আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্পঃ অশরীরীর অমরত্ব

আমি সাইফুল্লাহ সাইফ । পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে "ইনফরমেইশন এন্ড কমুনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং" বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষে পরছি । অনেক কিছুই ভালো লাগে; বই পড়া, ভ্রমন করা, গান শুনা আরও আনেক । একজন সৎ আদর্শবান মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখি । নিজে লেখালেখি করি, এ ছবি: ওয়েব সাইট আসিফ মাহমুদ দীর্ঘদিন ধরে একটি জোছনার অপেক্ষায় ছিলেন ।

সারারাত টেলিস্কোপ হাতে নিয়ে অসহায় হয়ে বসে থাকতেন আকাশের দিকে চোখ তুলে । আকাশের মেঘগুলো বড় এলোমেলো করে দিত তাঁকে । জোছনাকে তার কাল রঙের বিশালাকার শাড়ির আঁচলে ঢেকে রাখত । মাঝে মাঝে যখন বাতাসে শাড়ির আঁচলটি সরে গিয়ে ভেতরের অনাবৃত রমণীকে তিনি দেখতে পেতেন তখনই তার সমস্ত দেহ জুড়ে এক শিহরণ অনুভব করতেন । তার চেহারায় একটি ক্ষণস্থায়ী বিদ্যুৎ প্রবাহ বয়ে যেত ।

যেন এই মাত্র তার চোখে আকাশের বিজলী রশ্মির এক ফোঁটা তাকে ছুঁয়ে দিয়ে দূরে কোথাও উধাও হয়ে গেল । তার চোখ ঝলসে দিয়ে চোখের পলকে সে আলোক রমণী অদৃশ্য হয়ে যেত । আসিফ মাহমুদ একটি ছবি আঁকবেন । রাতের অনাবৃত জোছনার । যখন আকাশের একটি তারাও থাকবে না, একগুচ্ছ মেঘও নয় ।

যখন আকাশের উত্তপ্ত যৌবন থাকবে জোছনার শরীর জুড়ে । জোছনার রূপের দ্রুতি নিয়ে আলোকিত হয়ে উঠবে পুরো পৃথিবী । একটি রাতের জোছনাকে তুলে আনবেন তুলির আঁচড়ে । নিজের মনের চিত্রটি রূপ দেবেন রঙের ভাষায় । চিত্রশিল্পীর রঙ কথা বলে ।

শিল্পীর সাথে হাসে-কাঁদে, অনুভুতি বিনিময় করে । আসিফ মাহমুদ একটি চিলেকোঠার খুপরিতে থাকেন । খুপরির সামনের বিস্তৃত ছাদ তাঁকে প্রতিরাতে জোছনা দেখাতে ডাকে । তিনি জোছনায় ছবি আঁকার বন্দোবস্ত করেন । সব কিছুই যখন ঠিকঠাক করে তিনি ক্যানভাসের উপর রংতুলি স্পর্শ করেন তখনি যেন জোছনা একটু একটু করে নিজেকে লুকাতে শুরু করে তাঁর কালো শাড়ির অন্তরালে ।

তাঁকে শুধু নিজের ছায়াটুকু দেখায় । মূর্ত হয়ে কখনো ফুটে উঠার সুযোগ দেয় না শিল্পীর বিমূর্ত ছবিতে । নিশাচারি ক্ষুদার্ত শিকারির মত রাতভর তিনি অপেক্ষা করতে থাকেন একটি কাঙ্খিত জোছনার জন্য । তার বহুদিনের অতৃপ্ত শিল্প সত্ত্বা এমন একটি ছবি আঁকতে চায়, যার নিখুঁত শিল্পে এমন একটি ছবি ধরা দেবে, যে ছবিকে তার সারা জীবনের শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্মে স্থান দেয়া যেতে পারে । আজ আসিফ মাহমুদের স্বপ্ন পূরণ হতে চলছে ।

