আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

The Dirty Dhaka – 01

আমি আঁধারে তামাসায় ঘেরা জীবন দেখেছি, আমার বুকের ভেতর শূন্যতা থেকে শূন্যরা এসে বাসা বেঁধেছে, আমি খুঁজেছি তোমাকে সেই আঁধারে আমার মনের যত রঙলীলা; আজ সাঙ্গ হতেছে এই ভবের বাজারে। ঢাকা, মনে হয় যেন এর সবকিছুই ঢাকা। কিন্তু পথ চলতে গেলেই বোঝা যায় নামের সাথে এর কোন সার্থকতা নেই। সবটাই এর উন্মুক্ত। বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে পরিচিত এই ঢাকার নামকরণের সঠিক ইতিহাস নিয়ে ব্যাপক মতভেদ রয়েছে।

কথিত আছে যে, সেন বংশের রাজা বল্লাল সেন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরবর্তী এলাকায় ভ্রমণকালে সন্নিহিত জঙ্গলে হিন্দু দেবী দুর্গার একটি বিগ্রহ খুঁজে পান। দেবী দুর্গার প্রতি শ্রদ্ধাস্বরূপ রাজা বল্লাল সেন ঐ এলাকায় একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। যেহেতু দেবীর বিগ্রহ ঢাকা বা গুপ্ত অবস্থায় খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো, তাই রাজা, মন্দিরের নাম রাখেন ঢাকেশ্বরী মন্দির। মন্দিরের নাম থেকেই কালক্রমে স্থানটির নাম ঢাকা হিসেবে গড়ে ওঠে। আবার অনেক ঐতিহাসিকের মতে, মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর যখন ঢাকাকে সুবা বাংলার রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন; তখন সুবাদার ইসলাম খান আনন্দের বহিঃপ্রকাশস্বরূপ শহরে 'ঢাক' বাজানোর নির্দেশ দেন।

এই ঢাক বাজানোর কাহিনী লোকমুখে কিংবদন্তির রূপ নেয় এবং তা থেকেই শহরের নাম ঢাকা হয়ে যায়। এখানে উল্লেখ্য যে, মোঘল সাম্রাজ্যের বেশ কিছু সময় ঢাকা সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রতি সম্মান জানিয়ে জাহাঙ্গীরনগর নামে পরিচিত ছিলো। আবার অনেকের মতে, একসময় এই অঞ্চলটিতে ঢাক নামের প্রচুর গাছ বিদ্যমান ছিল। সেই ঢাক গাছের নাম অনুসারেই এই অঞ্চলের নাম করন করা হয়েছে। ঢাক গাছ বলতে আসলে পলাশ ফুলের গাছকেই বঝানো হয়ে থাকে।

সে যাই হোক, ঢাকা নগরীকে বর্তমানে দুইভাগে বিভক্ত করা হয়েছে - ঢাকা দক্ষিণ ও ঢাকা উত্তর। ঢাকা দক্ষিণই মূলতঃ মূল নগরী। ঢাকা উত্তর ঢাকার নবীন বর্ধিত উপশহরগুলো নিয়ে গঠিত। ঢাকা একটি মেগাসিটি এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রধান শহরও বটে। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত এই শহর বাংলাদেশের বৃহত্তম শহর।

ঢাকার মহানগর এলাকার জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ। এটি বিশ্বের নবম বৃহত্তম এবং সর্বাপেক্ষা ঘন জনবহুল শহরগুলির অন্যতম। ঢাকা শহরটি মসজিদ শহর নামেও পরিচিত। এখানে বিশ্বের সেরা মসলিন উৎপাদিত হত। এছাড়া ঢাকা বিশ্বের রিকশা রাজধানী নামেও পরিচিত।

এই শহরে রোজ প্রায় ৪০০,০০০টি সাইকেল রিকশা চলাচল করে। বর্তমানে ঢাকা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রধান সংস্কৃতি, শিক্ষা ও বাণিজ্যকেন্দ্র। সপ্তদশ শতাব্দীতে মুঘল শাসকদের অধীনে এই শহর জাহাঙ্গীর নগর নামে পরিচিত ছিল। সে যুগে ঢাকা ছিল প্রাদেশিক রাজধানী এবং বিশ্বব্যাপী মসলিন বাণিজ্যের একটি কেন্দ্র। যদিও আধুনিক ঢাকা শহরের বিকাশ ঘটে ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ শাসনে।

এই সময় কলকাতার পরেই ঢাকা বাংলা প্রেসিডেন্সির দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী হয়ে ওঠে। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের পর ঢাকা নবগঠিত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের রাজধানী হয়। তবে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ প্রত্যাহৃত হলে ঢাকা তার প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদাটি হারায়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর ঢাকা পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনিক রাজধানীতে পরিণত হয়। পরে ১৯৭১ সালে ঢাকা স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাজধানী ঘোষিত হয়।

