দেখলাম সে কাঁদছে। তার কান্নাটা ছিল নিরব কান্না। আমার শত ব্যস্ততার কারণে আমি আজ এতো দিন খেয়াল করিনি। আসলে এটা আমার দোষ যে, আমি খেয়াল করতে পারিনি। আর সে তো আমারই সন্তান।
আমার কাছ থেকে সে আর কতদিন নিজেকে লুকিয়ে রাখবে। তাকে তো আমার সামনে আসতেই হবে। আমি তো তার নাড়ী-নক্ষত্র সবই জানি। সে কি করে। কেন করে।
পথ চলতে যেয়ে তার কোথায়-কোথায় বেঁধে যায়। সে কি ভুল বলে। আমি সবই জানি। তার মনের খবরটাও আমি জানি।
আমি ইদানিং বুঝতে পারছি যে, সে একটা অভাব বোধ করছে।
তার এখন একটা জিনিস অতীব প্রয়োজন। আর সেই জিনিসটা হচ্ছে তার মতো করে ভাবে, তার মতো করে দেখে, আর তার মতো করে মনে মনে গান করে এমন একটা মানুষ। যার কাছে সে ভুল করবে, যার কাছে সে রাগ করবে, গান করবে, ভান করবে। আর তার জন্য সে মাঝে-মধ্যে বকাও খাবে তার কাছে। আমার ধারনা, সে এখনও পর্যন্ত জানে না যে এর ভেতরে ভালো লাগার যে ব্যাপারটা আছে তাকে কি বলে।
আমি তাকে অবশ্য এব্যাপারে কিছুই বলিনি। আর বলবোও না। কারণ, বলে দিলে যে সে লজ্জা পেয়ে লাল হয়ে যাবে। আর তার ভেতরে যে প্রকৃতির মায়াজাল বিছিয়ে আছে তাতে খানিকটা হয়তো কৃত্রিমতার ছোঁয়া লাগবে। অবশ্য আমি ঐ কৃত্রিম ব্যাপারটাকে সাংঘাতিকভাবে ভয় পাই।
কারণ, সেটা যন্ত্র তুললো ঐ রোবটগুলো মাঝেই শোভা পাই। আর আমি তো এই প্রকৃতির সৃষ্টি সেরা জীব, মানুষ।
যাইহোক, আমি তাই তাকে বলিনি। সে তার মতো করেই তার মনের প্রকৃতিটাকে সাজাক না। ছন্দে ছন্দে মনে মনে বলি -
বকা খেতে বেশ ভালো লাগে,
সেটা নিজের ঐ বিবেকের মাঝে,
মনটা যেন তাই সুন্দর সাজে,
ঠোঁটের কোণে এক মিষ্টি লাজে।
বসে নাকোন মন কোন কাজে,
সময়টা এটে যায় স্মৃতির ভাজে,
মুখে বলে সে, কেউ না যে,
ভালোবাসা ভাব আছে এরই মাঝে।
আমি তাকে একদিন হাসতে দেখলাম। আমার ভালো লাগলো। আমাকে সে বলল, আমি আজ আনন্দিত, আমার না মনের ভেতরে গান বাজছে। আজ নাকি রিক্সায় করে বাড়ি আসার সময় সে ধানক্ষেতের মাঝে বাতাসে তোলা এক আনন্দের বন্যা দেখেছে।
ধানগাছের মাথাগুলো নড়াচড়া নাকি তারও মনের মাঝে দোলা সৃষ্টি করেছে। সে আমার দিকে তাকিয়ে একটা নিষ্পাপ হাসি দিল। আর আমি তাকে ভালভাবে খেয়াল করলাম। কিন্তু কিছু বললাম না। শুধু আমার চোখের, আর ঠোঁটের মিষ্টি হাসিটা তাকে দিলাম।
আর আমার ভুরু দুটি উঁচিয়ে তাকে অনেক বড় করে দিলাম। আমি যেন বুঝেও না বোঝার এক ভান করলাম। সে বিদায় নিলো। আমার মনটাকে ভালো করে দিয়ে।
তারপর আমি যখন আমার অফিসে গেলাম।
আমি যে দিকেই তাকায় সে দিকেই আনন্দের বন্যা দেখি। আর আমি যেখানেই আমার হাতটা দেই সেখানেই সোনা ফলে যায়। আমার প্রতিবেশী আমার সন্তানের প্রশংসা করে। আমি যেন তার সব গুনগুলোর মালিক। ভালো লাগে আমার।
