"বাবারা এইহানে এট্টু বস্তাখান রাখি?"
তাকিয়ে দেখি সত্তর-পছাত্তর বয়স হবে এক বৃদ্ধ হাসিখুসি মুখ নিয়ে আগ্রহের সাথে তাকিয়ে আছে। এক বন্ধুর বিয়েতে গিয়েছিলাম রাজশাহীতে। বিয়ে সেরে বাড়ি ফিরছি। বরযাত্রীর সাথে নাটোর এসে ট্রেন মিস করে চড়েছি ১টা লোকাল ট্রেনে। সেই ট্রেন প্রতিটা ষ্টেশনে থামে আর ড্রাইভার সাহেব ইন্জিন বন্ধ করে সবাই মিলে প্লাটফর্মে নেমে চা-বিড়ি খায়।
আরে ভাই ইন্জিনটা চালু রাখলে তো তাও একটু মনের ভিতর আশা থাকে এই বোধহয় ট্রেন ছাড়বে! যাইহোক, আমি ষ্টেশন গুনছি আর প্রকৃতি দেখছি ট্রেনের জানালা দিয়ে। রাত সারে-আট টার মত বাজে। ট্রেনে চড়েছি সেই বিকেল সারে পাঁচটায়। নাটোর থেকে পার্বতিপুর, ছোটোবেলা যেখানে কেটেছে, আমার প্রিয় শহর, যেখানে যেতে লাগে তিন-সারে তিন ঘন্টা, ইতিমধ্যেই তিন ঘন্টা হয়ে গেছে ট্রেন এখনও দশ নম্বর ষ্টেশন আক্কেলপুর।
"তেমন কিছু নাইবারে! এই হাল্কা জিনিসপত্তর"
পলিথিনের একটা সাদা বস্তা দেখিয়ে বলে বুড়ো মানুষটা।
বস্তাটা সিটের উপরে বান্কারে রাখতে চায়।
"জ্বী চাচা, রাখেন"
আমিও বস্তাটা ধরে বান্কারে রাখতে একটু হাত লাগাই। মনে হল হাড়িপাতিল জাতীয় কিছু জিনিস।
"এইহানে বসি?"
আমার পাশের ফাকা সিটটি দেখিয়ে বলে-
"বসেন"
"কদ্দুর যাবে বাবা তোমরা?"
"আমি পার্বতিপুর, আপনি?" জিগ্গাসা করি
"চিলাহাটি" হাসিমুখে বলে বৃদ্ধ
ট্রেনের লাষ্ট স্টপেজ, বাংলাদেশের শেষ মাথা। ট্রেনের যে অবস্হা তাতে চিলাহাটি যেতে মোটামুটি রাত তিনটা- চারটা বাজার কথা।
"চিলাহাটি পৌছাতে কতক্ষন লাগবে চাচা?"
"তা বাবা ট্রেন রাইট টাইম হলি সকাল ৬-৭ টা তো বাজবিই। এই মনে কর পার্বতিপুর পৌছাল বারটা-একটা, তারপর ডাইভার এ্যাটেনডেন সব মিলি ১টা ঘুম দিবি। আবার ছারবে মনে কর তিনটা- চারটা। চিলাহাটি পৌছতে পৌছতে সকাল। "
"বস্তায় কি হাড়িপাতিল নাকি চাচা?"
"হ বাবা! শীতের মোসুম আইছেনা? খেজুরের গাছ কাটা যাচ্চি"
বুড়োর কন্ঠে উৎসাহ।
বুজলাম খেজুরের গাছ কাটা মানে খেজুরের গাছ কেটে রস বের করা। চোখের সামনে ভেসে উঠল দুই ঘারে করে দুটো কলস নিয়ে রস বেচা বৃদ্ধের ছবি। এখন মাঝে মাঝে বাসায় আসে। বিশেষ করে মফস্বল শহরে দেখা যায়। কিন্ত ইনি যে একটু বেশিই বৃদ্ধ! ইনি খেজুরের গাছে চরে কিভাবে আর ঘারে করে রস বেচেই বা কিভাবে?
"আপনি খেজুরের গাছ কাটেন?"
"হ! কাটিত।
আজ ছাপ্পান্ন বৎসর হল খেজুরের গাছ কাটি হামি"
"তো চিলাহাটি কেন? এইখানে গাছ নাই?"
"ঐহানে যে গাছ বেশি! আর ঐহানেই হামি আগে থাকে কাটি। "
"ও আচ্ছা" মাথা দোলাই আমি
"হামরা গ্রামের ৫৩ জন আছি। হেইযে শীতের সম আইছে না? এহন সবাই হামরা একএকজন একাক এলাকাত যাই। "
"আপনি কি সবসময় চিলাহাটিই যান?অন্য কোথাও যান না?"
বুড়োর সাথে কথা বলতে ভালই লাগছে। কেন যেন একটা অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছে।
আমি নিজেই বুজতে পারছি না!
"না!"
