আমি লেখক খারাপ হতে পারি কিন্তু ছেলে ভাল নিশুতি রাত।
পথে গাড়িটা খারাপ হয়ে গেল। ওটা গ্যরেজে ফেলে বাকি পথটা হেঁটে ফিরতে হল। একটা ট্যক্সি বা স্কুটার কিচ্ছু নেই। কি এমন রাত হয়েছে, মোটে সাড়ে বারোটা বাজে।
তাতেই রাস্তা একদম ফাঁকা। আজ ব্যঙ্কে একাউন্টস ক্লোজিং ডে ছিল। সব হিসেব মিলিয়ে অফিস থেকে বেরুতে বেরুতে অনেক দেরি হয়ে গেল। তার উপর পথে এই বিপত্তি। শফিকের মেজাজটা খিঁচরে গেছে।
শফিকদের বাসাটা মিরপুর ১০ নম্বরে। গলির ঢোকার মুখটা বেশ সরু। গাড়ি ঢুকাতে বেশ সমস্যা হয়। গলিটা বেশ অন্ধকার। আজ কি সবাই সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়ল? গলির দু’পাশের একটা বাড়িতেও বাতি জ্বলছে না।
শুধু গলির মুখের বুড়ো ল্যম্প পোস্টের নিয়ন বতিটা মৃগী রুগীর মত ধ্বক ধ্বক করছে। সেই ময়লা আলো গলির ভেতরের অন্ধকার দূর না করে যেন আরো বাড়িয়ে তুলছে। মিউনিসিপলিটি যে কবে এই ল্যম্প পোস্টগুলো ঠিক করবে!
একটু আগে হালকা বৃষ্টি হয়ে গেছে। ভাদ্র মাসের বৃষ্টি, থেক থেকে এক পশলা পানি ঢেলে সবাইকে ভিজিয়ে দিয়েই নাই। রাস্তার খানা খন্দে পানি জমে আছে।
শফিক সাবধানে পা চালায়। অন্ধকারে হোচট খাওয়ার সম্ভাবনা ষোল আনা।
আজ অন্ধকারটা এতো বেশি লাগছে কেন? মোবাইলের আলো ফেলে যে একটু গর্ত ফর্ত আছে কিনা দেখে নেবে সেই উপায়ও নেই, চার্জ শেষ। কিন্তু আজ যেন আর সব দিনের চেয়ে আঁধারটা একটু বেশিই ঠেকছে। আকাশে চাঁদ নেই।
এখন কি শুক্ল পক্ষ চলছে? কে জানে। শারমিন এসবের খুব হিসেব রাখত।
কোন শব্দ নেই। পথ একেবারে শুনশান। দুই পাশের অন্ধকার দালানগুলোকে কেমন যেন ঘোমটা দেয়া প্রেতের মত মন হচ্ছে।
দালানগুলো যেন নিঃশ্বাস এলছে। এমন মনে হবার কারনটা কি? শফিকের গা একটু ছম ছম করে উঠে। নিজের অজান্তেই সে চলার গতি একটু বাড়িয়ে দেয়।
অতিরিক্ত নিঃশব্দটার কারনেই বোধ হয় নিজের পায়ের আওয়াজটা বড় বেশি করে কানে বাজছে। তাই হঠাত পায়ের শব্দকে ছাপিয়ে আরেকটা খসখসে আওয়াজ কানে যেতেই শফিক চট করে সচকিত হয়ে উঠল।
আওয়াজটা আসছে পথের ধারে চারকোণা ডাস্টবিন থেকে। ডাস্টবিনে ময়লা উপচে পড়ছে। যতনা ময়লা ডাস্টবিনের ভেতরে তারচে তিনগুন বাইরে। মাছি ভন ভন করছে। শফিকের মনে হল ময়লার মধ্যে কালো কিছু একটা নড়ছে।
আরেকটু কাছে যেতেই কালো কাঠামোটা একটা চার পেয়ে প্রানিতে রুপ নিল। একটা কুকুর, সম্ভবত খোড়া। শির্ন শরীর, এখানে সেখানে গায়ের লোম উঠে গেছে। ময়লার ভেতর থেকে একটা কিছু দাঁতে কামরে ধরে টানছে। কুকুরটাকে আগে দেখিনি।
বোধ হয় গলিতে নতুন। এহহ, কি কুৎসিত চেহারা। লোমহিন কুকুরটাকে দেখে গা গুলিয়ে আসছে। শফিক ঘৃণা ভরে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে যাবে এমনি সময় কুকুরটার মুখের উপর ওর চোখ আটকে গেল। কুত্তাটা ময়লার ডিপো থেকে বের হয়ে এসেছে।
মুখে কামড়ে ধরে আছে ওটা কি? জিনিসটা জীবন্ত! একটু একটু নড়ছে। বেড়াল টেড়াল নাকি। অন্ধকারে শফিক ঠিক দেখল কিনা জানে না কিন্তু ওর মনে হল কুত্তাটার মুখে রক্ত লেগে আছে। ঠোঁটের কস বেয়ে এক দু ফোটা নেমে আসছে। মাটিতে রেখে কুত্তাটা এবার খেতে শুরু করল।
শফিক শান্ত পায়ে আরেকটু এগিয়ে ঘাড় বাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করল কুত্তাটা কি খাচ্ছে।
ওহ মাই গড।
ওটা কি??
