এক হাতে বড় ভাইয়ার ক্লিপ বোর্ড (যেই বস্তুর উপর খাতা ক্লিপ দিয়ে আটকে নিয়ে তারপর লিখতে হয়..... কি কাহিনী!!), তাতে কায়দা করে আটকানো ছোটো পেন্সিল বক্স, তার ভেতর পেন্সিল, ইরেজার, শার্পনার এবং ব্যাকআপ পেন্সিল, ব্যাকআপ ইরেজার, ব্যাকআপ শার্পনার। আরেক হাতে শক্ত করে ধরা আম্মুর হাত। দুজনের চোখেই দুশ্চিন্তার স্পষ্ট ছায়া। আম্মুর দুশ্চিন্তার কারণ, আজকে আমার স্কুল ভর্তি পরীক্ষা এবং তখনও জগত সংসারের প্রতি উদাসীন কীর্তি কাণ্ড দিয়ে আমি যথারীতি তাকে আশংকিত ও আতঙ্কিত করে রাখছি। আর আমার দুশ্চিন্তা, এখানে এতো মানুষ কেন? কি হবে আজ এখানে?!
আমার বড় ভাই ঐ স্কুলেরই ছাত্র, সেই সুত্রে আম্মুর পরিচিত একজন আয়া আদর সহিত আমাকে জায়গা মতো পৌঁছে দিল।
স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য অত্যাবশ্যকীয় প্রস্তুতি (হাতে খড়ি, মৌখিক ঝাড়ি, মাথায় বাড়ি ও পিঠে ছড়ি) সবগুলোই পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকা সত্ত্বেও অপরিচিত পরিবেশে আতংকে মাথা ‘আউলায়ে’ গেলো। চোখের সামনে পরীক্ষার খাতা ঘোলা হয়ে যাচ্ছে একটু পরপর। হঠাৎ মাথায় এক সহৃদয় হাতের ছোঁয়া! তাকিয়ে দেখি, যে দুজন ম্যাডাম গার্ড দিচ্ছিলেন, তাদের একজন। আমার রসগোল্লা মার্কা গাল (I am not even a little bit of proud for that) টিপে দিয়ে অন্য ম্যাডামকে ডেকে বললেন, ‘আপা, জানেন নাকি, এইটা আমাদের রুমী'র ছোটো ভাই! কিউট না!!’ সেই ম্যাডামও আমার দিকে তাকিয়ে মধুর হাসি দেয়াতে আমি একজন popular বড় ভাই (ভাইয়া আবার মারাত্মক কিউট ছিল, যাকে বলে একদম ‘মারদাঙ্গা’!!) থাকার উপকারিতা এবং নিজের cuteness নিয়ে ‘confidence খাইয়া’ গেলাম!
আদরে নাকি মানুষ বাঁদর হয়, তাই আমিও বিনাবাক্য ব্যয়-এ বাঁদরে পরিণত হলাম। শুধু তাই না, সুবোধ বাঁদরের মতো তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে, বাঁশের মাথায় উঠে গম্ভীর মুখে ম্যাডামকে বললাম, ‘ম্যাম, আমি আর লিখব না!’ দুজনের কেউই বোধ হয় এমন পরিস্থিতিতে আগে পড়েননি, প্রাথমিক হতচকিত ভাব কাটিয়ে উঠতে সময় লাগলেও পরে তারা আমাকে ‘যা ইচ্ছা’ লিখার জন্য রাজি করাতে সক্ষম হন।
আমি তখন সন্তুষ্টচিত্তে খাতার পিছনে আমার শিল্পী প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে মগ্ন হয়ে পড়ি (একটা বাড়ি with দুই জানালা & এক দরজা, বাড়ির পিছনে কলা গাছ, পাশেই নদী, তাতে পদ্মা সেতু সাইজের এক পালতোলা নৌকা এবং নদীতে অর্ধনিমজ্জিত সূর্য)। পাঠকদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি, স্কুলে সেবার ২২ জন ছাত্র নেয়া হয়, আমি ছিলাম ২২তম (তখন থেকে আমি আমার শিল্পী প্রতিভার ব্যাপারেও পুরা ‘confidence খাইয়া’ গেলাম!)।
স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর প্রথমবারের মতো আমার জীবন এলোমেলো হয়ে গেলো। ‘এলোমেলো’ টা স্পষ্ট হলোনা, একদম যেন পকেটে রাখা হেডফোনের তারের মতো ‘গিট্টু’ লেগে গেলো! স্কুলের কিছুই আমার পছন্দ হলনা, ছুটির ঘণ্টাটা ছাড়া। ফলাফল, প্রতিদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে এক রহস্যময় পেট / মাথা ব্যাথায় আক্রান্ত হতাম আমি।
কোঁকাতে কোঁকাতে কাকুতি মিনতি চলতো স্কুলে না যাওয়ার জন্য। অনুমতি পেয়ে গেলেই ব্যাথাটা উধাও হয়ে যেতো, কি তাজ্জব! অবশ্য, আব্বু-আম্মু কিছুদিন পরেই রহস্যটা ভেদ করে ফেলে এবং অর্ধচন্দ্র সহ স্কুলে পাঠানো শুরু হয়। আমি অবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার করলাম একবার স্কুলে চলে আসলে ব্যাথাটা ভগ্ন হৃদয়ে ভালো হয়ে যায়!!!
একদিন বন্ধুত্ব এসে ছুঁয়ে দিল ছোটো ছোটো আমাদের কয়েকজনকে। শাওন, বাপ্পি, শুভ্র, নিশু, আফেন্দি, রবীন্দ্র, ডিউ, অভি, হামিম আরো কতো বন্ধু আমার! যমের মতো ভয় পেতাম প্রিন্সিপাল ম্যাডামকে। স্যার-ম্যাডামদের আদর আর শাসন তখন পুরোপুরি না বুঝলেও, এখন বুঝি।
একটা গোয়েন্দা দল ছিল আমাদের! বেশিরভাগ কেস যদিও ছিল টিফিন চুরি অথবা চুলে চুইংগাম লাগানো বিষয়ক কিন্তু তাতে আমাদের উত্তেজনার কোন কমতি থাকতো না। স্টিলের স্কেল হাতে নিয়ে সন্দেহভাজনদের জেরা পর্যন্ত করতাম আমরা!!!
সেই ঝাপসা স্মৃতিগুলো এখন বড়ো দামী আর আপন। কিন্ডারগার্টেন স্কুল ছেড়ে হাই স্কুলে ওঠার খুশিতে পুরানো পরিচয় ঝেড়ে ফেলতে তখন তেমন কষ্ট লাগেনি, আর কতোটুকু বয়সই বা ছিল তখন, বুঝিনি কিছুই। এখন বুঝি সেই সহজ শৈশব আর শর্তবিহীন বন্ধুত্বের মর্ম, এখন বুঝি কেন স্কুলে যাওয়ার সময় আর কোনোদিন পেট / মাথা ব্যাথা করেনি আমার।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।