"গাছ কার?" জিগ্গাসা করি।
"বাগানের মালিকের"
"তো এইযে আপনি প্রতিবার চিলাহাটি যান, যদি একবাবর গিয়ে দেখেন বাগানের মালিক গাছ অন্যজন কে দিয়ে দিয়েছে? তখন?"
"দেবে নাতো!"
"কেন?"
"বাবা তালে বলি শোন" বুড়ো ধৈর্য হারায় না "হামরা প্রত্যেকবার যাই, যা্য়ে বাগানের মালিকোক মোসুম শেষে টাকা দিই। অন্য মানুষেক দিলে যদি টাকা না দেয়? আমি ঐ গাছগুলান অনেকদিন ধইরে কাটি। হামাক ছাড়া কাউকে দিবিনা। " বুড়োর কন্ঠে আত্ববিশ্বাস।
"তো আপনি কত করে দেন গাছ প্রতি?"
"এই ধর একশ- দুইশ"
"একশ- দুইশ কি ১টা গাছের জন্য প্রতি মৌসুমে?"
"হ"
"১টা গাছ থেকে কি প্রতি দিন রস পাওয়া যায়?"
"নাহ! এই ধর ১টা গাছ ২-৩দিন পর পর কাটি। এরমভাবে ঘুরায়ে ঘুরায়ে গাছ কাটি। "
"প্রতি দিন মোটামুটি কত লিটার রস পান?"
"তা মন খানেক তো হবেই"
চল্লিশ সের এ একমন। গ্রামের হিসাব একসের মানে এক কেজির কিছু সামান্য কিছু কম।
"মনখানেক রস আপনি একা ঘারে করে বেচেন?" অবাক কন্ঠে বলি! আমার এখন বিশ্বাস হচ্ছিল না যে এই বুড়ো এই বয়সে গাছে চড়তে পারে!
"নাহ! ঠিক এরম নাহ।
এক জাগাত বসাই, ওহানে বেচা শ্যাস হলি পরে আবার আর একজাগাত নিয়া যাই এরম ভাবে। "
"তো এত গুলো রস বয়ে নিয়ে যেতে কষ্ট হয় না?"
"তাতো এট্টু কষ্ট হয়ই" বুড়ো মলিন মুখে হাসে, আমি বিব্রত বোধ করি।
প্রতি গেলাস পাঁচটাকা করে বেচেন?"
হ! যখন যেমন পাই! কেউ আবার ধর পিঠা করবে, ১জগ রস নিল। কেউ পায়েস করে, কেউ এমনি খায়। "
"তারী হয় না?"
আামাদের সামনের সিটের এক ভদ্রলোক জিগ্গাসা করে।
ভদ্রলোকের সাথে আগেই আলাপ হয়েছে। কথায় কথায় পরিচয় হল। বললাম সরকারী চাকুরী করি। উনি ডিফেন্স এ আছেন। ফুলবারী, আমার বাসার আগের স্টপেজ এ নামবেন।
আমি ট্রেনে ওঠার সাথে সাথেই দেখছিলাম উনি বেশ শুদ্ধ ভাষায় আশেপাশের সবাইকে কি জানি বোঝানোর চেষ্টা করছেন। সম্ভবত উনাকে কোন টীচার ট্রেনে উঠার সময় বেয়াদোপ বলে গালি দিয়েছেন। উনিও ছাড়েননি। উত্তপ্ত বাকবিতন্ডা হয়েছে। টীচার তার মেয়ে সহ ছিল।
সম্ভবত নেমে গেছে। ভদ্রলোক সবাইকে চা খাওয়াচ্ছেন আর বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে সময় কম ছিল বলে তিনি তাদের কে ঠান্ডা মাথায় বোঝানোর সুজোগ পাননি। এজন্য তিনি তাৎহ্মনিক কড়া উ্ত্তর দিয়েছেন। জ্ঞানের আলোকে বোঝাতে পারলে খুব ভাল হত। চা খেয়ে আশেপাশের লোকজন ও বেশ পামপট্টি দিচ্ছে।
তিনিও বলছেন হ্য়ত তিনি মহাপুরুষ হলে হ্মমার দৃষ্টিতে দেখতেন। কিন্তু তিনি মহাপরুষ না হতে পারেন। কিন্তু পুরুষ! এজন্য তিনি এরকম করেছেন।
" না বাবা। ওডাতো নেশার জিনিস! ওডা হয় না ওখানে"
" আমাদের ওখানে হ্য়" ভদ্রলোক খুব ভাব নিয়ে বিস্তারিত বলতে লাগলেন।
কিভাবে হ্য়, কারা খায়, খেলে কি হয় ইত্যাদি ইত্যাদি!
তের নম্বর ষ্টেশন জয়পুরহাট...
"চাচা চিলাহাটি কয়মাস থাকেন?"
"তো ধর পাঁচমাস। মোসুম কালে"
"একাই তো? না আত্বীয়স্বজন কেউ আছে?"
