আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সোহানার ডায়েরীঃ ভয়ঙ্কর নেশায় আসক্ত অন্তুর সাথে আমার বিচ্ছেদ।

১৫ই মে দুপুর ২টা বাজে এখন ও আসার কোন নাম নাই সুমনাটার । আশ্চার্য সেই ১ টা ১৫ থেকে বসে আছি। এই ভাবে একটা মেয়েকি একা কোথাও এতক্ষন দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে পারে। আক্কেল টাক্কেল কি দিন দিন হারিয়ে ফেলতেছে নাকি মেয়েটা। এই দিকে যারাই এই বাস স্ট্যান্ডের সামনে দিয়ে যাচ্ছে তারাই কি আড় চোখে তাকাচ্ছে।

মনে হয় জীবনে কোনদিন মেয়ে মানুষ দেখেনি। যতসব বজ্জাতের হাড্ডি মেয়ে দেখলেই খাই খাই ভাব। ভাবখানা এমন যেন এমন সুজোগ পেলে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। বলি বদমাসগুলোর ঘরে বুঝি কোন মেয়ে মানুষ নাই নাকি। কোন নারীর গর্ভেও জন্মায় নি, যেন হটাৎ করে আকাশ থেকে টুক করে পড়ছে।

একটু আগে দুইটা বজ্জাত ছেলে শিষ মারতে মারতে এসে বলে কত চাই আমি? অদ্ভুত ব্যাপার বাসস্ট্যান্ডে দাড়িয়ে থাকলেই বুঝি একটা মেয়ের জাত, সমাজ, পরিচয় সব বদলে যায়। তার আগে একটা এসে গায়ে পড়ে কথা বলার চস্টা করছিল। কোন উত্তর না দেওয়াতে বিড় বিড় করে কি যেন বলতে বলতে চলে গেল। বলি তোদের মা বোনরা কি বাস স্ট্যান্ডে না দাঁড়িয়ে গাড়ীতে উঠে রে, যতসব স্টুপিডের দল। আবার ঘড়ির দিকে তাকালাম।

দুপুর ২টা ১৫ বাজে। আজ আসুক ফাজিলটা। গুনে গুনে পাঁচটা কিল মারব। আরেক দিন আমিও ইচ্ছা করে দেরী করে এসে বুঝি দেব একা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার মজাটা। অদ্ভুত সব ভাবনা আমার মাথায় ঘুর পাক খাচ্ছে।

এমন সময় শুনতে পেলাম কে যেন ডাকছে “এই সোহানা, এই সোহানা”। পিছনে ঘুরতেই দেখি নুপুরকে। একি কি হয়েছে মেয়েটার চেহারা। চোখের নিচে কাল দাগ, শরীরে মেদ জমেছে, উস্কখুস্কো চুলে পাকন ধরেছে। কোলে ছোট একটি বাচ্চা মেয়ে।

-কি রে কেমন আছস? আমি ভাল। তুই কেমন আছস নুপুর? -ভাল। কি জন্যে এখানে দাড়াইছস? কোথাও যাবি নাকি? এই ত আমার এক বান্ধবীর জন্যে অপেক্ষা করেতছি। একটু মার্কেটে যাব। তা তুই একা কেন? ভাইয়া আসে নাই? -তোর ভাইয়ারে তো দেখতে যাইতেছি।

কোথায়? -জেলে। কেন? জেলে কেন? -তোর ভাইয়ারে দুইমাস হল পুলিশ ধইরা নিয়া জেলে আটকে রাখছে। কেন কি করছে ভাইয়া? -সে অনেক কথা। খুব ভুল করছি রে জীবনে অল্প বয়সে বিয়ে করে। শুভ বিয়ের আগে থেকে নেশায় আসক্ত ছিল।

শুভর বাবার অনেক জমিজিরাত তাই বাবা মা ভাবছিল অইখানে বিয়ে হলে আমি শান্তিতে থাকব। তাই নেশায় আসক্ত জেনেও সবাই আমরে ওইখানে বিয়ে দিছে। বিয়ের সময় আমারে বুঝাইছে বিয়ে হলে ও নাকি ঠিক হয়ে যাইব। তারপর কি হইছে বল? -তারপর আর কি বিয়ের পর কিছু দিন ভাল ছিল তারপর আবার শুরু করে। এই নিয়া তিনবার পুলিশ ওরে আটক করে আসর থেকে।