তার দক্ষ চালনায় রঙ তুলি একের পর এক ধারণ করে চলছে জোছনার বিমূর্ততা । সৃষ্টির আনন্দে তার পুরো শরীর কাঁপছে । আজ তার জীবনের সফল শিল্পের একটি সৃষ্টি হতে যাচ্ছে । হঠাৎ নিজের অসমাপ্ত ক্যানভাসের গভীরে কোথাও যেন তার চোখ আটকে যায় । তিনি চমকে উঠেন ।

যেন এতক্ষণ ধরে তিনি জোছনার নয়, কোন এক মানবীর চিত্র ধারণ করে চলেছেন তার রঙ তুলিতে । যেন তারই হাতে গড়া কোন এক মানবী পুরো দেহে জোছনার রঙ মেখে বসে আছে । আসিফ মাহমুদ ছবি আঁকা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ান । তিনি বুঝতে পারছেন না, জোছনা কীভাবে এক নারীমূর্তি ধারণ করল! ব্যাপারটা কেন এতক্ষণ তার চোখে পড়ল না! কোথাও একটি হাসির শব্দ শুনতে পেলেন তিনি । ক্যানভাসে ফিরে তাকাতেই তিনি দ্বিতীয়বারের মত চমকে উঠলেন ।

তার ক্যানভাসে এবার এক জীবন্ত নারী তার দিকে তাকিয়ে হাসছে । চলচিত্রের পর্দার মত জীবন্ত সে নারী । তাঁর হাসি যেন কোন এক আলোক বর্ণালীর বিচ্ছুরিত ফোয়ারা । মুহূর্তেই আসিফ মাহমুদের বুকের কোথাও যেন একটি নিরবচ্ছিন্ন কম্পন শুরু হল । একটি শীতল প্রবাহ যেন সরীসৃপের মত তার মেরুদণ্ড বেয়ে নিচের দিকে নেমে যেতে শুরু হলো ।

আসিফ মাহমুদ উত্তেজিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, ‘কে তুমি?’ একটি ক্ষীণ অথচ তীক্ষ্ণ জবাব, ‘আমি অশরীরী । ’ অশরীরী শব্দটি যেন আসিফ মাহমুদের কানে এসে সাইরেনের মত বেজে চলল অনবরত । তার মাথায় একটি প্রদাহ শুরু হলো । আসিফ মাহমুদ একটু সময় নিলেন । নিজের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করলেন ।

এমন কী হতে পারে তিনি কল্পনা করছেন? তার সন্ধেহ, তিনি স্বপ্ন দেখছেন । স্বপ্নে অনেক কিছুই সম্ভব । ওসব তিনি বিশ্বাস করেন না । এবার একটি উচ্চহাসির শব্দ তরঙ্গিত হয়ে বায়ু মাধ্যমে অনেক দূরে কোথাও একাত্ম হয়ে মিলে গেলো । আসিফ মাহমুদ নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘মিথ্যে বলছ ।

তুমি শুধু আমার কল্পনা । আমি অলৌকিকতায় বিশ্বাস করি না । আমি কল্পনা থেকে ফিরে এলেই তোমার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে । তুমি তোমার হাসির মতই উধাও হয়ে যাবে । তোমার অস্তিত্ব অসম্ভব, আমি বিশ্বাস করি না ওসব ।

অশরীরী বলে কিছু নেই । ’ একটু যেন অভিমানের ভঙ্গীতে মেয়েটি প্রশ্ন করল, ‘তাহলে আমি কে?’ আসিফ মাহমুদ বললেন, ‘তুমি মানবী । আমার কল্পনা, যাকে আমি সৃষ্টি করেছি, লালন করছি । যার ধ্বংসও আমি করতে পারি । এখনি তুমি চলে যাবে ।