"নাহ একা ক্যান? আরও অন্য জাগা থাকি মানুষ আসেনাহ? গাছ কাটবার? সবাই মিলি একসাথে বাগানের পাশতি ঘর বানাই, রান্না করি, খাই- ঘুমাই।
" আপনার ছেলেমেয়ে আছে না? ওরা কি করে?"
"নাহ! ওরা অন্য ব্যাবসা করে। "
"তাহলে তো চাচা গাছ কাটা আপনার নেশা?" হেসে বলি
চাচাও হেসে দেয়। তবে হাসি কিসের তা আমি বুজতে পারি না।
কেমন জানি রহস্যময় মনে হয়।
বলে "তাহলে বাবা ১টা গল্প করি শোন। ছোটোত থাকতি হামার দাদা কোত-
বেটিক পাললাম, বেটি বড় করলাম, বিয়া দিলাম ব্যাটি হল অন্যের
আর ব্যাটাক পাললাম, ব্যাটা বড় করলাম, বিয়া দিলাম ব্যাটা হল বউয়ের"
দ্যাখে! দেখবি না ক্যান? তয় একবারে ঠেকাত পরলি তালিপর!"
নি:স্তবদ্ধ হয়ে গেল পরিবেশ।
চৌদ্দ নম্বর ষ্টেশন পাঁচবিবি!
আমার হঠাৎ করে ক্ষিদে ক্ষিদে লাগল! নাকি অন্য কিছু? প্লাটফর্ম এ নেমে বিস্কুট পানি কিনলাম নিয়ে এলাম। খাব।
খেলাম। বুড়োকে অমতসত্বেও খাওয়ালাম।
চাচাই আবার গল্প ধরল
"এই যে পাঁচবিবি? তারপর হিলি এটি একবার বিশাল একসিডেন হছিল শুনিছিলেন?"
"কবে?"
"এই অল্প কিছুদিন হল। শুনিচিন বোধহয়। সত্তর আশি সালের দিকি মনহয়"
"নাহ! আমার জন্মই হয়নি তখন!"
"ও।
বিশাল একসিডেন হছিল! কত মানুষ মারা গেছিল!"
"তাই নাকি? কিভাবে?"
"তখন হামি পাঁচবিবি গাছ কাটি। এই যে দেয়াল? এরাম দুরে ঘর করছি আমরা দশ বারোজন! ওহানে থাকি গাছ কাটি, খাই ঘুমাই!
"আপনি না চিলাহাটি গাছ কাটেন?"
"আরে চিলাহাটি তো গাছ কাটি অল্প কয়দিন হল! মাত্র সাতাশ বৎসর!"
আসলেইতো সাতাশ বৎসর অনেক কম। আমি অনেক বুজচ্ছি এরকম ভাবে মাথা নাড়াই!
"তো কি হল? একসিডেন্ট কিভাবে হল?" শুধাই আমি
"আহ! আর কয়ো না বাবা! এক্ষনও চোক্ষের সামনে পস্ট দেখি! টেষন থাকি এট্টু দুরে ১টা মেল টেন দাড়ায় তেল চুরি করছিল! আর সামনে থেকে আর ১ট্টা টেন আসি এমন জোরে মারল । আমরা কাপি উঠি পরি গেলাম! ইনজিন একবারে আরেক টেনের বগির ভিতর দিয়ে চলি গেছে!"
"তা হলে তো অনেক লোক মারা গেছে?"
উহ! লাশে লাশ! বিডিআর ! বিএসেফ! সব!
"ইসস!"
পনের নম্বর ষ্টেশন হিলি।
"চাচা কিছু মনে করবেন না আপনার এই পাঁচমাসে কত আসে?"
তা ধর এই সত্তর আশি তো আসবিই!" বুড়োর কন্ঠে দৃঢ় আত্ববিশ্বাস!"
"এই টাকা দিয়ে বাকি সাত মাস চলেন? কিছু করেন না?টাকা দিয়ে?"
"কি করবি?"
"এই ধরেন দোকান-টোকান বা গরু ছাগল?"
"বুড়া বুড়ি চলি হামরা এইতো! তয় গতবার দুডা খাসি কিনিছি! বুড়োর মুখে আনন্দ!
এই বুড়ো চাচার সাথে আরও অনেক গল্প হয়েছে।
এখন আর সেসব লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে না! নামার সময় আমি আমার মানিব্যাগ অনেক খুজে ১টা পুরাতন কার্ড পেয়েছিলাম। বুড়োকে দিয়ে বলেছি চাচা! যেকোন সময়, যেকোন প্রয়োজনে আমাকে শুধু ১টা ফোন দিবেন। এইটা আমার নম্বর। আমি ঢাকা্য় থাকি। আর অবশ্যই অবশ্যই আমাকে রস বেঁচা কেমন হল জানাবেন! আর কিইবা করতে পারি আমি?
চাচাকে যেতে হবে অনেকদুর! পারি দিতে হবে জীবনের অনেকটা পথ!
এখনও!
ছবি : ইন্টারনেট
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।