ইতিপূর্বে সামরিক আইন বলবৎ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা, সামরিক দমন, যুদ্ধ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের তাণ্ডবলীলার মতো একাধিক অস্থির ঘটনার সাক্ষী থাকে এই শহর। আধুনিক ঢাকা বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবনের প্রধান কেন্দ্র। এই শহরের নগরাঞ্চলীয় অবকাঠামোটি বিশ্বে সর্বোন্নত হলেও দূষণ, যানজট এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে যথেষ্ট পরিষেবার অভাব ইত্যাদি শহুরে সমস্যাগুলি এখানে প্রকট। সাম্প্রতিক দশকগুলিতে ঢাকার পরিবহন, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও গণপূর্ত ব্যবস্থায় যে আধুনিকীকরণ হয়েছে, তা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বর্তমানে এই শহর প্রচুর বিদেশী বিনিয়োগ টানতে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিধি বাড়াতে সক্ষম হয়েছে।

সারা দেশ থেকে প্রচুর মানুষ ঢাকায় আসেন জীবন ও জীবিকার সন্ধানে। এই কারণে ঢাকাও হয়ে উঠেছে বিশ্বের দ্রুততম ক্রমবর্ধমান নগরী। আমার এই পোস্টটি মূলত ঢাকার ইতিহাস নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনার জন্য নয়, যদিও জ্ঞানগর্ভ পোস্ট নিয়ে আমার অনেক দুর্নাম রয়েছে। আমি ঢাকার একজন সন্তান হিসেবেই আমার ক্যামেরায় তোলা ঢাকার কিছু অসঙ্গতি নিয়ে এই পোস্টের আয়োজন করেছি। যেখানে ছবির সাথে আমার দৃষ্টিতে উঠে আসা অসঙ্গতিগুলো নিয়ে কিছুটা আলোচনা করব।

ঢাকার প্রধান সড়ক গুলোর যেদিকটি প্রথমেই নজরে আসে আর তা হল নানা প্রকার দোকান দিয়ে ফুটপাথের অবৈধ দখল, ভ্রাম্যমান দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংসার, ময়লার ডাস্টবিন, বারবার করে খোঁড়া রাজপথ, অলি-গলি কখনো ডেসকো, কখনো টি এন্ড টি কিংবা কখনো তিতাসের মেরামতের প্রয়োজনে। হায় একবারেই যে কেন এ দেশে এমন মেরামত সম্ভব হয়ে উঠে না নাকি সব পকেট ভর্তি করার উপায় সেটা বোঝা বড় দ্বায়। তাইত পথ চলতে গিয়ে নাক চেপে ধরা দুর্গন্ধ হতে বাঁচতে গিয়ে। তবে এসব কিছুর মাঝেও রিক্সায় ভ্রমন বেশ উপভোগ করার মতই একটি বিষয়। কোটি টাকা দিয়ে নির্মাণ করে রাখা হয়েছে ফুট ওভার ব্রিজ নামক নিছক যন্ত্রণা।

যেখানে আছে সেই একই অবস্থা। হকার আর ছিনতাইকারীদের জ্বালাতন তাইত সময় বাঁচানর নামে অনেকেই মৃত্যু ভয় উপেক্ষা করেই রাস্তা পার হয় ব্যাস্ত সড়কের মাঝেই। আর মৃত্যু হলে দোষ হয় বেপরোয়া গতির গাড়ির ড্রাইভারের উপর। এরপর গাড়ি ভাঙা, হরতাল, আন্দোলন, মিছিল, সমাবেশ আরও কত কি তাই নিয়ে ঘটে যায়। যেখানে গন্তব্যে পৌঁছানোর কথা আধা ঘণ্টায় সেখানে দুই থেকে টিন ঘণ্টা শুধু জ্যামেই বসে থাকা।

এত গাড়ি আর এত জনগণ। পুরো জ্যামেই বসে থেকে কেটে যায় আসা আর যাওয়াতেই চার ঘণ্টা অর্থাৎ জীবন থেকে একে একে নষ্ট হয় চারটি করে ঘণ্টা। এভাবে জ্যামে বসে না থেকে উপায় কি? অথচ একটু উন্নত ট্রাফিক ব্যাবস্থা আর ভোগবিলাসের গণ্ডি হতে বের হতে পারলেই জ্যাম কমে যেতে পারে কারন এই শহরে বিকল্প সড়কের কোন অভাব চোখে পরার মত নেই। তবে একেবারেই যে অপরিকল্পিত ট্রাফিক ব্যাবস্থা সেটা ঠিক বলা যাবেনা। অনেক সময় সুন্দর লেন মেনেও গাড়ি চলতে দেখা যায় সড়কগুলোতে।