একটা বাচ্চা??
কুকুরটা কামড়ে কামড়ে একটা ছোট্ট বাচ্চাকে ছিড়ে খাচ্ছে। একটা সদ্যজাত মানব শিশু।
কুকুরটা হঠাত খাওয়া থমিয়ে শফিকের দিকে তাকাল।
ওর চোখের দৃষ্টি টক টকে লাল। ওটার গলা দিয়ে ভারি ঘর ঘরে আওয়াজ বের হয়ে এল। ধারালো দাতগুলো দেখিয়ে শফিককে আর এগুতে মানা করছে।
শফিক দুর্বল পায়ে কোন মতে কুকুরটাকে পাশ কাটিয়ে এল। কিছু দূর গিয়ে ফিরে তাকিয়ে দেখল কুত্তাটা আবার খাওয়ায় মন দিয়েছে।
শফিক এবার খিচে দৌড় দিল।
বাড়ি ফিরে শফিকের বেশ কিছুটা সময় লাগল স্বাভাবিক হতে। বাথরুমে গিয়ে কাপড় বদলে কয়েকবার মুখে পানির ঝাপটা দিল। তারপর বিছানায় ঝিম মেরে বসে ভাবল কি দেখলাম এটা। ডাস্টবিনে বাচ্চা আসবে কি করে।
তাও আবার জীবন্ত। নিশচয় চোখের ভুল। কুকুরটা হাবিজাবি কিছু একটা খাচ্ছিল, অন্ধকারে কি দেখতে কি দেখেছি। নাহ বেশ খিদে পেয়েছে।
বুয়া রান্না করে ফ্রিজে রেখে গেছে।
গরম করে খেতে হবে। ফ্রিজ খুলে শফিক নাক কুচকে ফেলল। কচুর লতি আর কৈ মাছের ঝোল। কাজের লোকটাকে কতবার বলা হয়েছে কৈ মাছ রাঁধবে না, শফিক খেতে পারে না। গলায় কাঁটা বেঁধে।
এই কাজের বুয়াটা নতুন। কাজ টাজ ভালোই করে। কিন্তু বড্ড বেয়ারা। কথা-টথা একদম শুনতে চায় না। তাছাড়া বোধ হয় হালকা চুরির অভ্যাসও আছে।
নাহ, একে আর বেশি দিন রাখা যাবে না। ফ্রিজে স্ন্যকস টাইপের কিছু আছে কিনা খুঁজল। নেই। শফিক কিচেন ক্যবিনেটে ইন্সট্যন্ট মিক্স নুডলসের প্যকেট খুঁজে পেল। পানি গরম করে আর একটা ডিম ভেঙে কড়াই এ ছেরে দিলেই হয়ে যাবে।
নিজেই এক বাটি নুডলস তৈরি করে ও ড্রয়িং রুমে টিভি ছেরে বসল। এত রাতে কোন চ্যনেলেই ভালো কিছু হয় না। এইচবিও তে মান্ধাতা আমলের একটা ছবি চলছে, বাংলা চ্যনেলগুলোতে দির্ঘ বিজ্ঞাপন দেখাচ্ছে। শফিক বিরক্ত হয়ে টিভি অফ করে দিল। বারবার ঘুরে ফিরে ডাস্টবিনে বাচ্চাটার কথা মনে পড়ছে।
খেতে ভাল্লাগছে না। নুডলসগুলোর কি এক্সপায়ারেশন ডেট ফুরিয়ে গেছে? খেতে কেমন শক্ত শক্ত লাগছে। শফিক বাটির নুডলসগুলো অয়েস্টবিনে ঢেলে দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলল।
সারা শরীর জুড়ে ক্লান্তি। কিন্তু ঘুম আসছে না।
শফিক বিছানায় শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ঘর অন্ধকার। কিন্তু ভেন্টিলেটর চুইয়ে বাহির থেকে চুপিসারে সামান্য আলো ঢুকে পড়েছে ঘরের ভেতর। ছাদে ফুল স্পিডে ফ্যন ঘুরছে। চলন্ত ফ্যনের উপর আলোক রশ্মির প্রতিফলন কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে।