তিন মাস জেল খেটে আরপর জামিনে বের হয়ে আসে। বিয়ের পর যখন দেখলি এই অবস্থা তখন ডিভোর্স দিলি না কেন? -ডিভোর্স দিব কিভাবে বল? বিয়ের পর প্রথম যখন ও আবার নেশা শুরু করে তখন আমি ৬ মাসের প্রেগ্নন্যান্ট। আর এখন তো তিনটা বাচ্চা হয়ে গেছে। তিইইইনটা বাচ্চা তোর! বলস কি! তোর বিয়ে হইছে মাত্র চার বছর হইছে এর মধ্যে তিনটা বাচ্চা! -আমি কি করমু বল। সারা দিন বাসার বাহিরে থাকে।

গভীর রাতে ফিরে। এসেই আমার উপর ঝাপিয়ে পড়ে। পিরিয়ড শুরু হইছে না করছি কিছু করতে না , তবুও শুনে নাই। তা ভাইয়া নাই এখন তুই কিভাবে চলস? -এই আর কি চলে যায়। তোর ভাইয়ার ভাগে যা কিছু জায়গা জমিন পাইছিল বেশির ভাগ তোর ভাইয়া ব্যবসা লস কইরা যে ঋন করছে তা শোধ করতে বিক্রি করে ফেলছে।

সর্বশেষ যে জমিটা বিক্রি করছিল তার টাকাটা সাথে নিয়া তোর ভাইয়া নেশা আসরে গেছিল পুলিশ ভাবছে সেটা ডাকাতির টাকা তাই ধইরা নিয়ে গেছে। ও ওওওও যাক তুই ভেঙ্গে পড়িস না। সব ঠিক হয়ে যাইব। -শোন একটা কথা বলি বিয়ে আগে ভাল করে জেনে নিবি ছেলে নেশা করে কিনা। দরকার হলে ডাক্তারী রিপোর্ট দেইখা নিবি।

-যাক অনেক কথা বললাম। আমার গাড়ী চলে আসছে। কারাগারে যাইতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয় রাস্তায়। হ তোর অনেক দেরী হয়ে গেছে। এই গাড়ীটাতে উঠে চলে যা।

আর ভাল থাকিস । ধৈর্য ধর, সব ঠিক হয়ে যাবে। -শোন শেষ একটা কথা বলি তোর ক্লাসমেট হয়ে। আমার মত ভুল করিস না, আগে পড়ালেখা চালিয়ে নিবি। তারপর বিয়ে করিস।

পড়ালেখা না জানলে মেয়েদের অনেক বিপদ। -দেখ আমার যদি পড়ালেখা থাকত তাহলে কি এত বিপদে পড়তাম। অন্তত একটা চাকরী করে তো পেটের খাবার জোগাড় করতে পারতাম। -যাক আমি যাইরে। ভাল থাকিস।

নুপুর চলে গেল। আমি নির্বাক চোখে তার চলে দেখলাম। কিছুক্ষনের জন্য আমি যেন হিতাহিত জ্ঞানশুন্য হলাম। মনে করতে চেস্টা করছি চার বছর আগের দিনগুলোর কথা। তখন ক্লাস টেনে পড়ি আমি আর নুপুর।

নুপুর দেখতে অনেক সুন্দরী ছিল। এই জন্য রাস্তায় ছেলেরা ওকে অনেক উত্যক্ত করত। বিকেল বেলা কিছু ছেলে ওদের বাসার সামনে ঘুরঘুর করত। সেই সময় আসলাম নামে এলাকার এক উঠতি বয়সের গুন্ডা ছেলে ওকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল। ও তা প্রত্যাখান করে দেওয়াতে ছেলেটা ওকে অপহরন করার চেস্টা করেছে।

ভয়ে তার বাবা স্কুলে নুপুরের যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। পরবর্তীতে তাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য পাত্র খোজা শুরু করলে শুভদের বাড়ী থেকে প্রস্তাব আসে এবং শেষ পর্যন্ত সেখানেই বিয়ে হয়। নুপুরের জন্য আমার এখন খুব খারাপ লাগছে। কি হবে মেয়েটার বাকি জীবনে? কি তার ভবিষ্যত? কি হবে তার সন্তানগুলোর ভবিষ্যত? নুপুরের কথা চিন্তা চিন্তা করতে করতে ক্রমেই ভুলে যেতে লাগলাম দীর্ঘ সময় সুমনার জন্য অপেক্ষার কস্টটা। এমন সময় কে যেন আমার কাধে হাত রাখল।

