বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখ দ্বিতীয় বিদ্যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “শাওন গগণে ঘোর ঘনঘটা / নিশীথ য়ামিনী (যামিনী) রে / কুঞ্জপথে, সখি, কৈসে যাওব / অবলা কামিনী রে...” গানটা শুনেনি এমন বাঙলা-ভাষী মানুষ সম্ভবত খুব একটা পাওয়া যাবে না। অনেকের মতো আমারও ধারণা ছিলো রবি গুরুর গানটা বুঝি হিন্দি ভাষায় লেখা। পরে হুমায়ুন আজাদের “লাল নীল দীপাবলি” পড়ে জানতে পারি ব্রজবুলি’র কথা। গানটা যে ভাষায় লেখা হয়েছিলো সেটাই হলো “ব্রজবুলি”।
রবীন্দ্রনাথ বাল্যকালে এই ভাষাতে লিখেছেন। তিনি “ভানুসিংহ” ছদ্মনাম নিয়ে যেই “ভানুসিংহের পদাবলী” লিখেছিলেন, সেটাও ছিলো এই ব্রজবুলিতেই। ভানুসিংহের পদাবলীতে ব্রজবুলিতে লিখিত ২০টি পদ আছে।
বর্তমান ভারতের উত্তর বিহারের তিরহূত জেলা ও দক্ষিন নেপালের জনকপুর মিলে ছিলো প্রাচীন রাজ্য “বিদেহ”, রাজ্যের রাজধানী “মিথিলা”। বিদেহ রাজ্যের রাজা শিবসিংহের রাজসভার মহাকবি ছিলেন “বিদ্যাপতি”।
এই বিদ্যাপতি-ই ব্রজবুলির সূচনা করেন। বাঙলায় মুসলমান রাজাদের শাসন শুরু হলেও মিথিলায় হিন্দু রাজাদের শাসন অব্যাহত ছিলো। শুরু থেকেই মৈথেলি পণ্ডিতগণ ন্যায় ও স্মৃতি শাস্ত্রের চর্চায় খুব প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। মিথিলা’র ভাষা কিন্তু বাঙলা ছিলো না, তাদের ভাষা “মৈথেলি”, বিদ্যাপতি যে ভাষাতে কাব্য রচনা করতেন তাতে মৈথেলি ছিলো, সংস্কৃত ছিলো। আর তার কাব্যে ছিলো মনিপুরি সুর।
সেইসময় বাঙলা থেকে ছাত্ররা মিথিলায় জ্ঞানার্জনের জন্য যেতো। ছাত্ররা মিথিলার কবিদের, বিশেষ করে বিদ্যাপতির সুমধুর পদাবলি গুলো মুখস্থ করে এসে বাঙলায় প্রচার করতো। পরবর্তীতে বাঙলার কবিগণ বিদ্যাপতির পদাবলিতে আকৃষ্ট হয়ে বাঙলা, সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষা মিশিয়ে কাব্য রচনা করেছেন। মিশিয়ে বলতে সব ভাষার জগাখিচুড়ি না, এই ভাষাগুলোর মিষ্টি শব্দগুলোকে নিয়ে। এটাই ব্রজবুলির উৎপত্তির ইতিহাস।
রাধা-কৃষ্ণ, সনাথ-ব্রজমন্ডলের লীলা বিবরণের ভাষা বলে একে বলা হয় ব্রজবুলি। ভাষাবিদগণ ব্রজবুলিকে বাংলার উপভাষা বলে দাবী করেছেন।
ব্রজবুলির প্রচলন যারা করেন তাদের বাঙলা ভাষার উপর অধিকার ছিলো অনেক বেশি। তারা বাঙলা ভাষার কঠিন কঠিন শব্দ বাদ দিয়ে যেগুলো ছিলো মনোহর, মায়াবী, সেগুলো বেঁছে নিয়েছিলেন। বৈষ্ণব পদাবলির কবি গোবিন্দদাস ও বিদ্যাপতি ব্রজবুলি ভাষায় পদ রচনা করেছেন।
গোবিন্দদাসের কয়েকটি পঙক্তিঃ
যাঁহা যাঁহা নিকসয়ে তনু তনু জ্যোতি।
তাঁহা তাঁহা বিজুরি চমকময় হোতি॥
যাঁহা যাঁহা অরুণচল চল চলই।
তাঁহা তাঁহা থল-কমল-দল খলই॥
কথাগুলো আমাদের অপরিচিত, গোবিন্দদাস কী বলতে চেয়েছেন তা আমরা সাধারণত বুঝবো না। কবি এখানে রাধা’র বর্ণনা দিয়েছেন। রাধা যে খুব সুন্দর আমরা তা সবাই জানি, কবি এখানে সেই সৌন্দর্যের বর্ণনা করেছেন।
রাধা তার সখীদের সাথে যাচ্ছে, কবি বলেছেন, রাধার শরীর থেকে যেখানে ছলকে পরেছে সৌন্দর্য, সেখানে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। যেখানে রাধা রাখছে তার আলতা রাঙানো পা, সেখানেই য্যানো রাধার পা থেকে ঝরে পরছে স্থলপদ্মের লাল পাপড়ি। কী সুন্দর বর্ণনা!
