্রতি অবিচল নিষ্ঠাই মানুষকে মুক্তি দিতে পারে সব অন্যায় ও অশান্তি থেকে। পবিত্র আশুরায় তাই প্রার্থনা সত্যের উজ্জ্বল আলোয় দূর হোক মিথ্যার কালিমা। জয় হোক ন্যায় ও সত্যের।
সূত্রঃ New world Encyclopedia
১। Battle of Karbala
২।
The Story of Karbala in Pictures
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।