জনারণ্যে নির্জনতায় আক্রান্ত। নির্জনতাই বেশী পছন্দ, নিজের ভেতরে ডুবে থাকতেই ভাল লাগে। কিছুটা নার্সিসিস্টও।
আজই সন্ধ্যা ৭:৩০ মিনিটের শো তে বসুন্ধরা স্টার সিনেপ্লেক্সে দেখে এলাম এই বাংলারই এককোনে জন্ম নেয়া গানের ছোট একটি ধারা ও তাকে ঘিরে যৌন নিপীড়ন নিয়ে গড়ে ওঠা ইমপ্রেস টেলিফিল্মের চলচ্চিত্র ঘেটুপুত্র কমলা।
চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাবার আগেই সর্বমহলে ব্যাপক আলেচিত ও সমালোচিত হয়।
আমাদের সমাজের হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, অসঙ্গতি সহ নানা বিষয়ই চলচ্চিত্রের উপজিব্য হতে পারে। এই সিনেমাটিও আমাদেরই সমাজেরই পুর্বে প্রচলিত অনেক অসঙ্গতির একটি নিয়ে। যারা চলচ্চিত্রটি নাদেখেই অন্ধের মত সমালোচনা করছেন তাদেরকে বলব কোন কিছুর সমালোচনা করতে হলে আগে তাকে পুরোটা দেখে শুনে বুঝে তারপর সমালোচনা করা উচিত।
আজ থেকে শতবছর পূর্বে সিলেটের হাওড় অঞ্চলের এক বৈষ্ণব আখড়ায় ঘেটু-গানের উদ্ভব হয় যা কিছুটা উচ্চাঙ্গসঙ্গীত প্রভাবিত ছিলো। সে গানের সাথে নাচের প্রচলন ছিলো।
তৎকালীন সামাজিক বাস্তবতায় মেয়েরা প্রকাশ্যে নাচ-গান করতে পারতো না। কিন্তু তাই বলে মেয়ে চরিত্রের আবেদন কিন্তু থেমে থাকেনি। সেই গানের দলে মেয়ে চরিত্রে নাচ গান করতো দরিদ্র পরিবারের সুন্দর চেহারার কিশোর ছেলেরা।
বছরের নির্দিষ্ট সময়ে সেই অঞ্চলের পানিবন্দী মানুষের মধ্যে যারা বিত্তবান তারা ঘেটুগানের দলকে তাদের বাড়ীতে নাচ-গান করার জন্য নিয়ে আসতো। কিন্তু মেয়েদের সাজে সজ্জিত নাচুনে কিশোরদেরকে বিত্তবানদের কেউ কেউ যৌনসঙ্গী হিসেবে পাবার চেষ্টা করতো ফলে এই গানের ধারায় নোংরামী ও অশ্লীলতা ঢুকে পড়ে।
যেটা এই গানের ধারাকে দ্রুতই ক্ষয়ে দেয়। সিনেমাটির সূচনা বক্তব্যে বলা হয়, ঘেটুপুত্রদের যৌনসঙ্গী হিসেবে পেতে জলবন্দী শৌখিন ও আর্থিকভাবে সচ্ছলরা লালায়িত ছিলো। বছরের জলবন্দি তিন মাস ঘেটুপুত্ররা তাদের আনন্দ-ফূর্তির উপকরণ হিসেবে থাকতো। সে সময় বিত্তবানদের স্ত্রীরা ঘেঁটুপুত্রদের সতীন হিসেবেই গন্য করতো। এমনকি যেটা তৎকালীন সমাজেও স্বীকৃত ছিল।
এ রকমই একটি গল্পকে ঘিরে শ্রদ্ধেয় হুমায়ূন আহমেদ এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছিলেন।
শিল্পমানের বিচারে তার এই সিনেমাটিকে কোন পর্যায়ে ফেলা যায় সেটা আমি বলার যোগ্যতা রাখি না। তবে এটা নিশ্চই বলতে পারি এই মানুষের কাছ থেকেই আমরা আগুনের পরশমনি, শ্রাবণ মেঘের দিনের মত অসাধারন সিনেমাগুলি পেয়েছিলাম, তাই কিছুটা হতাশই হয়েছি তাঁর এ সিনেমাটি দেখে।
জীবিতাবস্থায় হুমায়ূন আহমেদ নিজের মুখেই বলেছিলেন, চলচ্চিত্রটিকে তিনি অ্যাডাল্ট রেটিংয়ে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটি সম্ভব হয়নি আমাদের হিপোক্রিট সমাজের প্রচলিত সেন্সর আইনের কারণে।
এমনকি তিনি বাচ্চাদেরকে এছবি না দেখতেও বলেছেন। আমিও তাঁর সাথে পুরোপুরি একমত। তিনি যেভাবে সিনেমাটি বানিয়েছেন তাতে কোনভাবেই এটি বাচ্চাদেরকে নিয়ে দেখারমত ছবি নয়। যদিও অনেকে বলবেন ড্রইংরুমেই আমরা হিন্দি সিনেমাতে এরচাইতেও হাজারগুন বেশী যৌনতা দেখে অভ্যস্ত। যারা এই মতের তাঁদের সাথে অহেতুক তর্কে যাবার আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই।
তবে আমাদের সেন্সর কর্তৃপক্ষকে মনে করিয়ে দিতে চাই, অন্ধ হলেই কিন্তু প্রলয় বন্ধ হয় না। সেন্সর আইনকে আধুনিক না করে চোখ বন্ধ করে আর কতদিন থাকা সম্ভব ? মুক্তচিন্তার ও মুক্তবুদ্ধির এই সময়ে সবকিছুই বিশ্বমানের হওয়া উচিৎ।