মহাকবি বিদ্যাপতি’র একটা পদ দেখিঃ
হাথক দরপণ মাথক ফুল।
নয়নক অঞ্জন মুখন তাম্বুল॥
হৃদয়ক মৃদমগ গীমক হার।
দেহক সরবস গেহক সার॥
পাখীক পাখ মীনক পানি।
জীবক জীবন হাম তুহু জানি॥
তুহু কৈসে মাধব কহ তুহু মোয়।
বিদ্যাপতি কহ দুঁহু দোঁহা হোয়॥
রাধা নিজের কাছে জানতে চাইছে কৃষ্ণ তার কে হয়? তখন ভাবতে বসে রাধার মনে হয়, কৃষ্ণ তার হাতের আয়না, যাতে সে নিজেকে দেখে থাকে। তারপর মনে হয় কৃষ্ণ তার মাথার ফুল, যা তার শোভা বাড়িয়ে দেয়। তারপর বলতে থাকে তুমি আমার চোখের কাজল, মুখের লাল পান।
তুমি আমার হৃদয়ের সৌরভ, গ্রীবার অলঙ্কার।
তুমি আমার শরীরের সর্বস্ব, আমার গৃহের সার। ।
পাখির য্যামন পাখা থাকে এবং মাছের য্যামন পানি।
তুমি ঠিক তেমনি আমার, আমি তেমনি জানি। ।
এতো ভেবেও তৃপ্ত হয় না রাধা, তখন কৃষ্ণকেই জিজ্ঞেস করে তুমি আমার কে? তার উত্তর দেন বিদ্যাপতি নিজে, বলেন “তোমরা দুইজন অভিন্ন”। মধু মধু!
বৈষ্ণব কবিতাগুলোর বিষয় ছিলো রাধা-কৃষ্ণ’র ভালোবাসা। কবিতাগুলো আকারে ছোট হলেও ছিলো ভাব-রসপূর্ন। ব্রজবুলির মধ্যমণি বিদ্যাপতি, প্রাচীন বাঙলার প্রথম ব্রজবুলি পদ রচনা করেন যশোরাজ খান, প্রথম উড়িয়া ব্রজবুলি পদ রচনা করেন রামানন্দ রায় আর প্রথম অসমীয়া ব্রজবুলি পদ রচনা করেন শঙ্কর দেব। ব্রজবুলিতে পদ রচনা অব্যাহত ছিলো ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত।
সম্ভবত ব্রজবুলিতে শেষ পদ রচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার ভানুসিংহের পদাবলী থেকেঃ
মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যামসমান।
মেঘবরণ তুঝ, মেঘজটাজূট,
রক্তকমলকর, রক্ত‐অধরপুট,
তাপবিমোচন করুণ কোর তব
মৃত্যু‐অমৃত করে দান॥
আকুল রাধা‐রিঝ অতি জরজর,
ঝরই নয়নদউ অনুখন ঝরঝর—
তুঁহুঁ মম মাধব, তুঁহুঁ মম দোসর,
তুঁহুঁ মম তাপ ঘুচাও।
মরণ, তু আও রে আও॥
সূত্রঃ
উইকিপিডিয়া, লাল নীল দীপাবলি – হুমায়ুন আজাদ। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।