শারমিনের কথা মনে পড়ছে। ও এই আলোটা খুব আগ্রহ নিয়ে দেখত। ও নাকি অনেক দিন আগে হুমায়ুন আহমেদের কোন এক বইয়ে পরেছিল লেখকের ছোটবেলায় তাদের শোবার ঘরের ঘুলঘুলি দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়ত মশারির উপর। নকশা কাঁটা ভেন্টিলেটরে বাঁধা পেয়ে সেই আলো মশারির ছাদেও অদ্ভুত নকশা তৈরি করত। লেখক সেটাকে বলেছিলেন জ্যোৎস্নার ফুল।
হুমায়ুন শারমিনের প্রিয় লেখক ছিল। তার লেখা প্রতিটি শব্দ ওর কাছে অমৃতসম। শফিক মশারির ভেতর ঘুমাতে পারে না, ওর হাসফাস লাগে। আর তাছাড়া শফিকদের শোবার ঘরে জ্যোৎস্নার আলো ঢুকে না। এই দুই কারনে শারমিনের কখনো জ্যোৎস্নার ফুল দেখা হয়নি।
তবে বারান্দার ঘুল ঘুলি দিয়ে এই চিকন আলোক রশ্মিটা সব সময় এসে পরে তাদের শোবার ঘরের ছাদে। কোথায় এর উৎস শফিক আজো ভেবে বের করতে পারেনি। শারমিন মুগ্ধ হয়ে এর দিকে তাকিয়ে থাকত। প্রায়ই গল্প করত আমাদের যখন একটা বাবু হবে ওকে আমি ওই আলো দেখিয়ে ঘুম পাড়াব। বাবুটা কিছুতেই ঘুমাতে চাইবে না।
আমি যতবার জোর করে ওর মাথা আমার কাঁধে শুইয়ে দেব, ও ততবারি মাথা তুলে আলোর দিকে তাকাবে। নিজের বাচ্চাকে নিয়ে ওর এই রকম ছেলে মানুষী অনেক ফ্যন্টাসি ছিল। আহা, সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেল।
দেয়ালে শারমিনের বড় একটা বাঁধানো ফটো ঝুলছে। শফিকের মনে হয় সে অন্ধকারেও ফটোটা স্পষ্ট দেখতে পায়।
যখন তার রাতে ঘুম আসে না তখন সে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ছবির শারমিনের সাথে কথা বলে। নিজেই প্রশ্ন করে। আবার নিজেই শারমিনের হয়ে উত্তর দেয়। শফিকের নিজের মনে কথা বলার বাতিক আছে। যখন আশে পাশে কেউ থাকে না তখন ও প্রায়ই নিজের সাথে কথা বলে।
শফিক বলছে, “আমার একটুও ঘুম পাচ্ছে না। তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছ? আজ জানো কি হয়েছে, ফেরার পথে গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে। হেঁটে ফিরছি। গলির মধ্যে ঢুকে দেখি একটা কুকুর ডাস্টবিন থেকে কি যেন খাচ্ছে... আরো কাছে গিয়ে দেখি... থাক আর বলতে ইচ্ছে করছে না। পুরোটা শুনলে তোমার মন খারাপ হয়ে যাবে।
আজ সারা দিন কেমন কাটল তোমার? খাওয়া দাওয়া করেছ সময় মত? আমি দুপুরে ফোন দিতে পারিনি স্যরি। এত্তো কাজের চাপ অফিসে। উফ। ”
রাত বারে। এক সময় শফিক ঘুমিয়ে পরে।
স্বপ্নে সে নিজের শৈশবের দিনগুলো দেখতে পায়। দেখে সে ঘাসের বনে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে সুতা আর নাটাই। কিছুটা দূরে সুতার অন্য প্রান্তে ঢাউস একটা লাল ঘুরি হাতে দাঁড়িয়ে আছে তার বাবা। বাবা বলল, আমি ছেরে দিলেই সুতা টেনে দৌড় দিবি, খুব জোরে ঠিক আছে।
ছয় বছরের শফিক মহা উৎসাহে মাথা নাড়ল। বাবা ওয়ান টু থ্রি বলে ঘুরি ছেরে দিতেই সুতো টেনে দৌড় লাগাল। কিন্তু কি কপাল, দুই পা যেতে না যেতেই গর্তে পা বেঁধে ধপাস করে পরে গেল। বাবা সাথে সাথে ছুটে এল, মুখ ভর্তি হাসি। বাবার হাসি দেখে শফিকও হেসে ফেলল।