বুঝতে অসুবিধা হলনা ওটা যে সুমনার হাত ছিল। -সরি দোস্ত। তোরে অনেক কশ্ট দিছি। অনেক্ষন দাড়া করিয়ে রাখছি। আসলে রাস্তায় বের হতেই কাক দিছে আমার কাপড় নস্ট করে দিছে।

কি আর করব বাসায় ফিরে গিয়ে জামা চেঞ্জ করে আসছি। তার উপর কোন রিক্সা পাই নাই। ওকে বাদ দে। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে তবে এমন আর করিস না। এখন চল নিউ মার্কেটের দিকে যেতে হবে।

পরশু দিন অন্তুর জন্ম দিন। ওর জন্য কিছু গিফট কিনতে হবে। -ও তাই নাকি। পরশু দিন অন্তুর তাইলে জন্মদিন। -বাহ চমৎকার।

-তাহলে তোর জন্য খুব স্পেশাল দিন হবে পরশু দিন -সম্পর্ক শুরুর পর এটাই অন্তুর প্রথন জন্মদিন তাই নারে দোস্ত। -তবে দোস্ত তোর সাথে আমার কিছু কথা ছিল। চল যেতে যেতে বাসে বলব। বাসে উঠে আমি জানলার পাশে বসলাম। কিছুতেই মাথা থেকে নুপুরের চেহারাটা সরাতে পারছি না।

এই দিকে সুমনা সমানে বকবক করেই যাচ্ছে। কিন্তু তার কিছুই আমার মাথায় ঢুকছে না। খালি মাথা নাড়িয়ে সুমনা কে সায় জানিয়ে যাচ্ছি। এরি মধ্যে দুইটি বাসস্টপেজ চলে গেছে। কিছু লোক নেমে গিয়ে নতুন কিছু যাত্রী উঠেছে।

হঠাৎ সুমনার একটি কথায় আমি সম্বিত ফিরে পেলাম। কি? কি বললি তুই? অন্তুর কি ইইছে? আবির স্যার কি বলছে? -না মানে তুই শুনলে কস্ট পাবি তাই আগে বলি নাই। অন্তুকে আবির স্যার আগে থেকেই পড়ান। সেই দিন নাকি অন্তু মদ খেয়ে মাতাল হয়ে আবির স্যারের কাছে পড়তে গেছে। পরে সেখানে অনেক বমি করছে।

-স্যার আমাকে জানাল যে অন্তু নাকি কলেজের কিছু বাজে ছেলেদের সাথে মেলামেশা করে করে নেশায় ঢুকে গেছে। তবে সে যখন তোর সামনে আসে তখন একেবারে স্বাভাবিক ভাবেই আসে তাই তুই কিছু বুঝতে পারস না। সুমনার কথাগুলো আমার কানে এসে তীরের মত বিধল। কি অন্তু নেশা শুরু করেছে। বিশ্বাস করতে কস্ট হচ্ছে আমার অন্তু নেশা ধরেছে।

চোখের সামনে আবারও ভেসে উঠল নুপুরের মুখ। আমি নুপুরের পাশে দাঁড়িয়ে। দুইজনে বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। কারাগারের দিকে যাব আমরা দুই জন নেশা আসক্ত লোকের সাথে দেখা করতে। আবারও ভাবনায় ছেদ বাসের হেল্পারের ডাকে -“নিউ মার্কেট, নিউ মার্কেট সবাই নামেন” -তাড়াতাড়ি নামেন সবাই,বাস ঘুরব।

এমন সময় কিঞ্ছিত ধাক্কা দিল সুমনা। -কিরে কি ভাবস, নামবি না নাম, নিউ মার্কেট আইসা পড়ছে । নামতে যাব এমন সময় কি যে হল বসে গেলাম আগের সিটেই। ফের সুমনার প্রশ্ন -কিরে নামবি না? না নামব না। আসার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে।

আজ থেকে অন্তু আমার জীবনে অতীত। চল এই বাসেই বাসায় ফিরে যাব। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।