আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ডে আলবদর

বুদ্ধিজীবী কারা? বাংলা একাডেমী ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ’ নামে যে গ্রন্থ প্রকাশ করেছে তাতে বুদ্ধিজীবীদের যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে আমরা তা গ্রহণ করতে পারি : ‘বুদ্ধিজীবী অর্থ লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, সকল পর্যায়ের শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারী ও বেসরকারী কর্মচারী, চলচ্চিত্র ও নাটকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সমাজসেবী ও সংস্কৃতিসেবী। ’ পাকিস্তানীরা বুদ্ধিজীবীদের টার্গেট করেছিল কেন? এর একটি কারণ, পাকিস্তানী শাসকচক্র বাঙালী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থান ও প্রভাবকে মেনে নিতে পারেনি। তাদের ধারণা ছিল, এ শ্রেণীর প্রেরণাদাতা হচ্ছে বুদ্ধিজীবীরা। জেনারেল ফজল মুকিম খান ১৯৭৩ সালে লিখেছিলেন, বাঙালীদের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো ষাটের দশকে সারা পূর্ববাংলায় ছড়িয়ে পড়ে মানুষকে প্রভাবিত করে তোলে পাকিস্তানী শাসনের বিরুদ্ধে। এ কথাগুলো সত্যি যে, ১৯৫২ থেকে ১৯৭১, এমনকি ১৯৭১ থেকে এখন পর্যন্ত সমস্ত গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সংস্কৃতিসেবীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।

আমাদের অনেকের চোখে তা এড়িয়ে গেছে। পাকিস্তানীরা তা ঠিকই পর্যবেক্ষণ করেছে। ফলে, এক ধরনের বিশেষ ক্রোধ ছিল বুদ্ধিজীবীদের ওপর। অপর আরেকটি কারণ হলো, যদি বাঙালীরা জিতেই যায় তারা যেন নেতৃত্বহীন থাকে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ‘কোষগ্রন্থ’-এ যে যুক্তিটি দেয়া হয়েছে তা যুক্তিযুক্ত ‘এটা অবধারিত হয়, বুদ্ধিজীবীরাই জাগিয়ে রাখেন জাতির বিবেক, জাগিয়ে রাখেন তাদের রচনাবলির মাধ্যমে, সাংবাদিকদের কলমে, গানের সুরে, শিক্ষালয়গুলোতে পাঠদানে, চিকিৎসা প্রকৌশল রাজনীতি ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণের সান্নিধ্যে এসে।

একটি জাতিকে নিবীর্য করে দেবার প্রথম উপায় বুদ্ধিজীবীশূন্য করে দেয়া। ২৫ মার্চ রাতে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল অতর্কিতে, তারপর ধীরে ধীরে, শেষে পরাজয় অনিবার্য জেনে ডিসেম্বর ১০ তারিখ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে দ্রুতগতিতে। ’ “স্বভাবতই পাকিস্তানী সেনাপতি ও সিআইএ-চরদের মধ্যকার এই যোগাযোগ গোপন ব্যাপার ছিল। আলবদর বাহিনীর সাধারণ কর্মীরা এ সম্পর্কে কিছুই জানত না। আবার এই সন্ত্রাসবাদী সংস্থার হোতারা এবং জামায়াতে ইসলামী দলের নেতারা অনুগামীদের মনোবল বাড়ানোর আশায় আমেরিকা ও পিকিং নেতাদের সঙ্গে পাকিস্তানের সামরিক একনায়কের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সম্পর্কের কথা প্রচার করত।

১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর ঢাকায় জামায়াতে ইসলামীর সম্পাদক প্রকাশিত এক প্রচারপত্রের ভাষা হলো : “বিদেশে আমাদের বন্ধুরা আছেন। চীন ও আমেরিকা আমাদের সমর্থক বন্ধু-দেশ। ” [একাত্তরের ঘাতক দালালরা কে কোথায় গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত। ] বুদ্ধিজীবী হত্যায় প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল আলবদর বাহিনী। সারা পাকিস্তান আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী।