স্বপ্নের দৃশ্যপট পাল্টে গেল। আশুলিয়া লেকের পার। ইউনিভার্সিটিতে থাকতে শফিক আর শারমিন প্রায়ই এখানে বেড়াতে আসত। এই আশুলিয়ার পাড়েই এক রক্ত রাঙা সন্ধ্যায় শারমিনকে গভীর আবেগে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছিল শফিক। ওর জীবনের প্রথম।
ওর মনে আছে শারমিনের চোখে পানি এসে গিয়েছিল। লজ্জায় নয়, সুখে। স্বপ্নে সেই সুমধুর স্মৃতিগুলো আবার উঁকি দিয়ে গেল। সকালে শফিকের যখন ঘুম ভাঙল স্বপ্নের হাসির ছাপটুকু তখনও তার ঠোঁটে লেগে আছে।
শাওয়ার সেরে শফিক দ্রুত তৈরি হয়ে নিল।
অফিস বনানিতে। গাড়িটা নষ্ট হয়ে গ্যরেজে পরে আছে। মিরপুর থেকে এতো দূরে সময় মত পৌছানো কম ঝক্কি না। শফিক কাজ করে ইউসিবিএল ব্যঙ্কে, এসিস্ট্যন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট। পদবির দৈর্ঘ যত বড় দায়িত্বও তত বড়।
শফিকের বস নতুনদের অনিয়মে বিশেষ কিছু মনে করেন না, কিন্তু উর্ধ্বতনদের কাজে অবহেলা একদম সহ্য করেন না।
অফিসে পৌছে দেখল এখনও সবাই এসে পৌছায়নি। ইয়াং অফিসাররা কয়েকজন এসেছে। কেউ এখনও কাজে মন দেয়নি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে গল্প করছে।
শফিক গিয়ে ওর পিসি অন করতেই কিউবিকলের উপরে রাহাতের হাস্যজ্জল মুখটা উদয় হল। “কি শফিক ভাই, এসেই কম্প্যুটার নিয়ে বসে গেলেন। টি-রুমে আসেন চা-টা খাই। ”
“মাত্রই তো আসলাম”
“আরে সকাল বেলা দুই কাপ চা না খেলে শরীরে কাজের জোস আসে বলেন। আপনি আসেন তো ভাই, আপনারে ছাড়া জমে না।
”
“আসছি, সিইও স্যার কই?”
“স্যর এখনও আসে নাই, স্যরের বউয়ের অসুখ”
“তাই নাকি, সিরিয়াস কিছু? তোমাকে কে জানালো?”
“আরে নাহ কিসের সিরিয়াস। পেট ব্যথা জাতিয় কিছু। আমারে ফোন দিয়া কইল ডেইলি রিকন্সিলিয়েসন রিপোর্টটা তৈরি রাখতে। উনার আসতে দেরি হবে। ”
“ওহ, আর তুমি এই চান্সে...”
“হে হে... আসেন আমি চা বানাইতেসি”
টি রুমে রাহাত ছারাও নাজনিন আছে।
মেয়েটা অফিসে নতুন জয়েন করেছে। চা খেতে খেতে দুই জনে জমিয়ে গল্প করছে। রাহাতের কি কথায় নাজনিন মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ছে। রাহাত পোলাটাই এইরকম। অফিসে নতুন মেয়েদের সাথে ভাব জমাতে জুড়ি নেই।
শফিক হাত নারল, "নাজনিন কি খবর?"
"এই তো শফিক ভাই আপনার কেমন চলছে?"
রাহাত ওর মুখের কথা কেড়ে নিল, “আরে আমাদের শফিক ভাই কখনো খারাপ থাকে না। অল টাইম হ্যপি। অনার সাথে যতক্ষণ থাকবা তোমার নিজেকেও হ্যপি মনে হবে। ”
"বাহ তাই নাকি?"
“হ্যা, অবশ্য সুন্দরি মেয়েদের বেশিক্ষন উনার সাথে না থাকাই ভালো। শফিক ভাই কিন্তু সার্টিফায়েড ব্যচেলর।
সো...”
