আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্পঃ মিল



রিকশার প্যাডেলে দ্রুত পা চালায় করিম মিয়া । প্রত্যাশা অনুযায়ী রিকশার গতি বাড়েনা তেমন । রাস্তা ঘাট ভেঙ্গে অবস্থা খারাপ । দশ মিনিটের পথ পেরোতে ঘন্ট পেরিয়ে যায় । বৃদ্ধ সাদা দাড়ি আর চুল পাকা রিকশা ওয়ালা করিম।

তবে রুগ্ন নয় । বয়স ৬০এর কোঠা পেরোলেও এখনও বেশ শক্ত সমর্থ্য সে । : হালার রাস্তা ঘাট বাইচতে ঠিক অইবনা ! মনে মনে আফসোস করে করিম। ছোট খাট একটা গ্রাম্য বাজার । বাজারের পাশে প্রাইমারি স্কুল ঘর ।

আর এই স্কুল ঘরের পাশেই রাস্তা সংলগ্ন মাঠ মত একটা জায়গা । এখানেই এসে রিকশা থামায় করিম । তারমত আরও অনেকেই এখানে রিকশা নিয়ে যাত্রীর আশায় দাড়িয়ে আছে । রিকশার ষ্টেশন বলা যেতে পারে জায়গাটাকে । : কি রহিম্মা ! কয় টিপ মারলি ।

পাশের আরেক রিকশাওয়ালাকে প্রশ্ন করে ও । : কাকা একটা মাত্তর । তাও লসের কোঠায় !হালার কপাল ! : কেমতে ? ছেলেটার কথায় কৌতুহল জাগে করিমের মনে । : ভাঙ্গা রাস্তা । থেতনায় চাকার রিং গেছে বেকা হয়ে ।

গেছি সারাইতে ,কয় তিরিশ টেকা মজুরি । : দুঃখ করিস নারে ! আপনিই কপাল ফিরব । : হ ! আর ফিরব কই ? বেশ বিরুক্ত গলায় শেষে উত্তর দেয় রহিম । করিমও আর কথা বাড়ায় না । রিকশাটা ডানে রাস্তার পাশে দাড় করিয়ে সিটে বসে পড়ে হেলান দিয়ে ।

: করিম্মা যাবি নাকি ? সহসা স্বরটা শুনে চমকে উঠে বসে করিম । চেয়ারম্যান সাহেব । বয়সে ওর অনেক ছোট । কিন্তু টাকা আর প্রতিপত্তিতে করিম কোন ছার ! তাই হয়তো সম্মোধন হিসেবে 'তুই' টাই মানান সই । : হ !কই যাবেন চেয়ারম্যান সাব ? আলেন কইত্তে ? : বাড়ির দিকে চল ! লাফ দিয়ে রিকশায় উঠে পড়ে চেয়ারম্যান ,রমিজ উদ্দিন ।

বাজারে বেশ ভিড় আজ । হাটবার তো । বাজারটা পেরোতেই বেশ কষ্ট পুহাতে হয় করিমের । ডানহাতে বৃদ্ধাঙ্গুলিটা ৭১এর সময় হানাদার বাহিনী কেটে নিয়ে ছিল । তাই বেল বাজাতে বেশ কষ্ট হয় তার ।

: ঐ মিয়া ,তাড়া আছে !জলদি যাও .. চেয়ারম্যানের মেজাজটা আজ খুব চড়া হয়ে আছে । অবশ্য চড়া হবার কারনও একটা আছে । বিশেষ করে করিমের উপর । ৭১এ মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল করিম । স্বাধীনতার পর যখন বাড়ি ফেরে দেখে সব খালি ।

মা ,বাবা ,বড় ভাই কেউই বেচে নেই । এরপর ৭৫এর শেষের দিকে বিয়ে করেও । লেখাপড়া তেমন একটা নাই তার । অগত্যা ভাড়া রিকশা চালানোই সই । ১৯৮০র শেষের দিকে জন্ম নিল ওর মেয়ে ।

এরপর কলেরায় মরল স্ত্রী । সুখে ,দুঃখে কাটাকাটি করে মেয়েটার মুখ চেয়ে বেশ চলে যাচ্ছিল দিন । কিন্তু মেয়েটা বড় হতেই হল কাল । চেয়ারম্যান সাবের স্ত্রী সম্প্রতি মারা গেছে । এখন তার নতুন বিবি চাই ।