আলবদর হাইকমান্ডের যারা এখন স্বাচ্ছন্দ্যে টাকা-পয়সা করে রাজনীতি করছে তাদের মধ্যে নিজামী ছাড়াও আছে জামায়াতের আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, মীর কাসেম আলী, আবদুল কাদের মোল্লা, মোহাম্মদ ইউনুস, মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, আশরাফ হোসাইন, মোহাম্মদ শামসুল হক, আ শ ম রুহুল কুদ্দুস, সরদার আবদুস সালাম, আবদুল জাহের, মোহাম্মদ আবু নাসের প্রমুখ। জেনারেল জিয়া ওদের পুনর্বাসিত করেন। এদের চেলাচামু-াদের মধ্যে ছিল খালেক মজুমদার, ‘মওলানা’ মান্নান, আবদুল আলীম ও চৌধুরী মঈনুদ্দিন। সারাদেশে, বিশেষ করে ঢাকায় এ রকম অনেক ছোট আলবদর ছিল। আলবদরদের সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি।

জানার বা তালিকা প্রণয়নের চেষ্টাও করা হয়নি। ১৪-০৯-৭১ তারিখে জামায়াতের মুখপত্র সংগ্রামে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যাতে লেখা ছিল “আলবদর একটি নাম! একটি বিস্ময়! আলবদর একটি প্রতিজ্ঞা! যেখানে তথাকথিত মুক্তিবাহিনী, আলবদর সেখানেই। যেখানেই দুষ্কৃতকারী, আলবদর সেখানেই। ভারতীয় চর কিংবা দুষ্কৃতকারীদের কাছে আলবদর সাক্ষাত আজরাইল। ” সারাবছর ধরে তারা হত্যাকা- চালালেও, পরাজয় আসন্ন জেনে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই আলবদররা মরণকামড় দেয়।

এ সম্পর্কে সে-সময়কার দৈনিক বাংলায় ১৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয়েছিল একটি প্রতিবেদন “এই নৃশংস হত্যাকা- চালিয়েছে গত সপ্তাহ ধরে জামায়াতে ইসলামীর আলবদর। ‘শহরের কয়েকশ’ বুদ্ধিজীবী ও যুবককে এরা ধরে নিয়ে গিয়ে অমানুষিকভাবে হত্যা করেছে। ” “গতকাল রায়েরবাজার ও ধানম-ি এলাকার বিভিন্ন গর্ত হতে বহুসংখ্যক লাশ উদ্ধার করা হয়। এদের মধ্যে অধ্যাপক, ডাক্তার, সাংবাদিক ও সাহিত্যিকদের লাশও রয়েছে। এপর্যন্ত কতিপয় ব্যক্তির লাশ শনাক্ত করা গেছে।

অনেক লাশই বিকৃত হয়ে গেছে, চেনার উপায় নেই। গত এক সপ্তাহে যতজন নিখোঁজ হয়েছেন অনুমান করা হচ্ছে যে, এদের একজনকেও আলবদর রেহাই দেয়নি। “ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংস্থা ইসলামী ছাত্রসংঘের সশস্ত্র গ্রুপ আলবদর সেই বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা নগরী মুক্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এক সপ্তাহে শহরের কয়েকশ’ বুদ্ধিজীবী ও যুবককে ধরে নিয়ে যায়। ” সমন্বয়ের রাজনীতিতে যারা বিশ্বাসী তাদের হয়ত এ বিবরণ বিশ্বাসযোগ্য নাও মনে হতে পারে। কারণ তা প্রকাশিত হয় ঢাকা থেকে একটি দৈনিকে।