শফিক বলল, “রাহাত কিন্তু এই চান্সে জানিয়ে দিল যে নাজনিন দেখতে ভাল। রাহাত, তোমার বউ জানলে কিন্তু...”
“বউয়ের কথা আর বইলেন না রে ভাই... এই মহিলা আমারে দুই সেকেন্ডও শান্তিতে থাকতে দেয় না। আপনি বহুত ভালো আছেন বুঝলেন। ” রাহাত চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিল। শফিক চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে পত্রিকার পাতা উল্টালো।
বিশাল পাতা জুড়ে সব বিশ্রি বিশ্রি খবর। খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ। রাহাত পাশ থেকে উঁকি দিল। “দেশের অবস্থা দেখছেন? একটা ভালো খবর নাই। আমি এই জন্য পেপার পড়া বাদ দিয়ে দিসি।
খালি খেলার খবর আর বিনোদন পাতাটা পড়ি। ...... এই যে দেখেন, হাসপাতাল থেকে বাচ্চা চুরি! কি ভয়াবহ দেখছেন?”
শফিক মনোযোগ দিয়ে আর্টিকেলটা পরে। রাজধানির এক হাসপাতালের নার্স এক সদ্যজাত শিশুকে চুরি করে দুর্বিত্ত্বদের হাতে পাচার করে দেয়ার চেষ্টা করছিল। সময়মত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আর পুলিশের সহায়তায় বাচ্চাটাকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়। রাহাত বলছে “অবস্থাটা দেখছেন? আপনি কার উপর ভরসা করবেন? এমনকি হাসপাতালে ডাক্তারদের হাতেও মানুষ নিরাপদ না।
আমার পাশের বাসার এক ভাবি তার ফুপাতো বোনের এমন একটা কাহিনী বলেছিল। উনার বোনের বাচ্চা হবে, কিন্তু ডেলিভারির পর ডাক্তাররা এসে বলে বাচ্চা ডেড। কিন্তু পরে খোঁজ খবর করে জানা গেল বাচ্চা ঠিকই আছে, ডাক্তাররা ভুল ইনফরমেশন দিচ্ছিল। এইটা নিয়ে পরে থানা পুলিশ করে মহা হাঙ্গামা হয়ে গেছে। আসলে এগুলোর একটা গ্রুপ আছে বুঝলেন।
যাফের কাজই হল নবজাতক পাচার করা”
নাজনিন বলল, “আরেকটা ব্যপার খেয়াল করেছেন? ইদানীং ইল্যিগ্যাল এবোর্শন কেমন বেরে গেছে? ডাস্টবিনে বাচ্চা পাওয়া যাচ্ছে! হাউ ডিসগাস্টিং। ”
শফিকের চট করে গতরাতের কথা মনে পরে গেল। মুখের চা-টা হঠাত বড় বিস্বাদ মনে হল।
***
রাত অনেক হয়ে গেছে। শফিকদের সেকশনটা একটু একটু করে ফাঁকা হয়ে আসছে।
শফিক ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে কম্প্যুটারের স্ক্রিনের দিকে। লোন এন্ড এডভান্সের ব্রাঞ্চ অয়াইজ সেমিএন্যুয়াল ব্যলেন্স সেক্টর অয়াইজ ব্যলেন্সের সাথে মিলছে না। শফিক এক্সেলে বহু কায়দা কানুন করেও ফিগার দু’টোকে কাছাকাছি আনতে পারছে না। রাহাত বলল, “ভাই আমি এখন বেরুচ্ছি। আপনার কতদূর?”
“এলএন্ডএ হিসাবের তো কোন কুল কিনারা করতে পারলাম না।
”
“আজকে আর পারবেন না। বাসায় গিয়ে ঘুম দেন। কাল সকালে আবার এইটা নিয়া বসা যাবে। ”
“রিপোর্ট ফেলে রাখলে বস রাগারাগি করতে পারে। ”
“আরে বস রাগারাগি করলেই হইল? একাউন্টস থেকে ভুল ফিগার দিলে আপনার আমার কি দোষ?”