’ আসিফ মাহমুদ চোখ বন্ধ করলেন । আবার চোখ খোলার আগেই তিনি ধ্বংস করে ফেলবেন তাঁর কল্পনাকে । চোখ খোলার আগেই মেয়েটি বলে উঠল, ‘তুমি আমাকে ধ্বংস করতে পারবে না, যতদিন না নিজে ধ্বংস হবে । হ্যাঁ–মানছি, তুমি আমাকে লালন কর, তবে তা শুধু নিজের বাঁচার জন্য । আমি জানি, তুমি যেদিন থেকে তোমার প্রিয়তমাকে হারিয়েছ, সেদিন থেকেই আমাকে লালন করে আসছ ।

তুমি যতদিন বেঁচে থাকবে আমাকে ততদিন তোমার নিজের ভেতর বাঁচিয়ে রাখবে । ’ আসিফ মাহমুদ চোখ খুললেন । তাকে হতাশ করে দিয়ে মেয়েটি পুনরায় বলল, ‘কী বললাম না, আমাকে ধ্বংস করতে পারবে না, আমি শুধু তোমার কল্পনা নই?’ ‘অশরীরীর কোন দৈহিক অস্তিত্ব নেই । অথচ কী অবলীলায় তুমি কথা বলছ, হাসছ, তুমি স্বশরীরী এক জীবন্ত নারীর মত আমার চিত্রে উঠে এসেছ, কিন্তু বলছ অশরীরী!’ ‘তোমরা শিল্পীরা অশরীরীদের মানবী ভেবে ভুল কর । মানবীরা কখনো চিত্রে আসে না ।

’ ‘তুমি ভুল বলছ । পৃথিবীর সব বিখ্যাত চিত্রকর্মই মানবীর আদলে গড়া । কখনো তাতে অশরীরী স্থান পায়নি । ’ ‘একটি ছবি বেঁচে থাকে যুগযুগ ধরে । জরা-মৃত্যু কখনো ছুঁতে পারে না ছবিকে; সময় ছবির বয়স বাড়াতে পারে না ।

অথচ তোমাদের মানবীরা ক’দিন বাঁচে, বল!’ ‘চিত্রশিল্পীরা তাদের অমরত্ব দেয় । সেই অমরত্ব নিয়েই তাঁরা বেঁচে থাকে যুগের পর যুগ । ’ ‘তোমাদের মানবীরা আমাদের অতীত, আমাদের দীর্ঘজীবনের এক স্বল্প পরিচিতি মানবীররূপ । চিত্রকরের দেয়া অমরত্ব আমাদের জন্য । তোমরা মানবীর যে ছবি আঁক তা অশরীরীদের একটি বেশ মাত্র ।

’ আসিফ মাহমুদ এবার ঘুরে তাকান আকাশের জোছনার দিকে । জোছনা আবার নিজেকে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে ফেলছে । তার ক্যানভাসের চিত্রের সাথে জোছনার পার্থক্য বেড়ে চলছে । অশরীরী একটু যেন ঠোঁটের কোনে সামান্য হানি এনে বলল, ‘কী! ছবি আঁকা বন্ধ করলে যে!’ আসিফ মাহমুদ একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘আমি জোছনার ছবি আঁকতে ছেয়েছিলাম, কোন অশরীরীর ছবি নয় । ’ অশরীরী এবার কোমল কণ্ঠে বলল, ‘তোমার প্রতীক্ষিত জোছনাই আমি ।

ক্যানভাসের মত অন্তদৃষ্টি দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে দেখ । ’ আসিফ মাহমুদ এবার আকাশে চোখ রাখলেন । ‘কী কোন মিল খুঁজে পাও! জোছনাই আমার আরেকটি সত্ত্বা । এবার আমায় বিমূর্ত অস্তিত্ব থেকে মূর্তে অমরত্ব দাও । আমি মানবের মাঝে অমরত্ব চাই ।

’ সাইফুল্লাহ সাইফ  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।