আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দয়াগঞ্জের সুইপার কলোনীর ঐ মানুষগুলো কিন্তু এ রাষ্ট্রেরই

সবকিছুই চুকিয়ে গেছে গালিব! বাকি আছে শুধু মৃত্যু!! শুরু থেকেই আমি বলিউড হিরো আমির খানের টিভি টকশো Satyamev Jayate (Truth Alone Prevails) এর একজন ভক্ত। এটি কোন গতানুগতিক টক শো নয়। সমাজের অনেক বাস্তব অথচ অনুচ্চারিত সত্যকে তিনি এ অনুষ্ঠানটির মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। সিনেমার চরিত্র বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তিনি যেমন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি বা রুচিশীলতার পরিচয় দিয়ে থাকেন তার এই টক শো সেই দৃষ্টিভঙ্গিরই যথাযথ সম্প্রসারণ। এই টকশো-তে আলোচিত ভারতের বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক ও প্রাকৃতিক সমস্যার মাঝে ‘পানি সংকট (Every Drop Counts)’ পর্বটি আমার মনে সবচেয়ে বেশি দাগ কেটেছে।

এ পর্বে পানি সংকটের কারণে ভারতের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ও রাজ্যের মধ্যে তিক্ততা, এ সংকটের কারণ এবং এ থেকে উত্তরণের বিশদ আলোচনা করা হয়। হিন্দী Satyamev Jayate শব্দটির বাংলা অনুবাদ করলে অর্থ দাঁড়ায় ‘শেষ পর্যন্ত সত্যই টিকে থাকে’ অথবা ‘সত্যই জয়ী হয়’। সত্যের প্রতি আমির খানের এতো অবিচল আস্থার পরেও তার এ বিশদ আলোচনায় একটি সত্য কিন্তু ঠিকই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। ভারত কর্তৃক ফারাক্কা বাধ নির্মাণ এবং এক তরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে আমাদের এ অঞ্চলের দুঃখ-বঞ্চনার কথা তার অনুষ্ঠানে একটুও স্থান পায়নি। ভৌগলিক, আঞ্চলিক তথা রাষ্ট্রীয় স্বার্থের নামে অনেক সত্য আড়ালে চলে যায় বা আড়াল করা হয়।

বিশাল হৃদয়ের আমির খানও এ গন্ডির বাইরে আসতে পারেননি। পানির জন্য পদ্মাপাড়ের মানুষগুলোর হাহাকার প্রায়ই মিডিয়ায় ভেসে ওঠে। যান্ত্রিক বা অন্য কোন কারণে পানি সরবরাহ বন্ধ থাকলে আমি নিজেও এ হাহাকারের কষ্ট কিছুটা হলেও অনুভব করি। তবে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে সিটি কর্পোরেশনের পানির গাড়ি ঘিরে পানি সংগ্রহ করতে আসা দয়াগঞ্জ সুইপার কলোনীর নারী-কিশোরীদের চোখে যে হাহাকার বা উৎকণ্ঠা দেখি তার সাথে আর কোন কিছুরই তুলনা চলে না। তাদের চোখের উৎকণ্ঠাটাই জানিয়ে দেয়, এ পানি সংগ্রহ করাটা তাদের জন্য কতোটা প্রয়োজনীয়।

পরিষ্কার বুঝা যায়, পরস্পরের সাথে লড়াই করে করে যে দু-তিন বালতি পানি জুটবে তা দিয়েই মিটবে পরিবারের সকলের তৃষ্ণা, হবে গোসল ও শৌচের কাজ। বিষয়টা নিয়ে ঐ কলোনীতে বাস করেন আমার অফিসের এমন একজন সহকর্মীর সাথে কয়েক দিন আগে কথা হল। তার কাছ থেকে জানলাম ছোট্ট ঐ জায়গাটিতে প্রায় পঞ্চাশ হাজারের মতো মানুষ বাস করেন। পানীয় জলের সংকট ছাড়াও রয়েছে আবাসন ও শৌচাগারের সংকট। রয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সমস্যা।

আছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা। বিভিন্ন সামাজিক ও বেসরকারি সংগঠন এবং তারা নিজেরাও সময়ে সময়ে এসব সমস্যার প্রতিকার প্রার্থনা করে সরকারের কাছে আবেদন করেছেন। কিন্তু পরিবর্তন তেমন কিছুই হয়নি। সে বিবেচনায় আমার মতো একজন নগন্য মানুষ এখানে নতুন করে অনুরোধ করলে সরকার বাহাদুর সেটা শুনবেন তেমনটা চিন্তা করাও অন্যায়। তারপরেও বিবেকের দায় থেকে তাদের অন্যান্য সমস্যাগুলো চেপে গিয়ে শুধুমাত্র আমার নিত্য সকালে দেখা ঐ পানীয় জলের সমস্যাটি নিবারণের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্টদের নিকট ফরিয়াদ জানাচ্ছি।

আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রের নাগরিকদের মৌলিক প্রয়োজনগুলো পূরণের নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে। নাগরিক বলতে এখানে রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে দেশের সকল মানুষকে বোঝানো হয়েছে। নাগরিকের সংজ্ঞায় উচ্চ বা নিম্ন বলে কোন শ্রেণীবিভাগ নেই। নাগরিকদের মৌলিক প্রয়োজনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে খাদ্য। খাদ্যের মাঝে সবার আগে গণ্য পানীয় জল।

নাগরিক হিসেবে এই পানীয় জলের অধিকার দয়াগঞ্জের ঐ সুইপার কলোনীর মানুষগুলোরও আছে। অভিজাত এলাকা ওয়ারী বা আশেপাশের ভদ্র মানুষের স্ত্রীলোকদের পানির জন্য সিটি কর্পোরেশনের পানির গাড়ির পিছনে দৌড়াতে হয় না। রাষ্ট্র তাদের জন্য পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা করেছে। এটা তারা নির্বিঘ্নেই পায়। এক্ষেত্রে সুইপার কলোনীর বাসিন্দাদের দোষটা কী? তারা কেন জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম যতটুকুন পানি প্রয়োজন তা পাবে না? আমাদের রাষ্ট্র বা সরকার কি এতোই দরিদ্র যে দয়াগঞ্জের ঐ সুইপার কলোনীতে একটি পানির পাম্প বসানোর সামর্থ্য রাখেনা? আসলে রাষ্ট্র দরিদ্র নয়।

দরিদ্র হচ্ছেন তারা যারা বছরের পর বছর এটিকে পরিচালনার দায়িত্বে আছেন। দরিদ্র হচ্ছি আমরা। দরিদ্র হচ্ছে আমাদের মন। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।