“আমি আরেকটু দেখি, তুমি যাও”
“কি কাজ পাগল মানুষরে বাবা, আচ্ছা আমি উঠি তাহলে।
আপনি বেশি রাত কইরেন না। ”
রাত করবে না বলেও শফিক কাজটা নিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত লেগে থাকল। ওর একরকম জিদ চেপে গেছে। কেন হিসেব মিলবে না? অবশেষে শফিক গড়মিলটা বের করতে পারল। জয়ির হাসি হেসে হাতঘড়িটার দ্দিকে তাকাতেই ও আঁতকে উঠল।
একটা বেজে গেছে। পুরা অফিস খালি। একটা মানুষও নেই। বেশির ভাগ বাতি নিভিয়ে দেয়া হয়েছে। শুধু শফিকের সেকশনেই আলো জ্বলছে।
শফিক খেয়াল করল ওর মাথা কেমন ঝিম ঝিম করছে, গা কাঁপছে। অনেকক্ষণ টানা মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকার ফল। শফিক এলোমেলো পায়ে অয়াশ রুমের দিকে যাত্রা করল।
দুইহাতে বেসিন আঁকড়ে ধরে শফিক দেহের কাঁপুনি সামলে নিতে চেষ্টা করল। আয়নায় নিজের প্রতিফলনের দিকে তাকিয়ে ও লম্বা দম নিল।
ঝাপসা আয়নায় নিজেকে কেমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। চোখে এমন কোটরে ঢুকে গেছে। এমন লাগছে কেন নিজেকে? আয়নার ভেতর থেকে যেন একটা অজানা মানুষ তার দিকে তাকিয়ে আছে। শফিক ট্যাপ ছেরে দিল। হাতে ঠান্ডা ঝিরিঝিরি পানির স্পর্শটা ভালো লাগছে।
ও মুখে বেশ কয়েকবার পানির ঝাপ্টা দিল। আহ শান্তি।
ট্যাপ বন্ধ হচ্ছে না। চাবির প্যচ কেটে গেল নাকি? শফিক শক্ত করে মুচড়ে বন্ধ করতে যেতেই গোটা চাবিটাই খুলে এল। ফিনকি দিয়ে পানি বের হচ্ছে।
বেসিন উপচে স্রোতের মত পানি গড়িয়ে পড়ছে মেঝেতে। দেখতে দেখতে মেঝেতে অনেকখানি পানি জমে গেল। ভালো যন্ত্রণা হল তো। এখন অফিসে কে আছে? কাকে ডেকে কল ঠিক করার কথা বলা যায়? আবার এভাবে ফেলে গেলে কাল সকালে এসে হয়তো দেখা যাবে অফিস ভেসে গেছে।
শামিম দরোজা খুলে বের হবার চেষ্টা করল।
দরোজা খুলছে না। আশ্চর্য! দরোজা বন্ধ করল কে? শফিক হাতল ধরে হ্যচকা টান দিল, দরোজা পাথরের মত অনড়। ওর নাকে হঠাত একটা বোটকা গন্ধ এসে ধাক্কা দিল। কি ব্যপার গন্ধ আসছে কোত্থেকে? শফিক দেখল বেসিন থেকে পরিষ্কার পানির প্রবাহ কেমন মরচে পড়া লালচে রঙে পাল্টে গেছে। সেই পানিতে বিকট দুর্গন্ধ।
পুতি দুর্গন্ধময় পানিতে মেঝে ভেসে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে ওর জুতোর আধইঞ্চি পানিতে ডুবে গেছে। শফিক জোরে জোরে দরোজায় থাবা মারল। ওপাশ থেকে কোন সারা পাওয়া গেল না। সারা পাওয়ার কথাও নয়।
অফিসে শফিক ছাড়া আর কেউ নেই। তাহলে দরোজা আটকাল কে?