আর পছন্দ এসে ঠেকল করিমের বাড়িতেই । ওর মেয়ে সখিনাকেই চাই ওনার । : ওই থাম !কই চাইয়া রিকশা চালাস ? চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ি চলে এসেছে । রিকশা থেকে নেমে পড়েন ওনি । তারপর ভাড়া মিটিয়ে হন হন করে চলে যান গেট পেরিয়ে বাড়ির ভেতর ।

: ঐ মিয়া খাড়াও ! করিম রিকশার প্যাডেলে পাড়া দিতে না দিতেই কে যেন বাঁজখাই গলায় চেচিয়ে উঠে । তাকিয়ে দেখে ,আমিন । এক নাম্বারে বদমাস ব্যাটা । চেয়ারম্যানের চামচা । দাড়িয়ে পড়ে ওঁ ।

: হোন করিম মিয়া । চেয়ারম্যান সাবের মাথা কিন্তুক বেশি দিন আর ঠান্ডা থাকব না ?ঠান্ডা থাকতে থাকতেই কামডা সাইরা ফেলাও । : কিয়ের কাম ? সহসা হুমকির মানে বুঝে আসেনা করিমের । : ভান ধর না ?ধর ভান যত ইচ্ছা ধর ! ইমুন কাম কইরা দিমু মাইয়া বিয়া দিতে রাস্তার একটা কুত্তাও পাইবানা । লজ্জায় ঘৃনায় চোখে জল আসে করিমের ।

নাহ্ ! জীবনটা অতিষ্ট করে তুলেছে ওরা । মেয়েটাকে নিয়ে আর বুঝি এই গ্রামেই থাকা যাবেনা । আমিনের কথায় কোন উত্তর দেয়না ও । দ্রুত প্যাডেলে পা চালায় । : ফক্কিনির পোলার দেমাগ দেখছ .. পেছন থেকে আমিনের গজরানি কানে আসে করিমের ।

*** মধ্যরাত । নিঝুম নিঃশব্দ চারদিক । মাঝে দু একটা রাতজাগা পাথি কিংবা কুকুরের ডাক কিছুখনের জন্য একটু পর পর নিরবতা খান খান করে দিচ্ছে । কিন্তু পরক্ষনেই আবার এক ঝাক নিরবতা ছেকে ধরছে চারদিক । মাঠের পাশেই করিমের কুড়ে ।

চাঁদের আধো আলোয় হঠাত্ করেই কয়েকটা ছাড়া মূর্তি দেখা যায় কুড়েটায় পাশে । ওদের হাটা চলা ,খসখসানি ,চুপি চুপি আলাপ তারপর দরজা ভাঙার শব্দ ! একটানা কয়েক সেকেন্ড নিরবতা । তারপরই উঠে কান্না চিত্কার চেচামেচির শব্দ । : ও বাজান !বাজান .. সখিনার করুন চিত্কার ভেসে আসে । : এই চুপ থাক ! তারপরই কারও শাসানির আওয়াজ ।

দ্রুত করিম উঠে বসে বিছানায় । অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে চারপাঁচজনের একটা দল ,কালো কাপড় মুখে বাঁধা ওর ঘরে । দুজন সখিনাকে বেঁধে তুলে নিয়েছে কাঁধে । : ঐ ক্যাডা তোরা !আমার মাইয়ারে কই ন্যাস ? বলেই লাঠি হাতে উচিয়ে যায় করিম । কিন্তু এত জনের সাথে পারবে কেন ? দুজন ওকে নাকে মুখে ঘুসি দিয়ে বেড়ার দিকে ছুড়ে মারে ওকে ।

মুলি বাঁশের বেড়ার খাজে গিয়ে লাগে সেই কাঁটা বৃদ্ধাঙ্গুলিটা । গলগল করে রক্ত পড়তে থাকে সেখান থেকে । : মিল ..বড্ড মিল .. ক্ষতস্থানে তাকিয়ে বিড়বিড় করতে থাকে করিম। এক বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধা এবং পরাজয়ী বাবা !


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।