সবচেয়ে সুন্দর লাগে দুটি ঈদের সময়। মনে হয় যেন অতি পরিচিত এই ঢাকা নগরী যেন হঠাত করেই কোন এক রূপকথার দেশের রূপ ধারন করে। কোথাও কোন জ্যাম নেই। যেখানে পৌঁছে যাবার কথা আধা ঘণ্টায় সেখানে পৌছাতে সময় লাগে পনের মিনিট। ঈশ ! যদি এমনই থাকত বছরের বাকি দিনগুলোতে।

এটা তখনই সম্ভব যখন ঢাকা কেন্দ্রিক একক অফিস, আদালত, ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান, বিদ্যালয়গুলো বিকেন্দ্রিকরন করা হবে। কখনো সাস্থ সচেতন এমন প্রেমিক যুগল দেখতেও ভীষণ ভাল লাগে। মনে হয় যেন এইত বেঁচে থাকার নির্মল আনন্দ। একটুকরো মাটি কোথাও ফাঁকা পাওয়া যাবেনা যেখানে নতুন আবাসস্থল হতে পারে। তবু চলছে বাড়ি নির্মাণের মহাধুম।

ঢাকা কিংবা ঢাকার অদূরে যেখানেই একটু মাটির সন্ধান মিলছে সেখানেই রিয়েল এস্টেট নামক ভূমি খেকোরা খেয়ে নিচ্ছে বাড়ি বানিয়ে মাটি। আর সবুজের সন্ধান শুধু এ, বি অথবা পামকিন, রজনীগন্ধা নামক ফ্ল্যাটের বারান্দায় লাগান টবে ফুলের গাছেই শোভা পায় আর ততটুকুই আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেনের প্রয়োজন মিটিয়ে নানা রকম রোগের সন্মুখিন করে তুলছে। মাঝখান দিয়ে পকেট গরম হচ্ছে প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর। খোলা মাঠে গিয়ে কোথায় একটু গোধূলি আকাশটাকে একটু মায়া ভরা চোখে দেখে নিয়ে প্রেমের কবিতা লিখব তা নয় বাড়ির ছাঁদেই বসে থেকে দুধের সাধ ঘোলে মেটাতে হয়। আর বাচ্চারা খেলার মাঠের অভাবে ভুলেই গেছে গোল্লাছুট কিংবা দাড়িয়াবান্ধা খেলা নামের কোন খেলা এই দেশে আছে।

তারা শুধু কম্পিউটারে গেমস খেলেই অকালে পরছে চোখে চশমা। ঢাকার কোথাও কোন নির্দিষ্ট বাস স্টপেজ তেমন চোখে পরেনা। পরলেও সেখানে গাড়ি থামতে দেখা যায় কদাচিৎ। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত একই চিত্র সর্বত্র। মানুষ তার গন্তব্যে পৌছাতে অধীর আগ্রহ নিয়ে দাড়িয়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

কখন একটি বাস এসে সামনে দাঁড়াবে আর ওমনি মারামারি করে হলেও গাড়িতে চড়তে হবে। তবু গাড়ি থামে কখনো লোকের ভিড় নিয়েই, কখনো থামেনা আবার হয়ত কখনো থামে কিছু খালি সিট নিয়ে। এমন অবস্থার পরিবর্তন তখনই সম্ভব যখন পর্যাপ্ত পরিমান গাড়ি থাকবে আর থাকবে নির্দিষ্ট স্টপেজ। মানুষ সেখান থেকেই গাড়িতে উঠবে যত্রতত্র যেখান থেকে খুসি সেখান থেকে নয়। ছোট বেলায় একটি কবিতা পড়েছিলাম যে, আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে বৈশাখ মাসে তার হাটু জল থাকে পার হয়ে যায় গরু, পার হয় গাড়ি দুই ধার উঁচু তার ঢালু তার পাড়ি এই কবিতাটির সাথে বর্তমান ঢাকার দারুন মিল খুঁজে পাই।

পুরো ঢাকার প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে আজ একই চিহ্ন। বৃষ্টি হলেই কোমর পানিতে ডুবে যায় ঢাকার সড়কগুলো অপরিকল্পিত পয়নিষ্কাশনের কারনে। যেখানে বিদ্যুৎ সমস্যা আজ সারা দেশ জুড়েই, সেখানে ঢাকা বিদ্যুৎ বিহীন ঘণ্টায়-ঘণ্টায় এটা নতুন কিছুই নয়; তবে এমন সুন্দর আলোক ঝলমলে ঢাকা দেখে নতুন করে স্বপ্ন দেখি একটু সুন্দর করে বেঁচে থাকার। আমাদের এই তিলোত্তমা ঢাকায় আমাদের যাপিত জীবনের আলোকিত স্বপ্ন নিয়ে প্রতিদিনের মতই রাত হয় রঙিন আশা নিয়ে। একটি ধারাবাহিক আয়োজন।

 ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।