গন্ধটা ক্রমেই বাড়ছে। শফিকের নিঃশ্বাস আটকে আসছে। পানিতে ওগুলো কি ভাসছে? কেঁচো? এক দুইটা শফিকের পা বেয়ে উঠতে চাইছে। শফিক জোরে দরোজায় লাথি মারল।
বদ্ধ ঘরে মনে হল যেন বোম ফাটল। শফিক তোয়াক্কা করল না। তিন নাম্বার লাথির সাথে সাথে প্রচন্ড শব্দে দরোজা হা করে খুলে গেল। শফিক দেরি না করে হাতের ব্যগটা তুলে নিয়েই ছুট লাগাল সিড়ির দিকে। এত রাতে লিফট বন্ধ।
সিড়ি বেয়ে সাত তলা থেকে নেমে আসা সহজ কথা নয়। নিচে পৌছে শফিক রীতিমত হাপাতে লাগল।
দালানের মুল ফটক রাত দশটার পর বন্ধ হয়ে যায়। বের হতে হবে বেসমেন্টের পার্কিং লট দিয়ে। পার্কিং লটটাও জনমানব শূন্য।
সার বেঁধে রাখা গাড়িগুলো ঝিমুচ্ছে। ছাদের কাছে একটা টিমটিমে টিউব লাইট জ্বলছে। তাতে মাঝখানের কিছুটা জায়গা আলোকিত হলেও গাড়ির সারির ফাকে ফাকে চাপা অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে। ময়লা আলোতে গাড়িগুলোকে মনে হচ্ছে সারি বেঁধে থাকা কতগুলো অতিকায় গুবরে পোকা।
শফিক দ্রুত বের হবার ফটকের দিকে পা চালাতে গিয়ে থেমে গেল।
চাপা একটা গোঙ্গানির শব্দ ভেসে আসছে। যেন একটা বাচ্চা কাঁদছে। নবজাতক শিশুর থেকে থেকে কেঁদে উঠার মত। শফিক এদিক সেদিক তাকাল। বেসমেন্টে বাচ্চা আসবে কোত্থেকে? বিড়ালের বাচ্চা না’তো? ওগুলোর ডাক অনেক সময় মানুষের বাচ্চার মতই শুনায়।
মাটির দিকে চেয়ে শফিক যেন জমে গেল। কনক্রিটের মেঝের উপর মোটা কালো এক জোড়া দাগ। রক্তের ছাপ? দাগ জোরা ওর পায়ের কাছ থেকে শুরু করে চলতে চলতে একটা পিলারের পেছনে চলে গেছে। যেন মেঝের উপর দিয়ে রক্তাক্ত কিছু টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দেখব না দেখব না করেও শফিক মনের অজান্তেই দাগটা অনুসরণ করে এগিয়ে গেল।
পিলার পার হয়ে দাগটা আরো কিছু দূর গিয়ে অন্ধকারে মিশে গেছে। ওই কোনটায় আলো পৌচাচ্ছে না। শিশুর কান্নার আওয়াজটা অখান থেকেই আসছে। শফিক ভয়ে ভয়ে আরো কয়েক পা সামনে এগুলো। অন্ধকারটা একটু পরিষ্কার হয়ে আসছে।
ওখানে কেউ একজন আছে। লোকটা কি করছে? কান্নার আওয়াজটা কেমন যেন পাল্টে গেল। এখন মনে হচ্ছে কেউ চাপা স্বরে কাতরাচ্ছে। মেয়ে মানুষের কন্ঠ।
আরেকটু কাছে যেতেই মানুষটির কাঠামো পরিষ্কার হল।
সে শফিকের দিকে পেছন ফিরে একটা গাড়ির সামনে পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটি অত্যন্ত লম্বা, খালি গা। তার নগ্ন বলিষ্ঠ পিঠ ঘামে চকচক করছে। শক্তিশালী দুই হাতে সে কাউকে চেপে ধরে রেখেছে গাড়ির বনেটের সাথে। একটা মেয়ে, ওর দিঘল কালো চুলের একাংশ দেখা যাচ্ছে।
চাপা কাতর ধ্বনি ওর মুখ থেকেই ভেসে আসছে। মানুষটার নিতম্ব ক্রমাগত সামনে পেছনে দোল খাচ্ছে। প্রতি মুহুর্তে বেরে চলেছে দোল খাওয়ার গতি। কাতর ধ্বনি আস্তে আস্তে ক্ষিন হয়ে এল। মেয়েটির হাত নিথর ভাবে ঝুলে পড়ল।
কিন্তু লোকটা থামছে না। সে আগের মতই সজোরে আঘাত করে চলেছে।
শফিক পায়ে পায়ে পিছিয়ে এল। হঠাত কড়াত করে শব্দ হল, শফিকের পা পড়েছে একটা ভাঙা কাঁচের বোতলে। পাই করে মানুষটা ঘুরে দাঁড়াল।
অন্ধকারে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু সে শফিককে দেখতে পেয়েছে। শফিকের স্পষ্ট মনে হল অন্ধকারে মানুষটার চোখ ধ্বক করে জ্বলে উঠল। শফিক তাড়াহুড়া করে সরে যাবার চেষ্টা করতে গিয়ে তাল হারিয়ে ধপাস করে পরে গেল মাটিতে। লোকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে আসছে। তার এক হাতের মুঠোয় এখনো মেয়েটির একটা পা শক্ত করে চেপে ধরা। নিজের সাথে সাথে সে মেয়েটির নিথর দেহ মঝের উপর ছেঁচড়ে টেনে আনছে। শফিক মাটিতে পা ঘসটে আরো কিছুটা পিছিয়ে গেল। ওর বিস্ফারিত দুই চোখ মানুষটার উপর নিবদ্ধ।