সেজন্য তৎকালীন বিখ্যাত সাংবাদিক নিকোলাস টোমালিনের একটি বিবরণ (বঙ্গানুবাদ) এখানে উদ্ধৃত করা হলো “বধ্যভূমিটি হচ্ছে ঢাকা শহরের মধ্যবিত্তদের আবাসিক এলাকা ধানম-ির কাছে একটি ইটখোলা। এটি একটি অদ্ভুত নির্জন জায়গা : যদিও নীলচে-শাদা এঁদো জলাশয়গুলোতে কচুরিপানা ভেসে বেড়ায়। “শত শত ঢাকাবাসী আজ এখানে এসেছিলেন। মৃতদেহগুলো দেখার জন্য কাদামাটির পাড় ধরে হাঁটতে থাকা লোকদের অনেকেই নিজেদের আত্মীয়স্বজনের লাশ খুঁজছিলেন। “এখানে এই বুদ্ধিজীবীরা এখনও শুয়ে আছেন : তাদের শরীরের ওপর জমেছে ধুলো-কাদা, দেহগুলো গলতে শুরু করেছে, একটি বাঁধের ওপর একটি কঙ্কাল পড়ে রয়েছে : ঢাকার কুকুরগুলো নাটকীয়ভাবে দেহটিকে মাংসমুক্ত করে ফেলেছে।

“বাঙালী জনতা এই ডোবাগুলোতে এক অদ্ভুত শান্ত ভঙ্গিমায় চলাচল করছে। এখানে তাদের ক্রোধান্বিত মনে হয় না। অন্যত্র তারা ক্রোধোন্মত্ত। কিন্তু এখানে তারা হাঁটছে, মৃদু ফিসফিস করে কথা বলছে, তারা যেন গির্জা পরিদর্শনরত পর্যটক। ” ১২. আলবদরের বিরুদ্ধে তদন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার জার্মানিতে সুপরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদের নিধন করেছিলেন।

আলবদররা অবিকলভাবে হিটলারের নীলনকশা অনুসরণ করেছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশেই, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৃহৎ আকারে গণহত্যা ও সুপরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়। এই প্রকল্পের পরিকল্পক পাকিস্তানী সামরিক জান্তা। আর ওই প্রোগ্রাম কার্যকর করার দায়িত্বে ছিল প্রধান আলবদর ও আলশামসরা। সামরিক জান্তার পক্ষে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ছিলেন হত্যা পরিকল্পনা ও পরিকল্পক।

আলবদররা ছিল সামরিক বাহিনীর অধীনে। সেজন্য তাত্ত্বিকভাবে তারা ছিল জেনারেল নিয়াজীর অধীনে। সে হিসেবে গণহত্যা তো বটেই বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্যও নিয়াজী দায়ী। আলবদরদের হত্যাকা-, নিষ্ঠুরতা জনমনে এমনই অভিঘাত সৃষ্টি করেছিল যে, পাকিস্তানী, রাজাকার বা শান্তি কমিটির সদস্যদের বিচারের আগেই আলবদরদের বিচারের দাবি ওঠে। ২৫ ডিসেম্বর, (১৯৭১) দৈনিক বাংলা লিখেছিল “আলবদর বাহিনীর এই নৃশংস হত্যাকা--সংক্রান্ত তথ্যাদি সংগ্রহের জন্য অবিলম্বে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করা দরকার।

এই কমিটিকে সরকারের কাছে এক সপ্তাহের মধ্যে রিপোর্ট পেশ করতে হবে। তাদের তদন্তের ভিত্তিতে এই হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত পশুদের শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। জেনেভা কনভেনশনের উছিলায় যাতে তারা নিষ্কৃতি না পায়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। যদি এসব দুর্বৃত্ত রেহাই পেয়ে যায়, তবে এদেশের নিহত নিরপরাধীদের আত্মা কখনও আমাদের ক্ষমা করবে না। ” অবশেষে চলচ্চিত্র পরিচালক, সাহিত্যিক জহির রায়হানের নেতৃত্বে বুদ্ধিজীবীরা নিজেই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন।