তারপর হঠাৎ একদিন আমি দেখি যে, সে এক বিষন্ন চেহারা নিয়ে আমার টেবিলের পাশে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমার খারাপ লাগলো। একটা কালোমেঘ আমার মনের মাঝে জমতে শুরু করলো। আমি আজ জানি যে তার কি হয়েছে। আমি যে সে, আর সে যে আমি।
সে যে আমার সন্তান।
আজ তাকে আমি বোঝাবো। আমি আর তার প্রকৃতির ঐ ঝড়-বৃষ্টি দেখতে পারছি না। তার প্রকৃতিটা এই ঝড়ের তাণ্ডবে আমার সামনে চিরদিনের মতো ধ্বংস হয়ে যাবে, আমি তা কখনোই মেনে নেবো না। আমার সন্তানের জন্য আজ আমার খুবই কষ্ট হচ্ছে।
তাকে এই সময় বাঁচানোটা যে আমার জন্য ফরজ। আর সে না বাঁচলে আমিও তো আর বাঁচবো না। তাকে আমি বোঝালাম যে, এই পৃথিবীটা কতো কঠিন। মানুষ কতোটা খারাপ হতে পারে। নরপশুর হিংস্রতা ঐ হিংস্র পশুর থেকেও যে হাজার গুন বেশি।
সে তার লাল-লাল দুটো চক্ষু নিয়ে আমার সামনে এসে দাড়ালো। তার চোখের পাঁপড়ি গুলো ভেজা। আমি তাকে বলতে শুরু করলাম। সে আমার কথা শুনলো। কিছু হয়তো বুঝলো।
সে ধীরে ধীরে ঐ বাস্তবতাটা কে চিনলো। শিখলো কিভাবে প্রতিকুল পরিবেশের মাঝেও নিজেকে ভালো রাখতে হয়। আর সবার কাছে বিশ্বাসের মূল্যটা অনেক বেশি। যে এই বিশ্বাসকে ভেঙ্গে দেয়, সে যতো বড়ই হোক না কেন, সে আজ যার বিশ্বাসটাকে ভেঙ্গে দিয়েছে তার সামনে এলে দুর্বল হয়ে যায়।
আমি বললাম, ঝড়ের পর আশে সাহায্য।
আসে ভালোবাসা। ভালোবাসার মানুষটি তখন সব সময়ই পাশে পাশে থাকে। এতে করে ভালোবাসাটা বাড়ে। ভালোবাসাটা কে চিনতে সহজ হয় তখন।
তার মনে যে ঝড় উঠেছিল, তার তীব্র যন্ত্রণা আমি তার মাঝে দেখেছিলাম।
সেগুলির জন্য দায়ী ছিল সেই ভালোবাসার মানুষটিরই কথার আঘাত। কিছু ভুল বোঝা-বুঝি। আরও ছিল মতের মিল-অমিল। তাই সে কেঁদেছিল। ছোট বাচ্চার মতো করে আমার সামনে সে কেঁদেছিল।
আমি অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। বলেছিলাম, দেখ আমাদের মন চাই শুধু ভালোবাসা। আর তাই সে তাকে খোঁজে। সে খুঁজতে যেয়ে ভুল করে। হোঁচট খাই।
আবার ভুল বোঝে। আর তারপর সেই বেদনার সময়টা আসে। সে কষ্টে থাকে। এক সময় সে তার দিকটাকেই দোষী ভাবে। আর তখনই তার সেই ভুল ধরিয়ে দেবার জন্য, তার সেই ভুলধরা মানুষটিকে ভালোবাসতে থাকে।
তাই সে বকা খেতেও ভালোবাসে। তার প্রিয়জনের কাছে ছোট ছোট ভুল বা দুষ্টুমি করতে ভালোবাসে।
আমার দিকে এবার সে হাসিমাখা এক লজ্জা-লজ্জা ভাব নিয়ে তাকিয়ে আছে। আমিও তার দিকে তাকিয়ে লজ্জা পেলাম। আমি তাকে অনেক অনেক ভালোবাসি।
সে আয়নাতে তৈরি হওয়া আমার এক প্রতিবিম্ব। সে যে আমার বিবেক। আর তার সাহায্যেই যে আমি আমার সেই লেখাগুলো রাত জেগে লিখি। তারাই যে আমার সন্তান। যারা আমার আসে পাশে ঘোরা ফেরা করে।
মনে মনে।
ভালোবাসাই ভালো থাকুক তারা।
-সমাপ্ত-
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।