লোকটা এক হাতে একটা লাশ ধরে রেখেও ভীষণ গতিতে তেড়ে আসছে। শফিক এবার কোনমতে হাচরে পাচরে উঠে দৌড় দিল। ওকে উঠে দাঁড়াতে দেখে লোকটা হাত থেকে মেয়েটিকে ফেলে দিল। তারপর ভিম বেগে ছুটে এল শফিকের দিকে। এমনি সময় আচমকা পার্কিং লটের সবগুলো বাতি একসাথে নিভে গেল।
কেউ যেন একরাশ কালো কালি ছড়িয়ে দিল শফিকের চোখে। চারপাশে ঘন অন্ধকার। এখাত দুরেও দৃষ্টি চলে না। কোথায় পা ফেলছে, কোথায় যাচ্ছে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। শফিক কোনমতে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে বাতি জালালো।
লোকটা একে বারে ঘাড়ের কাছে এসে পড়েছে। শফিক পাগলের মত দৌড়াচ্ছে। ঘাড়ের উপর লোকটার গরম নিঃশ্বাস পড়ছে। এমনি সময় কিসে যেন পা বেঁধে দড়াম করে আছরে পড়ল শফিক। হাত থেকে মোবাইলটা ছিটকে চলে গেল বহুদূরে।
এবার একেবারে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার।
লোকটার পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সে লোকটাকে দেখতে না পেলেও লোকটা তাকে ঠিকই দেখতে পাচ্ছে। পায়ের শব্দ ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছে। শফিকের হাঁটু ছিলে গেছে।
হাটুর জলুনি উপেক্ষা করেই শফিক আবার উঠে দাঁড়াল। অন্ধের মত আবার দৌড়াতে শুরু করল। কোথায় যাচ্ছে জানে না, শুধু জানে ওই মানুষটার কাছ থেকে সরে যেতে হবে, যতটা দূরে সম্ভব। পেছনের পায়ের আওয়াজও দ্রুত হয়ে উঠেছে। ওর দেখাদেখি ওই মানুষটাও দৌড়াতে শুরু করেছে।
দড়াম করে দেয়ালে বাড়ি খেয়ে পিছিয়ে গেল শফিক। চোখের সামনে এক ঝাঁক লাল নিল তারা ঝিলিক দিয়ে উঠল। মাথা কেটে গেছে, রক্ত বেরুচ্ছে। কিন্তু থামা যাবে না। পেছনে পায়ের আওয়াজ কাছে চলে এসেছে।
শফিক টলতে টলতে দিক পরিবর্তন করে আবার ছুটল। একটু পর হুমড়ি খেয়ে পড়ল এক সারি গাড়ির উপর। নিজেকে সামলে নিয়ে আবার ছুটল।
কিভাবে যে সে বেসমেন্টের সিড়ির গোড়ায় পৌঁছল নিজেই বলতে পারবে না। সিঁড়িতে পৌছে ও নতুন উদ্যম ফিরে পেল।
বের হবার গেট আর বেশি দূরে নয়। বাহিরে মুক্ত বাতাসে এসে ও লম্বা দম নিল। শরীর ঘামে ভিজে গেছে। শার্ট লেপ্টে আছে গায়ের সাথে। পা কাঁপছে, মনে হচ্ছে এক্ষুনি পরে যাবে।
লোকটার চিহ্নও নেই। ওকে তারা করে খোলা রাস্তায় আসার সাহস আপ্স্যনি নিশ্চয়। বেঁচে যাবার উল্লাসে ওর ভেতর থেকে একটা আদম্য হাসি ফেটে বের হল। রাতের রাস্তায় দাঁড়িয়ে শফিক হাসছে উন্মাদের মত।
গাড়িটা যে কখন একেবারে ঘাড়ের কাছে চলে এসেছে শফিক খেয়ালই করেনি।
যখন দেখল তখন আর সময় নেই। হলুদ দুটো হেডলাইটের তীব্র আলোয় ওর চোখ ধাধিয়ে গেল। তারপর একটা প্রচন্ড ধাক্কা। সাথে সাথে সব কিছু ঝাপসা হয়ে গেল।
শফিকের মনে হল ওর উপর একটা দির্ঘ ছায়া ঝুলে আছে।
ছায়াটা ওকে কিছু জিজ্ঞেস করছে। শফিক কথা বলতে চাইল। গলা দিয়ে ঘড়ঘড় ছাড়া আর কোন শব্দ বের হল না। আস্তে আস্তে ছায়াটি অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
(not finished yet....but may not b continued... ) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।