১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে ভারতের সাপ্তাহিক নিউজ পত্রিকায় এক সাক্ষাতকারে জহির রায়হান জানান “আলবদরদের কার্যকলাপ অনুসন্ধান করতে যেয়ে আমরা এই সাথে অপরাধীদের প্রকৃত উদ্দেশ্য বুঝবার জন্য নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে যখন নিহত বাবা ও ভাইয়ের দেহের অবশেষ ঢাকায় বধ্যভূমিতে খুঁজে ফিরছিলাম তখন আমাদের ধারণা ছিল যে, দখলদার পাকিস্তানী শাসকদের নিশ্চিত পরাজয় উপলব্ধি করে সন্ত্রস্ত গোড়া ধর্মধ্বজী পশুরা ক্রোধান্ধ হয়ে কাপুরুষোচিত হত্যাকা-ের মাধ্যমে প্রতিহিংসাবৃত্তি চরিতার্থ করেছে। কিন্তু পরে বুঝেছি, ঘটনা তা ছিল না। কেননা এই হত্যাকা-ের শিকার যারা হয়েছেন তারা বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের প্রতিনিধিস্থানীয় এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মনোভাবের জন্য সুপরিচিত ছিলেন। “আলবদর বাহিনীর ধর্মান্ধ ও মূর্খ লোকদের কাছে সব লেখক ও অধ্যাপকই এক রকম ছিলেন।

জহির রায়হান বলছিলেন, এরা নির্ভুলভাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনা বুদ্ধিজীবীদেরকে বাছাই করে আঘাত হেনেছে। এ থেকে একটা সিদ্ধান্তেই পৌঁছানো যায় যে, আলবদরের এই স্বেচ্ছাসেবকরা অপরের ইচ্ছা কার্যকর করার বাহন ছিল মাত্র। কিন্তু কারা এ খুনীদের পেছনে ছিল? “সংগৃহীত দলিল ও সাক্ষ্য-প্রমাণাদি থেকে জানা যায়, শ্রেষ্ঠ বাঙালী সন্তানদের হত্যার কাজে নিয়োজিত অন্ধ ধর্মীয় শিক্ষাপ্রাপ্ত গু-াদেরকে আলবদর বাহিনীতে যারা সংগঠিত করে তারা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাথে জড়িত। “পূর্বে উল্লেখিত পাকিস্তানী জেনারেলের (বুদ্ধিজীবী হত্যার নায়ক জেনারেল রাও ফরমান আলী) ডায়েরিতে উল্লেখ পাওয়া যায় যে, দু’জন আমেরিকান নাগরিক ঢাকা সফর করে। এরা হলো হেইট (ঐবরঃযঃ) ও ডুসপিক (উবিংঢ়রপ) ।

“এদের নামে পাশে ছোট ছোট অক্ষরে ইউএসএ (টঝঅ) ও ডিজিআইএস (উএওঝ) অর্থাৎ ডিরেক্টর জেনারেল অব ইন্টারন্যাশনাল সার্ভিস লেখা ছিল। আর লেখা আছে রাজনৈতিক ৬০-৬২, ৭০। অপর এক জায়গায় লেখা আছে এ দু’জন আমেরিকান পিআইএর একটি বিশেষ বিমানে ব্যাংককের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করে। হেইট ও ডুসপিক কে? ঢাকার দৈনিক বাংলার রিপোর্টে দেখা যায়, হেইট ১৯২৮ সালে জন্মগ্রহণ করে। সে ১৯৪৬-৪৯ সাল পর্যন্ত সেনাবাহিনীতে চাকরি করত।

১৯৫৩ সাল থেকে সে সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের সাথে যুক্ত ছিল। ১৯৫৪ সাল থেকে সে আমেরিকান দূতাবাসের রাজনৈতিক কূটনীতিবিদ হিসেবে বহু দেশ ভ্রমণ করেছে। সে কলকাতা ও কায়রোতেও ছিল। সিআইএ এজেন্ট ডুসপিকের সাথে গত বছর সে ঢাকায় ফিরে আসে এবং রাও ফরমান আলীর সাথে তিন হাজার বুদ্ধিজীবীর একটি তালিকা তৈরি করে। জোনারেলের শোবার ঘরে এই তালিকা পাওয়া গেছে।