চলচ্চিত্রটির গল্পে দেখা যায়, জলবন্দি হাওড় অঞ্চলের প্রভাবশালী একজন ব্যক্তি তার জলবন্দি সময়ে আনন্দের জন্য ঘেঁটুগানের দলকে ভাড়া করে তিনমাসের জন্য নিয়ে আসে। দলের মধ্যমনি কমলারুপী কিশোর জহির। সে গানের পাশাপাশি চৌধুরীর যৌনসঙ্গীও হতে বাধ্য হয় যা তার গানের দলের অধিকারীরুপি আর্থিকভাবে অসচ্ছল বাবার পরোক্ষ ইচ্ছাতেই, যা বিসদৃষই ঠেকে, যা আবহমানকালের বাবা চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলে না।
তাছাড়া এই চলচ্চিত্রটিতে ঘেটুপরিবারটির আর্থিক অসচ্ছলতাকে হাইলাইট কোনভাবেই করা যায়নি বা হয়নি। কস্টিউমের দিকেও ভালভাবে নজর দেয়া হয়নি, যা অনেকটাই দৃষ্টিকটু। যেহেতু এটি ঐতিহাসিক ছবি তাই ১০০ বছর আগের ড্রেসআপ নিয়ে কাজের যথেষ্ট সুযোগ ছিলো। শুধুমাত্র চৌধুরী ও তার স্ত্রীর ড্রেস এর দিকে না তাকিয়ে প্রতিটি চরিত্রের ড্রেসএর দিকে দৃষ্টি দেয়াটা জরুরী ছিলো। তাছাড়া কমলার ড্রেসআপটি এভাবে না দেখিয়ে আরও শালীনভাবে কি দেখানো যেতো না ? তবে এখানেও বানিজ্য মাথায় ছিলো সেটা ভালমতই টের পাওয়া যায়।
যেহেতু এচলচ্চিত্রটিকে আমাদের সামাজিক বাস্তবতায় অ্যাডাল্ট রেটিং দেয়া যায়নি, তাই এদিকে নজর দেয়া দরকার ছিলো। চলচ্চিত্রটিতে প্রতাপশালী বাড়ীর দীনহীন চুনকাম করা কালার ও ক্ষয়ে যাওয়া পলেস্তারা কোনভাবেই প্রতাপ জাহির করে নি, বরং হারিয়ে যাওয়া দীনহীন রূপই প্রকাশ করেছে। তাছাড়া ক্যামেরার কাজকে টিভি-নাটক মানের চাইতে বেশীকিছু মনে হয়নি। পানিবন্দী একটি এলাকায় ক্যামেরার কাজের যথেষ্ট সুযোগ ছিলো। তবে বৃষ্টিশুরুর দৃশ্যটা দারুন হয়েছে।
চলচ্চিত্রটিতে হুমায়ুন আহমেদ পরিমিতিবোধ দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। আমার মতে চলচ্চিত্রটি এই গল্প নিয়ে সর্বোচ্চ ৫০ মিনিটের হতে পারতো। অহেতুক টেনে চলচ্চিত্রটিকে বড় করা হয়েছে। চৌধুরীকর্তৃক যৌনআক্রমনের শিকার হওয়া কমলারূপি জহিরের আর্তনাদ বারবার দেখানোর দরকার ছিলোনা। তাছাড়া অহেতুক হুমায়ুন ঘরানার কৌতুক না দেখালেও চলতো।
একই সাথে একই মানুষের ভিতরযে ডাক্তার জেকিল ও মিষ্টার হাইড বাস করে সেটাই চৌধুরী চরিত্রে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ধর্ম যে মানুষকে হিপোক্রেট হতে বাধা দেয়না সেটা জমিদার ও তার মৌলভীর চরিত্রকে চিত্রায়ন করে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে।
তাছাড়া হুমায়ুন আহমেদ চলচ্চিত্রটিতে যৌননিপীড়ন দেখাতে চেয়েছেন নাকি ঘেঁটুগানকে দেখাতে চেয়েছেন সেটা আমি ভালকরে বুঝতে পারিনি। তবে সববিচারে মনে হয় যৌননিপীড়নকেই তিনি হাইলাইট করতে চেয়েছেন। তবে গানের ধারাটিকে হাইলাইট করলে চলচ্চিত্রটি আরও প্রানবন্ত হতে পারতো।
চলচ্চিত্রটি তৈরী করতে গিয়ে বানিজ্যিক ব্যপারটিই মনে হয় মাথায় বেশী কাজ করেছিলো, কারন আমাদের মনে রাখতে হবে চলচ্চিত্রটির পরিচালক হুমায়ুন আহমেদ হলেও প্রযোজক ছিল ইমপ্রেস টেলিফিল্ম।
কেন্দ্রীয় চরিত্রে মামুনের অভিনয় এবং চৌধুরী চরিত্রে তারিক আনাম খানের অভিনয়গুনের কারনেই ছবিটি পার পেয়ে গেছে। প্রাণ রায় এবং চৌধুরীকন্যা চরিত্রে অভিনয় করা পিচ্চিটি যথেষ্ট ভাল করেছে। তবে বাকী চরিত্রগুলি বেশীরভাগই নিজের চরিত্রের চাহিদা মিটাতে পারেননি।
তবে চলচ্চিত্রটির মূল গান "সুয়া উড়িলো উড়িলো উড়িলোরে" গানটিই এচলচ্চিত্রটির প্রাণ।
এগানটি বারবার শোনা ও দেখার মত গান, বাকীগানগুলি পূর্বেই শ্রুত।
সর্বোপরি হুমায়ুন আহমেদের নামই এসিনেমাটিকে উৎরে দিয়েছে, তাছাড়া এটি তাঁর শেষ ছবি বলে কথা ! ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।