“নিহত বুদ্ধিজীবীদের আত্মীয়-স্বজনদের সাক্ষ্য থেকে জানা যায় যে, আলবদর বাহিনীর পরিকল্পিত হত্যার কাজে বিদেশী মুখোশ, ছদ্ম পোশাক ও ছোরা ব্যবহার করা হয়েছে। গণহত্যা তদন্ত কমিটির রিপোর্ট থেকে এই তথ্য পাওয়া যায়। এই ১০ জন অফিসারের পরিচয় এবং বুদ্ধিজীবী হত্যা সংক্রান্ত অন্যান্য দলিলপত্র আর কখনই আমাদের হস্তগত হয়নি। এদের মধ্যে হত্যাযজ্ঞ সরাসরিভাবে পরিচালনাকারী দুই অফিসারÑ জেনারেল নিয়াজী এবং জেনারেল রাও ফরমান আলীকে ২০ ডিসেম্বর একটি বিশেষ বিমানে কলকাতা নিয়ে যাওয়ার পর কড়া সামরিক প্রহরায় কোন এক অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। হত্যাযজ্ঞের সাথে জড়িত অন্যান্য অফিসারকেও অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়।

” এরপর তাঁর বড় ভাই শহীদুল্লা কায়সারের খোঁজে মিরপুরে গিয়ে তিনি নিজেই নিখোঁজ হয়ে যান। তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ছিল। তারপরও জহির রায়হানের নিখোঁজ হওয়া কেউ রুখতে পারেনি। মনে রাখা দরকার, মিরপুর তখনও ছিল আলবদর কাদের মোল্লার দখলে। বুদ্ধিজীবী হত্যার তদন্তকাজ জহির রায়হানের অন্তর্ধানের পর থেমে যায়।

তিনি যেসব নথিপত্র যোগাড় করেছিলেন সেগুলোও আর কোন খোঁজখবর পাওয়া যায়নি। তবে, বুদ্ধিজীবী-গণহত্যার বিচারের দাবি থামানো যায়নি। ১৯৭২ সাল থেকেই এই দাবি তোলা হয়েছিল এবং তৎকালীন সরকারও এ বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছিল এবং আন্তর্জাতিকভাবেও দাবি উঠেছিল বিচারের। এ সম্পর্কিত কয়েকটি উদাহরণ ১. ১৯৭২ সালে আন্তর্জাতিক জুরি সম্মেলন রায় দিয়েছিল, বাংলাদেশের গণহত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি হওয়া উচিত (দৈনিক ইত্তেফাক ৭.৯.১৯৭২) ২. মুসলিম দেশগুলোর প্রতি তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আহ্বান জানিয়ে ছিলেন ‘ইসলামের নামে গণহত্যা দেখিয়া যান’ (ঐ ২৬.২.১৯৭২) ৩. সরকার গঠন করে গণহত্যা তদন্ত কমিশন, ৫.৪.১৯৭২। ৪. ড. কামাল হোসেন ঘোষণা করেছিলেন, গণহত্যার বিচার বাংলাদেশেই হবে।

বিজয়ের দু’দিন পর ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার দাবি করা হয়। শহীদ বুদ্ধিজিবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মন্ত্রিসভায় প্রথম বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল ‘চারুকলা ও সাহিত্য-সংক্রান্ত ন্যাশনাল কাউন্সিল গঠন করা হবে। ’ তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, হত্যার বিচার হবে। বঙ্গবন্ধুও তো স্বপ্ন দেখেছিলেন অপরাধীদের বিচারের। ২১ ডিসেম্বর তারিখে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে এক বিশেষ সাক্ষাতকারের বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বিশিষ্ট সমর্থক ব্রিটেনের সাবেক মন্ত্রী জন স্টোনহাউজ বলেন, বাংলাদেশে শত শত বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করার ব্যাপারে পাকবাহিনী যে জড়িত ছিল তার প্রমাণ তার কাছে রয়েছে।

ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে যখন এই হত্যাকা- চলছিল তখন মি. স্টোনহাউজ ঢাকাতেই ছিলেন। সাক্ষাতকারে মি. স্টোনহাউজ বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যার সাথে সরাসরি জড়িত ক্যাপ্টেন থেকে জেনারেল পদমর্যাদার দশ জন সামরিক অফিসারকে তিনি চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছেন। এই অফিসারদের নাম প্রকাশে তাৎক্ষণিকভাবে অস্বীকৃতি জানিয়ে তিনি এ-বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে তদন্ত করার জোর দাবি জানান। বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত মুখ্য দালালদের নামও উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন বলে তিনি জানান। তথ্যসূত্র: দৈনিক জনকণ্ঠ ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.